বউনামা! পর্ব-০৮
#বউনামা_৮
(১)
শ্বশুর বাড়ি যাওয়া উচিত লম্বা লম্বা গ্যাপ দিয়ে, তবে যাওয়ার পর কয়েকদিন থাকা উচিত। গ্যাপ দিয়ে যাওয়ার দরুণ আদর বাড়ে, আর কয়েকদিন থাকলে সেই আদর উপভোগ করা যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আদর উপভোগ করার আগেই শ্বশুর বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে কর্মস্থলের ডাকে। এদিকে নীরার মোটেও ভাল লাগছে না। সে আরো দুয়েকদিন থাকার ইচ্ছে পোষন করেছিল, অবশ্য আমাকে বলেনি। আমি ওকে দেখে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখানে আমি অপারগ, তাই দুজনকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত জীবনের উদ্দেশ্যে।
এদিকে আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। বাঙালীদের একটি স্মরণীয় দিন। সেই সাথে শোকের ও। অবশ্য শোক রাস্তায় বেরুলে তেমন একটা বোঝা যায় না। রঙিন রঙিন পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে যুবক যুবতীরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেমন একটা সাজ সাজ রব চারদিকে, শোকের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ আজকাল কোন দিবস এলেই আমি রক্ত দেখি, তাজা রক্ত! রোদের আলোয় চিকচিক করা পিচঢালা রাস্তায় জমে কাল হয়ে ওঠা রক্ত। এ রক্ত মানুষকে ডাকে, প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে ডাকে, সাড়া দেয়না মানুষ, বড়ই পাষণ্ড মানুষ।
সিএনজি বাজারের মাঝ বরাবর আসতেই শুনতে পেলাম প্রচণ্ড আওয়াজে বাজছে, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে……” আজ স্বাধীনতা দিবস নয়, আজ শহীদ দিবস, ভাষা দিবস। কে বোঝাবে এদের? কিংবা এদেরও কি বোধশক্তি নেই এটুকু বোঝার? এই গান পর্যন্তও ঠিক ছিল, কিন্তু একটু পরই প্রচণ্ড আওয়াজে হিন্দি গান বেজে উঠল। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, আমি আর থাকতে পারলাম না। সিএনজি থেকে প্রচণ্ড গতিতে নামতে গেলে নীরা আমার হাত ধরে ফেলল। আমার রাগ এত বেশি ছিল যে নীরার হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে ওর হাতে আঘাত লাগল। আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক মূহুর্তগুলোর মধ্যে বোধহয় এটি একটি ছিল। আমি থেমে গেলাম, পা শ্লথ হয়ে গেল। নীরা মাথা নিচু করে আছে, বোধহয় কাঁদছে। নিজের উপর নিজের প্রচণ্ড রাগ হল। ইচ্ছে করছিল নিজের হাত দুটো কেটে ফেলি। নীরা কে কখনো আঘাত দিব এটা ভাবতেও পারিনি। গাড়িতে উঠে বসলাম, ঢাকা যাওয়া হবেনা। সালমা আপুর বাসার দিকে চললাম।
(২)
বিয়ের পর সালমা আপুর বাসায় এ প্রথম এসেছি। আপু প্রথমে আমাদের দেখেই অবাক। আমাদের আসার কথাও ছিল না। আর এদিকে আমি শুধু মুখ লুকানোর চেষ্টা করছি, বিয়ের আগে মেয়ে দেখা নিয়ে আপুর সাথে যা হল, সেটার পর মুখ দেখানোই দায়। এদিকে আমার চিন্তা হচ্ছে নীরা কে নিয়ে। এখানে এসেছি মূলত ওর হাতে একটু ওষুধপত্র করার জন্য। এদিকে ও আপুকে পেয়ে গল্পে মেতে গেছে।
অন্যদিকে সালমা আপুর এক ছেলে, এক মেয়ে। আমাকে ঘিরে বসে আছে দুজন। লজ্জাকর বিষয় হল আমি পিচ্চি দুটোরই নাম ভুলে বসে আছি। বিয়ের এই এক সমস্যা, শ্যালক-শ্যালিকাদের নামই ঠিকমত মনে রাখা যায়না, তার উপর পিচ্চিরা! বিয়ের পর যেবার গেছিলাম সেবার এক শ্যালিকা এসে আমাকে বলল, “দেখি বলেন তো আমার নাম কি? বিয়ের দিন কিন্তু আমি আপনাকে সালাম করেছি” তার দিকে আমি এমনভাবে তাকালাম যেভাবে একবার আমাদের গণিতের শিক্ষক এসে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, “এই ছমাসে আমি তোমাকে আজ প্রথম দেখলাম” যাহোক, সেদিন শ্যালিকার নাম বলতে পারিনি। ভরা মজলিসে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছিলাম। আজও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে ভেবে আমি এদেরকে নাম ছাড়া ‘পিচ্চি’ বলে সম্বোদন করছি। আবার এটাও বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি ওদের নাম জানিনা।
এদিকে দুলাভাই আজ বেশ অন্যরকম মুডে। উনাকে আমার স্বাভাবিক ভাবেই খুব ভাললাগে, অন্যরকম আন্তরিক একজন মানুষ। বাসায় প্রবেশ করেই আজকে যে জিনিসটি লক্ষ্য করেছি সেটি হচ্ছে সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে এবং একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না। আর আসার পর থেকে দুলাভাই ভাষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছে মাতৃভাষা দিবসের বেশ একটা গুরুত্ব তাঁদের কাছে আছে। দুলাভাই বক্তব্যের শেষে নীরাকে ডাকলেন, নীরা পর্দার আড়ালে থাকল। আমাদের দুজন কে উদ্দ্যেশ্য করে দুলাভাই আজকের দিনের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিলেন। আজকের দিনের বললে ভুল হবে, তিনি চান আজকের দিন থেকে সামনে চলমান থাকবে এ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া টি হল শুদ্ধ বাংলা চর্চা। নিয়ম হচ্ছে সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলা বলতে হবে, অন্য ভাষার কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা।
-দুলাভাই আমি যদি নিত্য ব্যবহার্য শব্দ বিশেষত ইলেকট্রনিক ডিভাইস কিংবা এ ধরণের কিছুর ক্ষেত্রে ইংরেজি টাই ইউজ করি তাহলে হবে?
দুলাভাই আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কারণ আমি ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছি। কিন্তু ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বাংলা বলতে হলে আমাকে অন্তত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে। ভেবেচিন্তে তারপর বলতে হবে। কিন্তু দুলাভাই চুপ করে আছে দেখে আমাকে ফোনে ডিকশনারি খুলে সার্চ করতে হল।
-আমরা কি বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোর ইংরেজি নাম ব্যবহার করতে পারব?
ভেতর থেকে ফিক করে হেসে দেয়ার আওয়াজ পেলাম। এটা নিঃসন্দেহে নীরা, ওর হাসি আমার ভীষণ পরিচিত, সেই সাথে সালমা আপুর হাল্কা মিশ্রণ আছে বোধহয়, জোড়া হাসি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমার কথায় দুলাভাই এর হাসির উদ্রেক হল না। তিনি তেমনই গম্ভীর রইলেন।
-বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোরও বাংলা নাম অবশ্যই আছে।
-তাহলে তো ডিকশনারী নিয়ে ঘুরতে হবে। যখনি আটকে যাব সার্চ দিয়ে বলে দেব।
বলেই জিভ কামড়ে ফেললাম, আবারও ভুল করে ফেলেছি।
-মানে অভিধান নিয়ে ঘুরব আরকি। মোবাইলে তো আছেই। অভিধানে খোঁজ দিলেই হবে।
মোবাইলের বাংলা বোধহয় মোবাইল ই। তাও কেমন দ্বিধা হল। তবে দুলাভাই কিছুটা সন্তুষ্ট। তিনি আমাদের কে অনেকটাই লাইনে আনতে পেরেছেন। এরপর দুলাভাই ভাষা বিষয়ক সমাপনী বক্তব্য দিয়ে উঠে গেলেন। আর আমি পিচ্চি দুটোকে নিয়ে বসে রইলাম। এখনো কারো নাম মনে পড়ছে না।
(৩)
-হাতে কিছু মালিশ করেছো?
-জ্বি।
-কি?
-মুভ ছিল। আপু মালিশ করে দিয়েছে।
-নীরা!
-জ্বি।
-আমি দুঃখিত।
আই এম সরি বলে যেমন ক্ষমা চাওয়ার একটা অনুভূতি আসে, আমি দুঃখিত বললে তা কেমন জানি আসে না। মনে হয় আবেগ নিয়ে বলছি না। শুধুমাত্র দায়সারা করে বলছি। এটার ঠিক উলটো হয় ভালবাসা প্রদর্শনের সময়। “I love u” বলায় সেই অনুভূতি নেই, যেমন অনুভূতি “আমি তোমাকে ভালবাসি” বলায় আছে। ভাষা ব্যবহারে অনুভূতির এসব জটিল সমীকরণের হিসেব বুঝিনা আমি। প্রায়ই ভাবি, কিন্তু সমাধান আসে না কোন।
-আমাকে ক্ষমা করিয়া দাও।
এ কথা শুনে নীরা হেসে দিল।
-আরে বোকা, শুদ্ধ বাংলা বলতে বলেছে। একেবারে সাধু বলতে বলেছে নাকি?
-ও হ্যাঁ। আচ্ছা, ক্ষমা করে দাও আমাকে প্লিজ!
-প্লিজ?
-আই মিন, দয়া করে।
-আই মিন?
-হুর! হবেনা আমাকে দিয়ে। আমি হতাশ!
এদিকে নীরার ডাক পড়েছে, নীরা চলে গেল। আমি একা একা বসে রইলাম। একটু পর আমারও ডাক পড়ল, ডাক শুনেই মনে হল আবার বোধহয় ভাষা বিষয়ক সেমিনার হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তার চেয়েও ভয়ানক। একটা ব্যানারে লিখা “শুদ্ধ উচ্চারণ প্রশিক্ষণ সভা”। সেটা সামনের রুমে টাঙানো হয়েছে। দুলাভাই বসে আছেন, তার সামনে আসন পেতে বসেছে পিচ্চি দুটো, পর্দার ওপাশে নীরা আর আপু।
আমিও গিয়ে বসলাম প্রশিক্ষণ সভায়। দুলাভাই সবাইকে বাংলা অক্ষর উচ্চারণ, এরপর শব্দ উচ্চারণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। আমার মনে হল এবার সত্যিই অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম। অনেক সুন্দর ভাবে প্রশিক্ষণ সভা শেষ করলাম। সভা শেষে পরীক্ষা হল। আমি সবচেয়ে কনফিডেন্ট ছিলাম। “এটা বাচ্চাদের খেল!” এরকম একটা ভাব নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। ফলাফল যখন দিল তখন আমার কনফিডেন্স হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, আমি লাস্ট হয়েছি, অর্থাৎ সর্বনিম্ন নম্বর পেয়েছি। দুলাভাই আমাকে নিয়ে বেশ খানিকটা টিটকিরি মেরে দিলেন।
-কি? তুমি না লেখক? তোমার এই ফলাফল খুবই হতাশাজনক!
আমি কটমট করতে করতে উঠে চলে এলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে নিজের বাংলা ভাষার স্কিল দেখানোর পণ করলাম। আই মিন, দক্ষতা।
(৪)
খাবার টেবিলে সবাই নিরবে খাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছেনা। কথা বললেই মনে হচ্ছে গ্রেফতার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এমন বৈরি পরিস্থিতিতে আমি কথা বলে উঠলাম।
-দুলাভাই, আপনার উদ্যোগ টা সত্যিই চমৎকার! অসাধারণ!
-হ্যাঁ।
প্রশংসা করলাম, ধন্যবাদ টাও পেলাম না। এবার বোধহয় তাহলে একটু সমালোচনা করতে হবে।
-কিন্তু একটা জিনিস ভাবেন, এমন অনেক অনেক ইংরেজি শব্দ আছে যার বাংলায় রিপ্লেসমেন্ট নেই। সেক্ষেত্রে কি হবে?
-রিপ্লেসমেন্ট শব্দের কিন্তু বাংলায় প্রতিস্থাপনযোগ্য শব্দ আছে।
এবং আমি প্রচণ্ড বেগে একটা বাঁশ খেয়ে গেলাম। দুলাভাই থাগ লাইফ লুক দিলেন। আমি লজ্জিত হয়েও লজ্জা লুকানোর ভান করলাম।
-জ্বি দুঃখিত। কিন্তু মনে করেন, কিছু শব্দ কে আসলেই প্রতিস্থাপন করা দুঃসাধ্য। যেমন ধরেন আজকাল ‘টেনশন’ শব্দটি অনেকটা বাংলা শব্দ হয়ে গেছে। আপনি যদি ‘দুঃশ্চিন্তা’ বলেন তখন বরং অদ্ভুত শোনাবে। কেউ একজন ‘ক্লাসে যাচ্ছি’ না বলে যখন বলে ‘শ্রেণীকক্ষে যাচ্ছি’ তখন হয়ত তাকে ধরে পিটুনি ই লাগিয়ে দেবে মানুষ। শিক্ষক ক্লাসে ‘লেকচার’ দিয়েছেন না বলে যদি বলি ‘বক্তব্য’ দিয়েছেন, তখন শিক্ষকের নামে কথা হয়ে যেতে পারে, এই শিক্ষক না পড়িয়ে কিসের বক্তব্য দেয়! ‘ড্রাইভার’, ‘কন্ট্রাক্টর’, ‘হেল্পার’, ‘লেভার’ এই শব্দগুলোকে যদি যথাক্রমে ‘চালক’, ‘ঠিকাদার’, ‘সহযোগী’ আর ‘শ্রমিক’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেয়া হয় আর সেসব যদি আপনি বলতে শুরু করেন, কেমন শোনাবে ভাবেন? এগুলো কিন্তু লিখার সময় বাংলায়ই লিখা হয়। শুধুমাত্র বলার সময় প্রচলিত শব্দটাই বলা হয়। কারণ তা না হলে আপনি এমন একজনের সাথে মতবিনিময় করতে পারবেন না যে হয়ত পড়াশোনা জানেনা। সে হয়ত জানেইনা কন্ট্রাক্টর শব্দটির অর্থ মূলত ঠিকাদার। আপনি ফার্নিচার দোকানে গিয়ে কেদারা কিনতে চাইলে মানুষ অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে ‘কারেন্ট বিল’ না দিয়ে ‘বিদ্যুৎ বিধেয়ক’ কোথায় দিব খুঁজতে থাকলে আপনিই হতাশ হবেন। আমি দুয়েকটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি তার মানে এই না যে আমি আমার মায়ের ভাষা ভালবাসি না। এটা করি যাতে আমি মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। তবে আমি তাদের অবশ্যই বিরোধিতা করি যারা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যারা মায়ের ভাষা বাংলার চেয়ে হিন্দি কিংবা ইংরেজি কে বেশি প্রাধান্য দেয়। আজকাল আপনি কোথাও চাকরি করতে যান, কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যান, আপনি যদি ইংরেজি না জানেন, ইংরেজিতে কমিউনিকেট করতে না পারেন, আপনাকে বের করে দেয়া হবে। আপনার চাকরি হবেনা, এটাই বাস্তবতা। সেইসব জায়গা গুলোতে পরিবর্তন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা স্নাতক পর্যায়ে যেকোন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মিডিয়াম পড়াশোনা যেখানে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। যে ছাত্র সারাদিন ইংরেজিতে পড়াশুনা করে, স্যারদের লেকচার শোনে, সে কি করে সম্পূর্ণ বাংলায় কমিউনিকেট করতে পারবে? এ দোষ তো তার না। এসব জায়গায় পরিবর্তন দরকার দুলাভাই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলাম আমি। সবাই ভাতের লোকমা হাতে নিয়ে বসে আছে, আর সবার মুখ হা করা। বহুদিন পর নিজের সুপারপাওয়ার প্রদর্শন করতে পেরে আনন্দ লাগছে। ভাইয়া খুব গভীরভাবে কি যেন ভাবলেন, তারপর চুপচাপ ভাত খেতে লাগলেন। খাবার টেবিলে আর দ্বিতীয় কোন কথা হল না।
রাতে নীরার হাতে মুভ লাগিয়ে দিলাম। হাতের কিছুটা জায়গা জখম হয়ে কাল হয়ে গেছে। এদিকে আমার মন খারাপ দেখে নীরা আমার মন ভাল করার চেষ্টায় বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। রোজ এই কাজটা আমি করি, যখন ও গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ও আমাকে একটা কথা প্রায়ই বলে, “তুমি আমার হাসির ডিব্বা। এই ডিব্বা একবার খুলে গেলে আমি আর না হেসে পারিনা”
সত্যিই এমন। আমার কাজই ছিল ওকে হাসানো, যখন দূরে ছিল তখনো, এখন যখন কাছে আছে এখনো। আমি কিন্তু বিনে পয়সায় কাজ করিনা। বিনিময়ে চাঁদের হাসি দেখি, একা বসে, পুরো পৃথিবী থেকে লুকিয়ে। ও যখন হাসে, মনে হয় এটাই জীবন, এইটুকুতেই জীবন। শুধু ও হাসতে থাকুক, ঘড়ি চলতে থাকুক, সময় এভাবেই চলে যাক। আজ হঠাৎ করে আমার হাসির ডিব্বায় হাসি ফুরিয়ে গেছে, এজন্য নীরা রিচার্জ করার চেষ্টা করছে। দেখে ভীষণ মায়া হল। ও যে মায়াবতী, মায়া না হয়ে যায় কোথায়? আমি ওকে বললাম, “নীরা, একটা ইংরেজি লাইনকে বাংলায় অনুবাদ করো তো!” নীরা অতি উৎসাহী হয়ে বলল, “বলো বলো!”
আমি বললাম, “Lets cuddle!”
নীরা এক সেকেন্ড ভাবল। যখন বুঝতে পারল তখন হাত মুষ্টি করে আমার বাহুতে ঘুষি মারল। আর আমি মনে মনে বললাম, “হে ইংরেজির Love, কিংবা বাংলার ভালবাসা, তুমি যে ই হও, কখনো ফুরিয়ে যেও না!”
(চলবে………)
(১)
শ্বশুর বাড়ি যাওয়া উচিত লম্বা লম্বা গ্যাপ দিয়ে, তবে যাওয়ার পর কয়েকদিন থাকা উচিত। গ্যাপ দিয়ে যাওয়ার দরুণ আদর বাড়ে, আর কয়েকদিন থাকলে সেই আদর উপভোগ করা যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আদর উপভোগ করার আগেই শ্বশুর বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে কর্মস্থলের ডাকে। এদিকে নীরার মোটেও ভাল লাগছে না। সে আরো দুয়েকদিন থাকার ইচ্ছে পোষন করেছিল, অবশ্য আমাকে বলেনি। আমি ওকে দেখে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখানে আমি অপারগ, তাই দুজনকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হল ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত জীবনের উদ্দেশ্যে।
এদিকে আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। বাঙালীদের একটি স্মরণীয় দিন। সেই সাথে শোকের ও। অবশ্য শোক রাস্তায় বেরুলে তেমন একটা বোঝা যায় না। রঙিন রঙিন পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে যুবক যুবতীরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেমন একটা সাজ সাজ রব চারদিকে, শোকের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ আজকাল কোন দিবস এলেই আমি রক্ত দেখি, তাজা রক্ত! রোদের আলোয় চিকচিক করা পিচঢালা রাস্তায় জমে কাল হয়ে ওঠা রক্ত। এ রক্ত মানুষকে ডাকে, প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে ডাকে, সাড়া দেয়না মানুষ, বড়ই পাষণ্ড মানুষ।
সিএনজি বাজারের মাঝ বরাবর আসতেই শুনতে পেলাম প্রচণ্ড আওয়াজে বাজছে, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে……” আজ স্বাধীনতা দিবস নয়, আজ শহীদ দিবস, ভাষা দিবস। কে বোঝাবে এদের? কিংবা এদেরও কি বোধশক্তি নেই এটুকু বোঝার? এই গান পর্যন্তও ঠিক ছিল, কিন্তু একটু পরই প্রচণ্ড আওয়াজে হিন্দি গান বেজে উঠল। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, আমি আর থাকতে পারলাম না। সিএনজি থেকে প্রচণ্ড গতিতে নামতে গেলে নীরা আমার হাত ধরে ফেলল। আমার রাগ এত বেশি ছিল যে নীরার হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে ওর হাতে আঘাত লাগল। আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক মূহুর্তগুলোর মধ্যে বোধহয় এটি একটি ছিল। আমি থেমে গেলাম, পা শ্লথ হয়ে গেল। নীরা মাথা নিচু করে আছে, বোধহয় কাঁদছে। নিজের উপর নিজের প্রচণ্ড রাগ হল। ইচ্ছে করছিল নিজের হাত দুটো কেটে ফেলি। নীরা কে কখনো আঘাত দিব এটা ভাবতেও পারিনি। গাড়িতে উঠে বসলাম, ঢাকা যাওয়া হবেনা। সালমা আপুর বাসার দিকে চললাম।
(২)
বিয়ের পর সালমা আপুর বাসায় এ প্রথম এসেছি। আপু প্রথমে আমাদের দেখেই অবাক। আমাদের আসার কথাও ছিল না। আর এদিকে আমি শুধু মুখ লুকানোর চেষ্টা করছি, বিয়ের আগে মেয়ে দেখা নিয়ে আপুর সাথে যা হল, সেটার পর মুখ দেখানোই দায়। এদিকে আমার চিন্তা হচ্ছে নীরা কে নিয়ে। এখানে এসেছি মূলত ওর হাতে একটু ওষুধপত্র করার জন্য। এদিকে ও আপুকে পেয়ে গল্পে মেতে গেছে।
অন্যদিকে সালমা আপুর এক ছেলে, এক মেয়ে। আমাকে ঘিরে বসে আছে দুজন। লজ্জাকর বিষয় হল আমি পিচ্চি দুটোরই নাম ভুলে বসে আছি। বিয়ের এই এক সমস্যা, শ্যালক-শ্যালিকাদের নামই ঠিকমত মনে রাখা যায়না, তার উপর পিচ্চিরা! বিয়ের পর যেবার গেছিলাম সেবার এক শ্যালিকা এসে আমাকে বলল, “দেখি বলেন তো আমার নাম কি? বিয়ের দিন কিন্তু আমি আপনাকে সালাম করেছি” তার দিকে আমি এমনভাবে তাকালাম যেভাবে একবার আমাদের গণিতের শিক্ষক এসে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, “এই ছমাসে আমি তোমাকে আজ প্রথম দেখলাম” যাহোক, সেদিন শ্যালিকার নাম বলতে পারিনি। ভরা মজলিসে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছিলাম। আজও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে ভেবে আমি এদেরকে নাম ছাড়া ‘পিচ্চি’ বলে সম্বোদন করছি। আবার এটাও বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি ওদের নাম জানিনা।
এদিকে দুলাভাই আজ বেশ অন্যরকম মুডে। উনাকে আমার স্বাভাবিক ভাবেই খুব ভাললাগে, অন্যরকম আন্তরিক একজন মানুষ। বাসায় প্রবেশ করেই আজকে যে জিনিসটি লক্ষ্য করেছি সেটি হচ্ছে সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে এবং একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না। আর আসার পর থেকে দুলাভাই ভাষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছে মাতৃভাষা দিবসের বেশ একটা গুরুত্ব তাঁদের কাছে আছে। দুলাভাই বক্তব্যের শেষে নীরাকে ডাকলেন, নীরা পর্দার আড়ালে থাকল। আমাদের দুজন কে উদ্দ্যেশ্য করে দুলাভাই আজকের দিনের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিলেন। আজকের দিনের বললে ভুল হবে, তিনি চান আজকের দিন থেকে সামনে চলমান থাকবে এ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া টি হল শুদ্ধ বাংলা চর্চা। নিয়ম হচ্ছে সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলা বলতে হবে, অন্য ভাষার কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা।
-দুলাভাই আমি যদি নিত্য ব্যবহার্য শব্দ বিশেষত ইলেকট্রনিক ডিভাইস কিংবা এ ধরণের কিছুর ক্ষেত্রে ইংরেজি টাই ইউজ করি তাহলে হবে?
দুলাভাই আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কারণ আমি ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছি। কিন্তু ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বাংলা বলতে হলে আমাকে অন্তত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে। ভেবেচিন্তে তারপর বলতে হবে। কিন্তু দুলাভাই চুপ করে আছে দেখে আমাকে ফোনে ডিকশনারি খুলে সার্চ করতে হল।
-আমরা কি বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোর ইংরেজি নাম ব্যবহার করতে পারব?
ভেতর থেকে ফিক করে হেসে দেয়ার আওয়াজ পেলাম। এটা নিঃসন্দেহে নীরা, ওর হাসি আমার ভীষণ পরিচিত, সেই সাথে সালমা আপুর হাল্কা মিশ্রণ আছে বোধহয়, জোড়া হাসি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমার কথায় দুলাভাই এর হাসির উদ্রেক হল না। তিনি তেমনই গম্ভীর রইলেন।
-বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোরও বাংলা নাম অবশ্যই আছে।
-তাহলে তো ডিকশনারী নিয়ে ঘুরতে হবে। যখনি আটকে যাব সার্চ দিয়ে বলে দেব।
বলেই জিভ কামড়ে ফেললাম, আবারও ভুল করে ফেলেছি।
-মানে অভিধান নিয়ে ঘুরব আরকি। মোবাইলে তো আছেই। অভিধানে খোঁজ দিলেই হবে।
মোবাইলের বাংলা বোধহয় মোবাইল ই। তাও কেমন দ্বিধা হল। তবে দুলাভাই কিছুটা সন্তুষ্ট। তিনি আমাদের কে অনেকটাই লাইনে আনতে পেরেছেন। এরপর দুলাভাই ভাষা বিষয়ক সমাপনী বক্তব্য দিয়ে উঠে গেলেন। আর আমি পিচ্চি দুটোকে নিয়ে বসে রইলাম। এখনো কারো নাম মনে পড়ছে না।
(৩)
-হাতে কিছু মালিশ করেছো?
-জ্বি।
-কি?
-মুভ ছিল। আপু মালিশ করে দিয়েছে।
-নীরা!
-জ্বি।
-আমি দুঃখিত।
আই এম সরি বলে যেমন ক্ষমা চাওয়ার একটা অনুভূতি আসে, আমি দুঃখিত বললে তা কেমন জানি আসে না। মনে হয় আবেগ নিয়ে বলছি না। শুধুমাত্র দায়সারা করে বলছি। এটার ঠিক উলটো হয় ভালবাসা প্রদর্শনের সময়। “I love u” বলায় সেই অনুভূতি নেই, যেমন অনুভূতি “আমি তোমাকে ভালবাসি” বলায় আছে। ভাষা ব্যবহারে অনুভূতির এসব জটিল সমীকরণের হিসেব বুঝিনা আমি। প্রায়ই ভাবি, কিন্তু সমাধান আসে না কোন।
-আমাকে ক্ষমা করিয়া দাও।
এ কথা শুনে নীরা হেসে দিল।
-আরে বোকা, শুদ্ধ বাংলা বলতে বলেছে। একেবারে সাধু বলতে বলেছে নাকি?
-ও হ্যাঁ। আচ্ছা, ক্ষমা করে দাও আমাকে প্লিজ!
-প্লিজ?
-আই মিন, দয়া করে।
-আই মিন?
-হুর! হবেনা আমাকে দিয়ে। আমি হতাশ!
এদিকে নীরার ডাক পড়েছে, নীরা চলে গেল। আমি একা একা বসে রইলাম। একটু পর আমারও ডাক পড়ল, ডাক শুনেই মনে হল আবার বোধহয় ভাষা বিষয়ক সেমিনার হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তার চেয়েও ভয়ানক। একটা ব্যানারে লিখা “শুদ্ধ উচ্চারণ প্রশিক্ষণ সভা”। সেটা সামনের রুমে টাঙানো হয়েছে। দুলাভাই বসে আছেন, তার সামনে আসন পেতে বসেছে পিচ্চি দুটো, পর্দার ওপাশে নীরা আর আপু।
আমিও গিয়ে বসলাম প্রশিক্ষণ সভায়। দুলাভাই সবাইকে বাংলা অক্ষর উচ্চারণ, এরপর শব্দ উচ্চারণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। আমার মনে হল এবার সত্যিই অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম। অনেক সুন্দর ভাবে প্রশিক্ষণ সভা শেষ করলাম। সভা শেষে পরীক্ষা হল। আমি সবচেয়ে কনফিডেন্ট ছিলাম। “এটা বাচ্চাদের খেল!” এরকম একটা ভাব নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। ফলাফল যখন দিল তখন আমার কনফিডেন্স হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, আমি লাস্ট হয়েছি, অর্থাৎ সর্বনিম্ন নম্বর পেয়েছি। দুলাভাই আমাকে নিয়ে বেশ খানিকটা টিটকিরি মেরে দিলেন।
-কি? তুমি না লেখক? তোমার এই ফলাফল খুবই হতাশাজনক!
আমি কটমট করতে করতে উঠে চলে এলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে নিজের বাংলা ভাষার স্কিল দেখানোর পণ করলাম। আই মিন, দক্ষতা।
(৪)
খাবার টেবিলে সবাই নিরবে খাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছেনা। কথা বললেই মনে হচ্ছে গ্রেফতার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এমন বৈরি পরিস্থিতিতে আমি কথা বলে উঠলাম।
-দুলাভাই, আপনার উদ্যোগ টা সত্যিই চমৎকার! অসাধারণ!
-হ্যাঁ।
প্রশংসা করলাম, ধন্যবাদ টাও পেলাম না। এবার বোধহয় তাহলে একটু সমালোচনা করতে হবে।
-কিন্তু একটা জিনিস ভাবেন, এমন অনেক অনেক ইংরেজি শব্দ আছে যার বাংলায় রিপ্লেসমেন্ট নেই। সেক্ষেত্রে কি হবে?
-রিপ্লেসমেন্ট শব্দের কিন্তু বাংলায় প্রতিস্থাপনযোগ্য শব্দ আছে।
এবং আমি প্রচণ্ড বেগে একটা বাঁশ খেয়ে গেলাম। দুলাভাই থাগ লাইফ লুক দিলেন। আমি লজ্জিত হয়েও লজ্জা লুকানোর ভান করলাম।
-জ্বি দুঃখিত। কিন্তু মনে করেন, কিছু শব্দ কে আসলেই প্রতিস্থাপন করা দুঃসাধ্য। যেমন ধরেন আজকাল ‘টেনশন’ শব্দটি অনেকটা বাংলা শব্দ হয়ে গেছে। আপনি যদি ‘দুঃশ্চিন্তা’ বলেন তখন বরং অদ্ভুত শোনাবে। কেউ একজন ‘ক্লাসে যাচ্ছি’ না বলে যখন বলে ‘শ্রেণীকক্ষে যাচ্ছি’ তখন হয়ত তাকে ধরে পিটুনি ই লাগিয়ে দেবে মানুষ। শিক্ষক ক্লাসে ‘লেকচার’ দিয়েছেন না বলে যদি বলি ‘বক্তব্য’ দিয়েছেন, তখন শিক্ষকের নামে কথা হয়ে যেতে পারে, এই শিক্ষক না পড়িয়ে কিসের বক্তব্য দেয়! ‘ড্রাইভার’, ‘কন্ট্রাক্টর’, ‘হেল্পার’, ‘লেভার’ এই শব্দগুলোকে যদি যথাক্রমে ‘চালক’, ‘ঠিকাদার’, ‘সহযোগী’ আর ‘শ্রমিক’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেয়া হয় আর সেসব যদি আপনি বলতে শুরু করেন, কেমন শোনাবে ভাবেন? এগুলো কিন্তু লিখার সময় বাংলায়ই লিখা হয়। শুধুমাত্র বলার সময় প্রচলিত শব্দটাই বলা হয়। কারণ তা না হলে আপনি এমন একজনের সাথে মতবিনিময় করতে পারবেন না যে হয়ত পড়াশোনা জানেনা। সে হয়ত জানেইনা কন্ট্রাক্টর শব্দটির অর্থ মূলত ঠিকাদার। আপনি ফার্নিচার দোকানে গিয়ে কেদারা কিনতে চাইলে মানুষ অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে ‘কারেন্ট বিল’ না দিয়ে ‘বিদ্যুৎ বিধেয়ক’ কোথায় দিব খুঁজতে থাকলে আপনিই হতাশ হবেন। আমি দুয়েকটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি তার মানে এই না যে আমি আমার মায়ের ভাষা ভালবাসি না। এটা করি যাতে আমি মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। তবে আমি তাদের অবশ্যই বিরোধিতা করি যারা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যারা মায়ের ভাষা বাংলার চেয়ে হিন্দি কিংবা ইংরেজি কে বেশি প্রাধান্য দেয়। আজকাল আপনি কোথাও চাকরি করতে যান, কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যান, আপনি যদি ইংরেজি না জানেন, ইংরেজিতে কমিউনিকেট করতে না পারেন, আপনাকে বের করে দেয়া হবে। আপনার চাকরি হবেনা, এটাই বাস্তবতা। সেইসব জায়গা গুলোতে পরিবর্তন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা স্নাতক পর্যায়ে যেকোন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মিডিয়াম পড়াশোনা যেখানে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। যে ছাত্র সারাদিন ইংরেজিতে পড়াশুনা করে, স্যারদের লেকচার শোনে, সে কি করে সম্পূর্ণ বাংলায় কমিউনিকেট করতে পারবে? এ দোষ তো তার না। এসব জায়গায় পরিবর্তন দরকার দুলাভাই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলাম আমি। সবাই ভাতের লোকমা হাতে নিয়ে বসে আছে, আর সবার মুখ হা করা। বহুদিন পর নিজের সুপারপাওয়ার প্রদর্শন করতে পেরে আনন্দ লাগছে। ভাইয়া খুব গভীরভাবে কি যেন ভাবলেন, তারপর চুপচাপ ভাত খেতে লাগলেন। খাবার টেবিলে আর দ্বিতীয় কোন কথা হল না।
রাতে নীরার হাতে মুভ লাগিয়ে দিলাম। হাতের কিছুটা জায়গা জখম হয়ে কাল হয়ে গেছে। এদিকে আমার মন খারাপ দেখে নীরা আমার মন ভাল করার চেষ্টায় বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। রোজ এই কাজটা আমি করি, যখন ও গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ও আমাকে একটা কথা প্রায়ই বলে, “তুমি আমার হাসির ডিব্বা। এই ডিব্বা একবার খুলে গেলে আমি আর না হেসে পারিনা”
সত্যিই এমন। আমার কাজই ছিল ওকে হাসানো, যখন দূরে ছিল তখনো, এখন যখন কাছে আছে এখনো। আমি কিন্তু বিনে পয়সায় কাজ করিনা। বিনিময়ে চাঁদের হাসি দেখি, একা বসে, পুরো পৃথিবী থেকে লুকিয়ে। ও যখন হাসে, মনে হয় এটাই জীবন, এইটুকুতেই জীবন। শুধু ও হাসতে থাকুক, ঘড়ি চলতে থাকুক, সময় এভাবেই চলে যাক। আজ হঠাৎ করে আমার হাসির ডিব্বায় হাসি ফুরিয়ে গেছে, এজন্য নীরা রিচার্জ করার চেষ্টা করছে। দেখে ভীষণ মায়া হল। ও যে মায়াবতী, মায়া না হয়ে যায় কোথায়? আমি ওকে বললাম, “নীরা, একটা ইংরেজি লাইনকে বাংলায় অনুবাদ করো তো!” নীরা অতি উৎসাহী হয়ে বলল, “বলো বলো!”
আমি বললাম, “Lets cuddle!”
নীরা এক সেকেন্ড ভাবল। যখন বুঝতে পারল তখন হাত মুষ্টি করে আমার বাহুতে ঘুষি মারল। আর আমি মনে মনে বললাম, “হে ইংরেজির Love, কিংবা বাংলার ভালবাসা, তুমি যে ই হও, কখনো ফুরিয়ে যেও না!”
(চলবে………)
বউনামা! পর্ব-০৮
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
5:55 PM
Rating:

No comments