বউনামা! পর্ব-০৭
#বউনামা_৭
(১)
নীরার প্রেগনেন্সির খবরের পর থেকে মায়ের ডাক্তারী প্রচণ্ড মাত্রা ধারণ করেছে। এখন তিনি রেগুলার নীরাকে হেলথ টিপস দিচ্ছেন। খাবারে বেশ পরিবর্তন এনেছেন, ভারী কোন কাজ করতে দিচ্ছেন না। ভাগ্য ভাল ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ এনেছিলাম, নাহয় মা-ই প্রেসক্রাইভ করতেন। মায়ের চিকিৎসাশাস্ত্রে এই অসাধারণ জ্ঞানের উৎস্য হচ্ছে টিভিতে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যবিধি অনুষ্ঠান। মা এসব অনুষ্ঠান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেন, সিরিয়ালের চেয়েও মনোযোগ দিয়ে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যা শিখেন তা এপ্লাই করেন বাস্তব জীবনে।
সেদিন আমাকে বলছিলেন, “জানিস, কালকে টিভিতে কি বলেছে?”
মা যখনি কথাটা বলেন, আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি উপদেশমূলক কিছু বলবেন।
“কি বলেছে?”
“দাঁড়িয়ে পানি খেতে নিষেধ করেছে ডাক্তার রা। এতে পাকস্থলীর ক্ষতি হয়”
“এটা তো ১৪০০ বছর আগে রাসূল(স) ই বলে গেছেন। এজন্যই বসে পানি খাওয়া সুন্নত”
মা আমার কথায় বেশ পূলকিত হলেন। কারণ আমি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মায়ের স্বাস্থ্যবিধি গুলোর খুঁত বের করি। এদিকে মায়ের অতিরিক্ত খাতিরযত্নে নীরার নিঃশ্বাস নেয়ার জো থাকছে না। ঘরের মধ্যেও মেহমান মেহমান বোধ হচ্ছে। মা এটা ওটা করতে নিষেধ করে, খেতে নিষেধ করে। কতশত রীতিনীতি, কতশত কুসংস্কার।
এদিকে নীরা একবারো বমি করেনি দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। সবসময় সিনেমায় দেখেছি গর্ভবতী হলেই মেয়েরা বমি করে। এমনকি কেউ গর্ভবতী কিনা এটা নির্ণয়ই করা হয় বমি করা দেখে। এক সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়িকাকে বমি করতে দেখেই তার বোন বুঝে ফেলে সে গর্ভবতী, এরপর তাকে বেধড়ক পেটায়। কিন্তু এমনও তো হতে পারত যে তার বদহজম হয়েছে! বাংলা সিনেমার লজিক আমি কখনোই বেশ একটা মিলিয়ে উঠতে পারিনি, তাই ওদিকে যাচ্ছি না।
এদিকে মায়ের চিন্তার অন্ত নেই, নীরা এ অবস্থায় কিভাবে ঢাকায় থাকবে, তাকে বাপের বাড়িতে থাকা দরকার, কিংবা এ বাড়ি। বাপের বাড়ি ই সুইটেবল, কারণ মেয়েরা নাকি প্রথম সন্তানের সময় বাপের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু নীরা প্রেগনেন্সীর জন্য অফিস থেকে সর্বোচ্চ ছ মাসের লিভ পাবে। এখন তো ঢাকা ফিরতেই হবে। এদিকে হুট করে বাড়ি চলে এসেছি অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে টেনশন একা সামলাতে পারছিলাম না বলে। ছুটিও তো শেষ। ঢাকায় ফিরতে হবে ভাবলেই মনে কেমন বিরক্তি ছেয়ে যায়। আবার সেই যান্ত্রিক জীবন, প্রচণ্ড গতিশীল অথচ নিরানন্দ। নীরারও ভাল লাগেনা, ও চায় এখানে কোথাও থাকতে। ওর গ্রাম প্রিয়, নদী প্রিয়, ছায়া প্রিয়, শহরে দম ঘুটে আসে নাকি। আমরা রোজ পরিকল্পনাও করি, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য। পরিকল্পনা পর্ব চলাকালীন নীরা খুব গম্ভীর থাকে, দেখেই বোঝা যায় কতটা সিরিয়াস। আর আমি হাসাহাসি করি, সিরিয়াসনেস বলতে কিছুই নেই। এটা ঠিক স্কুল জীবনের মডেল টেস্ট পরীক্ষা গুলোর মতন, মেয়েরা কত সিরিয়াস ভাবে পরীক্ষা দিত, আর আমরা ছেলেরা দুষ্টুমি করে বেড়াতাম। এমন সিরিয়াস পরিকল্পনা পর্বের মধ্যে নীরা হঠাৎ বলে উঠল,
“আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে, জানো?”
আমি রোজ সকালে উঠেই তারিখ দেখি। আজও দেখেছিলাম, ১৪ ফেব্রুয়ারী। কিন্তু তাও না জানার ভান করে বললাম,
-তাই নাকি? আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে?
-হুম।
আমি নীরার কথাটা সিন করে রেখে দিলাম, আই মিন হিয়ার করে রেখে দিলাম। ফেসবুকে কেউ আমাকে হুম পাঠালে আমি সিন করে রেখে দেই। এদিকে আমার উত্তর না পেয়ে নীরা আবার মুখ খুললো।
-কি হল? কিছু বলছনা যে?
-কি বলব?
-কিছু তো বল।
-আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।
-মানে?
-তুমি ই তো বললা কিছু বলতে।
আমার কথা শুনে নীরার মুখের বর্ণ আবার লিটমাসের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। আর আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে রাগ। আমি তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা সরূপ কান ধরে ফেললাম।
-সরি সরি সরি।
এবার নীরা সিন করে রেখে দিল। ছেলেরা রাগ করে মেসেজ সিন করে রেখে দিলে সেখানে মেয়েরা আর কিছু না বললেও ব্যাপার না। কিন্তু মেয়ে যদি রাগ করে মেসেজ সিন করে রেখে দেয়, আর এরপর তুমি আর কিছু না বল, তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে। ভাগ্য ভাল এই জিনিসটা আমি আগে ভাগেই জানতাম। তাই নতুন কনভারসেশন শুরু করতে চাইলাম।
-নীরু!
-হুঁ।
-একজন প্রেমিকের আবার ভ্যালেন্টাইন হয় নাকি? রোজ “ভালবাসি ভালবাসি” সুরের নেশায় যে ডুবে থাকে সে কি করে আজ নতুন করে মাতাল হবে বলতে পারো? আমি প্রেমিক, একজন প্রেমিকের ক্যালেন্ডারে কোন ভ্যালেন্টাইন নেই।
নীরা মুগ্ধের মত হয়ে শুনছে। এতে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। আমি দ্বিগুণ উদ্যমে আবার বলতে লাগলাম।
-প্রেমিকার চুলে ফুল গুঁজে দেয়ায় আমি প্রেম পাইনা, সে ফুল ছাড়িয়েও তো নেয়া যায়, অথচ আমি ভাবি তুমি ই ফুল, যার সুবাস আছে, আছে মায়া, কিন্তু খুবই কোমল, সহজেই দুমড়ে মুচড়ে যায়, তাই রাখতে হয় যত্ন করে, আমার কাছে প্রেম এটুকুই!
হঠাৎ নিজের কবি প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়ে হাততালি দিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। কিন্তু তা করলাম না, কারণ কমপ্লিমেন্ট শ্রোতা দিবে, বক্তা না। শ্রোতার মন্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি তার চোখের দিকে তাকিয়ে, এমন সময় কর্কশ একটা মন্তব্য শুনতে পেলাম।
“কবিতা শেষ হইলে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু রান্নাঘরের দিকে আয়”
তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন, কিছুটা অবাক হলাম। টিভিতে একটু রোমান্টিক সিন আসলেই সাথে সাথে চ্যানেল চেঞ্জ করার ধুম পড়ে যেত, আমরা ছোটরাও “বাথরুম চেপেছে” বলে ভান করে পালিয়ে যেতাম। অথচ আজ মা সম্পূর্ণ সিন টা পর্যবেক্ষণ করে ঠিক ক্লাইমেক্সে এসে একেবারে পানি ঢেলে দিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম, যাওয়ার সময় দেখলাম নীরা মুচকি মুচকি হাসছে।
(২)
-কি হয়েছে বলেন।
-শ্বশুর বাড়িতে যাবিনা তুই?
-কেন? আর ছুটিও তো নাই। কিভাবে যাব?
-বিয়ের পর প্রথমবার বাড়িতে আসছিস, তার উপর বউয়ের সুখবর। ও বাড়ি যাওয়ার দরকার না?
আমার আবারো স্মরণ হয়ে গেল ফর্মালিটি শব্দটার কথা। একাউন্টিং কোর্সে পড়েছিলাম টোটাল এসেট = টোটাল লায়েবেলিটি অর্থাৎ যাহাই সম্পদ তাহাই দায়। এখানেও সমান, যাহাই বিয়ে তাহাই ফর্মালিটি। বিয়েতে ফর্মালিটি বৈ আর কিছুই নেই।
-এখন কি তাহলে যেতে হবে?
-না যেয়ে উপায় নেই তো। মাইন্ড করবে তারা।
-ঠিক আছে। আমরা ও বাড়ি থেকে সরাসরি ঢাকা চলে যাব। বুঝেছেন?
মা আমার শেষের কথাটা আর কানে নিলেন না। ঠিক আছে কথাটা শুনেই চুলোয় চুঙ্গি দিয়ে ফু দিতে লাগলেন। আমিও উঠে চলে এলাম। এদিকে নীরা আয়নার সামনে বসে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুল আঁচড়ানো দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু চিরুনি তে লেগে থাকা চুল দেখলেই মেজাজ তিরিক্ষ্ণি হয়ে যায়।
-তোমাদের বাড়ি যাবে?
-চলো।
বলেই উচ্ছ্বল শিশুর মত লাফিয়ে উঠল নীরা। ঠিক ছোটবেলায় যেমন আমরা নানু বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলে লাফিয়ে উঠতাম তেমন। নীরার জন্য খারাপ লাগে খুব। অবশ্য নীরা না, প্রত্যেকটা মেয়ের জন্যই। যারা নিজেদের বাড়িকে পর করে পর বাড়ি কে আপন করে নেয়। মা তো প্রায় বছর অন্তর যায় নানুর বাড়ি, কখনো বা যাওয়াও হয় না। নীরার আগ্রহ দেখে আমিও রেডি হয়ে গেলাম। এদিকে ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতেই বাবার গম্ভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
এটা বাবার চিরকালের স্বভাব। মা কিন্তু ইতিমধ্যেই বাবাকে বলেছেন আমরা ও বাড়ি যাব, আর এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কিন্তু তাও বাবা জিজ্ঞেস করবেন নাটকীয় সুরে। আগেও এমন হত, চার-পাঁচদিন আগ থেকে মা কে দিয়ে বাবাকে বলিয়ে রাখা হত আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব। ঘুরতে যাওয়ার দিন শার্ট পরা, প্যান্ট পরা, চুল আঁচড়ানো পর্যন্তও বাবা চুপ। কিন্তু ঠিক যখনি জুতো পরে বাইরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতাম, তখনি বাবা প্রশ্ন করতেন স্লো মোশনে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
আর আমি মায়ের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, এখানে মায়ের কোন দোষ নেই, মা ঠিকই বলেছেন, এটা কেবলমাত্র বাবার একটু নাটকীয়তা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। বাবার প্রশ্নে আজ বহুদিন পর সেসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমি উত্তর দিতে যাব এর আগেই মা এসে আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিলেন।
“ছুটি নিয়ে আসছে প্রথমবার, ঐ বাড়ি যাওয়ার দরকার না একবার? এইজন্য পাঠাচ্ছি আমি”।
বাবা “আচ্ছা। আল্লাহ ভরসা” বলে চলে গেলেন। এরপর আমরা ও বের হয়ে গেলাম, নীরার ফর্মালিটির দুয়ার পেরিয়ে, আমার ফর্মালিটির দুয়ারের উদ্দেশ্যে।
(৩)
শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে কেমন শূন্য শূন্য লাগল। কারণ এখন ছুটির সময় না, সবাই স্কুল-কলেজ-অফিস নিয়ে ব্যস্ত, সবাই শহরে। গ্রামে আছে শুধু শ্বশুর আর শাশুড়ি। আগামী একটা দিন আমার জন্য অনেক কঠিন হবে বলে বোধ হল। এমনিতেই আমি সবসময় মুরুব্বীদের থেকে একটু পালিয়ে বেড়াই তার উপর সারাদিন যদি শ্বশুরের সাথে গল্প করতে হয়, তাহলে আমার অবস্থা কি হবে সেটা ভাবতেই পারছি না।
এদিকে আমরা আসায় শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই খুব খুশী হলেন, ইতিমধ্যে সুখবর ও পেয়েছেন, তাই খুশী টা দ্বিগুণ। শ্বশুর বাড়িতে সারাদিনে দুইটা আলাদা টিম ছিল। এক টিমে ছিল প্রচণ্ড কোলাহল, অর্থাৎ শ্বাশুড়ি আর নীরা গল্প করছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আর অন্য টিমে পিনপতন নীরবতা, মাঝেমাঝে দুয়েকটি কাশির শব্দ। এই টিমে আছি আমি আর আমার শ্বশুর। আমি কিছুক্ষণ একটা পেপার নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সব খবর পড়ে ফেলি, কখনো ফেসবুকে প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা আর্টিকেল মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলি, তাও কিছুতেই শ্বশুরের সাথে চোখ মেলাতে যাতে না হয়।
এদিকে তিনিও বেশ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন, ভালমত তাকাইনি বলে কি বই পড়ছেন সেটা দেখতে পারিনি। এরকম ভাবে পুরো দিন কেটে গেল। রাতে ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে আছি। নীরা এসে খাবারের জন্য ডাকল। আমি নীরা কে উত্তর দিতে গিয়ে মনে হল আমি আমার কণ্ঠ অনুভব করতে পারছিনা। অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার কারণে গলা বসে গেছে পুরোপুরি। খাবার টেবিলের অভিজ্ঞতা দিনের অভিজ্ঞতা থেকে আরো তিক্ত হল। কারণ দিনে দুয়েকটি কাশীর শব্দ ছিল শুধু, আর এখন যোগ হল, খাবার চিবানোর বিশ্রি শব্দ। আমি আমার বাবা আর শ্বশুরের মধ্যে বেশ কিছু মিল খুঁজে পেয়েছি। খাবার বিশ্রি শব্দ করে চিবানো তার একটি। আমার মনের মধ্যে প্রতিবাদী স্বত্তা জেগে উঠল, আমিও খাবার বিশ্রি শব্দ করে চিবাতে লাগলাম। শ্বশুর আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন, মনে মনে আমাকে হয়ত গেঁয়ো ভেবে বসলেন। কিন্তু তিনিও যে এমন শব্দ করে খান সেটা তিনি আদৌ বুঝতে পারেন না। মানুষ নিজের অভ্যাস গুলো নিজে কখনই ধরতে পারেনা। যাহোক, খাবার খাওয়া শেষ করে আমি রুমে চলে এলাম। শ্বশুর মশাই প্লেট টানছেন, দেখে মায়া হল, ইচ্ছে হল আমিও তাকে সাহায্য করি, কিন্তু আমি তো আর অন্দরমহলে যাব না। তাই মায়া দাবিয়ে রাখলাম। আর খাটে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের কি কি বদ অভ্যাস আছে সেগুলো নির্ণয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম।
(৪)
নীরা তার সই অর্থাৎ আমার শ্বাশুড়ীর সাথে গল্প পর্ব সেরে এল। আমি অপেক্ষা করছিলাম নীরার জন্য। ঘুমানোর আগে আমাদের রোমান্টিসিজম পর্ব। গত তিনমাস ধরেই চলছে এটা। নীরা এসেই আদুরে গলায় বলল, “কি? ঘুমাননি এখনো?”
আমি সাথে সাথে উঠে বসলাম। নীরা ভাববে আমি রোমান্টিক কিছু বলব। কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য প্রশ্ন ঘুরছিল।
-আচ্ছা নীরা, আমার বাজে অভ্যাস কি কি?
-মানে?
-মানে এই যে ধরো আমার বাবার অভ্যাস হচ্ছে বিশ্রি শব্দ করে খাওয়া, সোজা করে কোন কথা না বলা। আবার তোমার বাবার অভ্যাস হচ্ছে কথা পুরো শেষ না করেই মুখে ভাত পুরে দেয়া। এরকম আমার কি কোন বদ অভ্যাস আছে?
নীরা রাগে তেঁতে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
-আছে। তোমার সবচেয়ে বড় বদ অভ্যাস হচ্ছে মানুষের ভুল ত্রুটি খুঁজে বের করা।
বলেই নীরা আমার উলটো দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল। আজ রোমান্টিসিজম পর্বের ইতি মনে হচ্ছে। আমি তাও হাল ছাড়লাম না।
-নীরু! শোনোনা।
নীরা এবার আমার দিকে ফিরল, একেবারে উঠেই বসল। কেমন একটা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা আমাকে একটা সত্যি করে কথা বলোতো, নীরু নামে তোমার কি কখনো কোন প্রেমিকা ছিল?”
নীরার প্রশ্ন শুনে আমি থ মেরে গেলাম। বউকে আজকাল আদর করে ডাকলেও সন্দেহ করে, আসলেই কলি যুগ এসে গেছে। আমি রাগ করার চেহারা বানালাম।
“আচ্ছা সরি” নীরা সাথে সাথে গলে গিয়ে বলল। ওর এই দিকটা ভীষণ পছন্দ আমার। যতই রেগে থাকুক, আমি একটু কষ্ট পেলেই সাথে সাথে গলে যায়। রোমান্টিসিজম পর্ব শুরু হবে হবে এর মধ্যেই আমার মনে আরেকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেল। আর প্রশ্ন টা করার সাথে সাথে নীরা তার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল, এবার আর কোন উপায়ন্তর না দেখে আমিও শুয়ে পড়লাম। প্রশ্ন টা ছিল, “এই তোমার কি বমি হয়েছিল একবারো?”
(চলবে………)
(১)
নীরার প্রেগনেন্সির খবরের পর থেকে মায়ের ডাক্তারী প্রচণ্ড মাত্রা ধারণ করেছে। এখন তিনি রেগুলার নীরাকে হেলথ টিপস দিচ্ছেন। খাবারে বেশ পরিবর্তন এনেছেন, ভারী কোন কাজ করতে দিচ্ছেন না। ভাগ্য ভাল ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ এনেছিলাম, নাহয় মা-ই প্রেসক্রাইভ করতেন। মায়ের চিকিৎসাশাস্ত্রে এই অসাধারণ জ্ঞানের উৎস্য হচ্ছে টিভিতে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যবিধি অনুষ্ঠান। মা এসব অনুষ্ঠান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেন, সিরিয়ালের চেয়েও মনোযোগ দিয়ে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যা শিখেন তা এপ্লাই করেন বাস্তব জীবনে।
সেদিন আমাকে বলছিলেন, “জানিস, কালকে টিভিতে কি বলেছে?”
মা যখনি কথাটা বলেন, আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি উপদেশমূলক কিছু বলবেন।
“কি বলেছে?”
“দাঁড়িয়ে পানি খেতে নিষেধ করেছে ডাক্তার রা। এতে পাকস্থলীর ক্ষতি হয়”
“এটা তো ১৪০০ বছর আগে রাসূল(স) ই বলে গেছেন। এজন্যই বসে পানি খাওয়া সুন্নত”
মা আমার কথায় বেশ পূলকিত হলেন। কারণ আমি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মায়ের স্বাস্থ্যবিধি গুলোর খুঁত বের করি। এদিকে মায়ের অতিরিক্ত খাতিরযত্নে নীরার নিঃশ্বাস নেয়ার জো থাকছে না। ঘরের মধ্যেও মেহমান মেহমান বোধ হচ্ছে। মা এটা ওটা করতে নিষেধ করে, খেতে নিষেধ করে। কতশত রীতিনীতি, কতশত কুসংস্কার।
এদিকে নীরা একবারো বমি করেনি দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। সবসময় সিনেমায় দেখেছি গর্ভবতী হলেই মেয়েরা বমি করে। এমনকি কেউ গর্ভবতী কিনা এটা নির্ণয়ই করা হয় বমি করা দেখে। এক সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়িকাকে বমি করতে দেখেই তার বোন বুঝে ফেলে সে গর্ভবতী, এরপর তাকে বেধড়ক পেটায়। কিন্তু এমনও তো হতে পারত যে তার বদহজম হয়েছে! বাংলা সিনেমার লজিক আমি কখনোই বেশ একটা মিলিয়ে উঠতে পারিনি, তাই ওদিকে যাচ্ছি না।
এদিকে মায়ের চিন্তার অন্ত নেই, নীরা এ অবস্থায় কিভাবে ঢাকায় থাকবে, তাকে বাপের বাড়িতে থাকা দরকার, কিংবা এ বাড়ি। বাপের বাড়ি ই সুইটেবল, কারণ মেয়েরা নাকি প্রথম সন্তানের সময় বাপের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু নীরা প্রেগনেন্সীর জন্য অফিস থেকে সর্বোচ্চ ছ মাসের লিভ পাবে। এখন তো ঢাকা ফিরতেই হবে। এদিকে হুট করে বাড়ি চলে এসেছি অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে টেনশন একা সামলাতে পারছিলাম না বলে। ছুটিও তো শেষ। ঢাকায় ফিরতে হবে ভাবলেই মনে কেমন বিরক্তি ছেয়ে যায়। আবার সেই যান্ত্রিক জীবন, প্রচণ্ড গতিশীল অথচ নিরানন্দ। নীরারও ভাল লাগেনা, ও চায় এখানে কোথাও থাকতে। ওর গ্রাম প্রিয়, নদী প্রিয়, ছায়া প্রিয়, শহরে দম ঘুটে আসে নাকি। আমরা রোজ পরিকল্পনাও করি, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য। পরিকল্পনা পর্ব চলাকালীন নীরা খুব গম্ভীর থাকে, দেখেই বোঝা যায় কতটা সিরিয়াস। আর আমি হাসাহাসি করি, সিরিয়াসনেস বলতে কিছুই নেই। এটা ঠিক স্কুল জীবনের মডেল টেস্ট পরীক্ষা গুলোর মতন, মেয়েরা কত সিরিয়াস ভাবে পরীক্ষা দিত, আর আমরা ছেলেরা দুষ্টুমি করে বেড়াতাম। এমন সিরিয়াস পরিকল্পনা পর্বের মধ্যে নীরা হঠাৎ বলে উঠল,
“আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে, জানো?”
আমি রোজ সকালে উঠেই তারিখ দেখি। আজও দেখেছিলাম, ১৪ ফেব্রুয়ারী। কিন্তু তাও না জানার ভান করে বললাম,
-তাই নাকি? আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে?
-হুম।
আমি নীরার কথাটা সিন করে রেখে দিলাম, আই মিন হিয়ার করে রেখে দিলাম। ফেসবুকে কেউ আমাকে হুম পাঠালে আমি সিন করে রেখে দেই। এদিকে আমার উত্তর না পেয়ে নীরা আবার মুখ খুললো।
-কি হল? কিছু বলছনা যে?
-কি বলব?
-কিছু তো বল।
-আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।
-মানে?
-তুমি ই তো বললা কিছু বলতে।
আমার কথা শুনে নীরার মুখের বর্ণ আবার লিটমাসের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। আর আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে রাগ। আমি তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা সরূপ কান ধরে ফেললাম।
-সরি সরি সরি।
এবার নীরা সিন করে রেখে দিল। ছেলেরা রাগ করে মেসেজ সিন করে রেখে দিলে সেখানে মেয়েরা আর কিছু না বললেও ব্যাপার না। কিন্তু মেয়ে যদি রাগ করে মেসেজ সিন করে রেখে দেয়, আর এরপর তুমি আর কিছু না বল, তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে। ভাগ্য ভাল এই জিনিসটা আমি আগে ভাগেই জানতাম। তাই নতুন কনভারসেশন শুরু করতে চাইলাম।
-নীরু!
-হুঁ।
-একজন প্রেমিকের আবার ভ্যালেন্টাইন হয় নাকি? রোজ “ভালবাসি ভালবাসি” সুরের নেশায় যে ডুবে থাকে সে কি করে আজ নতুন করে মাতাল হবে বলতে পারো? আমি প্রেমিক, একজন প্রেমিকের ক্যালেন্ডারে কোন ভ্যালেন্টাইন নেই।
নীরা মুগ্ধের মত হয়ে শুনছে। এতে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। আমি দ্বিগুণ উদ্যমে আবার বলতে লাগলাম।
-প্রেমিকার চুলে ফুল গুঁজে দেয়ায় আমি প্রেম পাইনা, সে ফুল ছাড়িয়েও তো নেয়া যায়, অথচ আমি ভাবি তুমি ই ফুল, যার সুবাস আছে, আছে মায়া, কিন্তু খুবই কোমল, সহজেই দুমড়ে মুচড়ে যায়, তাই রাখতে হয় যত্ন করে, আমার কাছে প্রেম এটুকুই!
হঠাৎ নিজের কবি প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়ে হাততালি দিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। কিন্তু তা করলাম না, কারণ কমপ্লিমেন্ট শ্রোতা দিবে, বক্তা না। শ্রোতার মন্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি তার চোখের দিকে তাকিয়ে, এমন সময় কর্কশ একটা মন্তব্য শুনতে পেলাম।
“কবিতা শেষ হইলে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু রান্নাঘরের দিকে আয়”
তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন, কিছুটা অবাক হলাম। টিভিতে একটু রোমান্টিক সিন আসলেই সাথে সাথে চ্যানেল চেঞ্জ করার ধুম পড়ে যেত, আমরা ছোটরাও “বাথরুম চেপেছে” বলে ভান করে পালিয়ে যেতাম। অথচ আজ মা সম্পূর্ণ সিন টা পর্যবেক্ষণ করে ঠিক ক্লাইমেক্সে এসে একেবারে পানি ঢেলে দিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম, যাওয়ার সময় দেখলাম নীরা মুচকি মুচকি হাসছে।
(২)
-কি হয়েছে বলেন।
-শ্বশুর বাড়িতে যাবিনা তুই?
-কেন? আর ছুটিও তো নাই। কিভাবে যাব?
-বিয়ের পর প্রথমবার বাড়িতে আসছিস, তার উপর বউয়ের সুখবর। ও বাড়ি যাওয়ার দরকার না?
আমার আবারো স্মরণ হয়ে গেল ফর্মালিটি শব্দটার কথা। একাউন্টিং কোর্সে পড়েছিলাম টোটাল এসেট = টোটাল লায়েবেলিটি অর্থাৎ যাহাই সম্পদ তাহাই দায়। এখানেও সমান, যাহাই বিয়ে তাহাই ফর্মালিটি। বিয়েতে ফর্মালিটি বৈ আর কিছুই নেই।
-এখন কি তাহলে যেতে হবে?
-না যেয়ে উপায় নেই তো। মাইন্ড করবে তারা।
-ঠিক আছে। আমরা ও বাড়ি থেকে সরাসরি ঢাকা চলে যাব। বুঝেছেন?
মা আমার শেষের কথাটা আর কানে নিলেন না। ঠিক আছে কথাটা শুনেই চুলোয় চুঙ্গি দিয়ে ফু দিতে লাগলেন। আমিও উঠে চলে এলাম। এদিকে নীরা আয়নার সামনে বসে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুল আঁচড়ানো দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু চিরুনি তে লেগে থাকা চুল দেখলেই মেজাজ তিরিক্ষ্ণি হয়ে যায়।
-তোমাদের বাড়ি যাবে?
-চলো।
বলেই উচ্ছ্বল শিশুর মত লাফিয়ে উঠল নীরা। ঠিক ছোটবেলায় যেমন আমরা নানু বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলে লাফিয়ে উঠতাম তেমন। নীরার জন্য খারাপ লাগে খুব। অবশ্য নীরা না, প্রত্যেকটা মেয়ের জন্যই। যারা নিজেদের বাড়িকে পর করে পর বাড়ি কে আপন করে নেয়। মা তো প্রায় বছর অন্তর যায় নানুর বাড়ি, কখনো বা যাওয়াও হয় না। নীরার আগ্রহ দেখে আমিও রেডি হয়ে গেলাম। এদিকে ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতেই বাবার গম্ভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
এটা বাবার চিরকালের স্বভাব। মা কিন্তু ইতিমধ্যেই বাবাকে বলেছেন আমরা ও বাড়ি যাব, আর এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কিন্তু তাও বাবা জিজ্ঞেস করবেন নাটকীয় সুরে। আগেও এমন হত, চার-পাঁচদিন আগ থেকে মা কে দিয়ে বাবাকে বলিয়ে রাখা হত আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব। ঘুরতে যাওয়ার দিন শার্ট পরা, প্যান্ট পরা, চুল আঁচড়ানো পর্যন্তও বাবা চুপ। কিন্তু ঠিক যখনি জুতো পরে বাইরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতাম, তখনি বাবা প্রশ্ন করতেন স্লো মোশনে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
আর আমি মায়ের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, এখানে মায়ের কোন দোষ নেই, মা ঠিকই বলেছেন, এটা কেবলমাত্র বাবার একটু নাটকীয়তা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। বাবার প্রশ্নে আজ বহুদিন পর সেসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমি উত্তর দিতে যাব এর আগেই মা এসে আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিলেন।
“ছুটি নিয়ে আসছে প্রথমবার, ঐ বাড়ি যাওয়ার দরকার না একবার? এইজন্য পাঠাচ্ছি আমি”।
বাবা “আচ্ছা। আল্লাহ ভরসা” বলে চলে গেলেন। এরপর আমরা ও বের হয়ে গেলাম, নীরার ফর্মালিটির দুয়ার পেরিয়ে, আমার ফর্মালিটির দুয়ারের উদ্দেশ্যে।
(৩)
শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে কেমন শূন্য শূন্য লাগল। কারণ এখন ছুটির সময় না, সবাই স্কুল-কলেজ-অফিস নিয়ে ব্যস্ত, সবাই শহরে। গ্রামে আছে শুধু শ্বশুর আর শাশুড়ি। আগামী একটা দিন আমার জন্য অনেক কঠিন হবে বলে বোধ হল। এমনিতেই আমি সবসময় মুরুব্বীদের থেকে একটু পালিয়ে বেড়াই তার উপর সারাদিন যদি শ্বশুরের সাথে গল্প করতে হয়, তাহলে আমার অবস্থা কি হবে সেটা ভাবতেই পারছি না।
এদিকে আমরা আসায় শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই খুব খুশী হলেন, ইতিমধ্যে সুখবর ও পেয়েছেন, তাই খুশী টা দ্বিগুণ। শ্বশুর বাড়িতে সারাদিনে দুইটা আলাদা টিম ছিল। এক টিমে ছিল প্রচণ্ড কোলাহল, অর্থাৎ শ্বাশুড়ি আর নীরা গল্প করছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আর অন্য টিমে পিনপতন নীরবতা, মাঝেমাঝে দুয়েকটি কাশির শব্দ। এই টিমে আছি আমি আর আমার শ্বশুর। আমি কিছুক্ষণ একটা পেপার নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সব খবর পড়ে ফেলি, কখনো ফেসবুকে প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা আর্টিকেল মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলি, তাও কিছুতেই শ্বশুরের সাথে চোখ মেলাতে যাতে না হয়।
এদিকে তিনিও বেশ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন, ভালমত তাকাইনি বলে কি বই পড়ছেন সেটা দেখতে পারিনি। এরকম ভাবে পুরো দিন কেটে গেল। রাতে ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে আছি। নীরা এসে খাবারের জন্য ডাকল। আমি নীরা কে উত্তর দিতে গিয়ে মনে হল আমি আমার কণ্ঠ অনুভব করতে পারছিনা। অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার কারণে গলা বসে গেছে পুরোপুরি। খাবার টেবিলের অভিজ্ঞতা দিনের অভিজ্ঞতা থেকে আরো তিক্ত হল। কারণ দিনে দুয়েকটি কাশীর শব্দ ছিল শুধু, আর এখন যোগ হল, খাবার চিবানোর বিশ্রি শব্দ। আমি আমার বাবা আর শ্বশুরের মধ্যে বেশ কিছু মিল খুঁজে পেয়েছি। খাবার বিশ্রি শব্দ করে চিবানো তার একটি। আমার মনের মধ্যে প্রতিবাদী স্বত্তা জেগে উঠল, আমিও খাবার বিশ্রি শব্দ করে চিবাতে লাগলাম। শ্বশুর আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন, মনে মনে আমাকে হয়ত গেঁয়ো ভেবে বসলেন। কিন্তু তিনিও যে এমন শব্দ করে খান সেটা তিনি আদৌ বুঝতে পারেন না। মানুষ নিজের অভ্যাস গুলো নিজে কখনই ধরতে পারেনা। যাহোক, খাবার খাওয়া শেষ করে আমি রুমে চলে এলাম। শ্বশুর মশাই প্লেট টানছেন, দেখে মায়া হল, ইচ্ছে হল আমিও তাকে সাহায্য করি, কিন্তু আমি তো আর অন্দরমহলে যাব না। তাই মায়া দাবিয়ে রাখলাম। আর খাটে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের কি কি বদ অভ্যাস আছে সেগুলো নির্ণয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম।
(৪)
নীরা তার সই অর্থাৎ আমার শ্বাশুড়ীর সাথে গল্প পর্ব সেরে এল। আমি অপেক্ষা করছিলাম নীরার জন্য। ঘুমানোর আগে আমাদের রোমান্টিসিজম পর্ব। গত তিনমাস ধরেই চলছে এটা। নীরা এসেই আদুরে গলায় বলল, “কি? ঘুমাননি এখনো?”
আমি সাথে সাথে উঠে বসলাম। নীরা ভাববে আমি রোমান্টিক কিছু বলব। কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য প্রশ্ন ঘুরছিল।
-আচ্ছা নীরা, আমার বাজে অভ্যাস কি কি?
-মানে?
-মানে এই যে ধরো আমার বাবার অভ্যাস হচ্ছে বিশ্রি শব্দ করে খাওয়া, সোজা করে কোন কথা না বলা। আবার তোমার বাবার অভ্যাস হচ্ছে কথা পুরো শেষ না করেই মুখে ভাত পুরে দেয়া। এরকম আমার কি কোন বদ অভ্যাস আছে?
নীরা রাগে তেঁতে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
-আছে। তোমার সবচেয়ে বড় বদ অভ্যাস হচ্ছে মানুষের ভুল ত্রুটি খুঁজে বের করা।
বলেই নীরা আমার উলটো দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল। আজ রোমান্টিসিজম পর্বের ইতি মনে হচ্ছে। আমি তাও হাল ছাড়লাম না।
-নীরু! শোনোনা।
নীরা এবার আমার দিকে ফিরল, একেবারে উঠেই বসল। কেমন একটা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা আমাকে একটা সত্যি করে কথা বলোতো, নীরু নামে তোমার কি কখনো কোন প্রেমিকা ছিল?”
নীরার প্রশ্ন শুনে আমি থ মেরে গেলাম। বউকে আজকাল আদর করে ডাকলেও সন্দেহ করে, আসলেই কলি যুগ এসে গেছে। আমি রাগ করার চেহারা বানালাম।
“আচ্ছা সরি” নীরা সাথে সাথে গলে গিয়ে বলল। ওর এই দিকটা ভীষণ পছন্দ আমার। যতই রেগে থাকুক, আমি একটু কষ্ট পেলেই সাথে সাথে গলে যায়। রোমান্টিসিজম পর্ব শুরু হবে হবে এর মধ্যেই আমার মনে আরেকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেল। আর প্রশ্ন টা করার সাথে সাথে নীরা তার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল, এবার আর কোন উপায়ন্তর না দেখে আমিও শুয়ে পড়লাম। প্রশ্ন টা ছিল, “এই তোমার কি বমি হয়েছিল একবারো?”
(চলবে………)
বউনামা! পর্ব-০৭
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
5:54 PM
Rating:

No comments