বউনামা! পর্ব-০৫
#বউনামা_৫
(১)
মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। রাতে খাওয়ার সময় ও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু ছোটভাই ডেকে নিয়ে এল। বাবা ডেকেছেন, আলাদা আলাদা করে খাওয়া তিনি পছন্দ করেন না, সবাই একসাথে খেলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আজ একসাথে বসে খাওয়া মানে হচ্ছে আমার কনডেম সেল তৈরি করে ফেলা, তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম কিন্তু অবশেষে আর বাঁচতে পারলাম না। আজও খাবার টেবিলে বাবা সভাপতিত্ব করছেন, মা আজ প্রতিদিনের মত খাবার পরিবেশন করছেন না। আজ নীরা সে দায়িত্ব নিয়েছে, কারণ সে এখন আমাদের পরিবারেরই অংশ। বাবা গলা খাঁকারি দিলেন, বুঝতে পারলাম তিনি কিছু বলবেন।
-এখন তোর সিদ্ধান্ত কি?
-কোন বিষয়ে?
-ঢাকায় কোথায় উঠবি, কি করবি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
-জ্বি। বাসা ঠিক করেছি একটা দু’রুমের। আমার অফিসের পাশেই। ভাল বাসা।
শেষের কথাটা বলে আমি নিজেই থ মেরে গেলাম। ছোটভাই মাথা নামিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এখনকার মডার্ণ ছেলেমেয়েরাও যদি এসব সস্তা বিষয়ে হাসে তাহলে একেবারেই অড লাগে। এখনকার ছেলেমেয়েদের সেন্স অফ হিউমার হবে অনেক উঁচু। তারা গম্ভীর থাকবে, খুবই উঁচুমানের কোন কৌতুক না হলে হাসবেনা। আর এরকম কথায় হাসবে বাচ্চারা, তাই ছোটভাইকে বেশ করে চোখ রাঙিয়ে দিলাম। মা অবাক বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর ধারণা ছিলনা যে আমি এর মধ্যে একটা বাসাও ঠিক করে ফেলতে পারি।
-এখন জিনিসপত্র কেনাকাটা, ঘর-দুয়ার রেডি করা এসব কাজকর্ম ও তো আছে। কবে যাবি ভাবছিস?
-আমি ভাবছিলাম কাল বা পরশু চলে যাই। জিনিসপত্র কিছু তো আগের বাসাটায় আছে, আর কিছু নতুন কিনতে হবে।
মাঝখান থেকে মা বললেন, “তো বউ যেয়ে কি করবে এখন? তুই সব রেডি টেডি করে আয়, তারপর নাহয় বউ যাবে”।
-রেডি করা আর বিশেষ কি? দুটো লোক হলেই হয়ে যাবে।
আমরা এতসব আলোচনা করছি এর মধ্যে নীরা একটি শব্দও করছে না। চুপচাপ সবকিছু শুনে যাচ্ছে। আমার মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে হয় জানতে, ঠিক এই মূহুর্তে ও কি ভাবছে? অনেকেই নাকি চেহারা দেখে ভাবনা পড়তে পারে, আমি কেন পারিনা? পারলে খুব ভাল হত, এখন নীরার মতামত টা ওর চেহারা দেখেই জেনে নিতাম।
সভা শেষে সিদ্ধান্ত হল, আমরা পরশু সকালে ভোরে ভোরে রওয়ানা হচ্ছি। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম, বিয়ের ঝামেলা বোধহয় এবার সম্পূর্ণরূপে শেষ হতে যাচ্ছে। সভাশেষে লক্ষ্য করলাম, আমাকে কোন বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। অর্থাৎ নীরা কোন মামলা দায়ের করেনি, নিজের মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে বোধহয় সব। আমার খুব ভয় হয়, মনের মধ্যে জমানো এ ক্ষোভগুলোর একদিন খুব বড় বিস্ফোরণ ঘটবে না তো?
(২)
খাওয়া শেষে রুমে গিয়েই খাটের বাম পাশে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নীরা এসে খাটে বসল। ওকে দেখে মনে হল, ও কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই। তাই ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
-আসিফ!
নীরার কোমল কণ্ঠ। এমনিতেই এই কণ্ঠটা একটা মায়া, তার উপর অধিক কোমলত্ব আনায় সেটা আরো বেশি বিশেষ শোনাচ্ছে। আমি সস্নেহে বলে উঠলাম, “জ্বি”
মাথা ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি নীরার চোখভর্তি পানি। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার এই মূহুর্তে ঠিক কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে নীরা কেঁদেই চলেছে। আমি ওর হাত চেপে ধরলাম।
-নীরা! কি হয়েছে? কেন কাঁদছো। বলোনা।
-আসিফ! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি খুব বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।
এই কথাটি বলতে গিয়ে নীরার নিঃশ্বাস আটকে আটকে যাচ্ছিল। মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট গুলো হঠাত বের হতে থাকলে বোধহয় এমন হয়। অথচ আমি ভেবেছিলাম ওর মনে ক্ষোভ জমে আছে, কতটা বোকা আমি! ও বোধহয় ধরে নিয়েছে ওর আচরণে আমি কষ্ট পেয়েছি, তাই আজকে ওভাবে চলে এলাম, আবার আজকে পুরোদিন পালিয়ে বেড়ালাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটার প্রেম, নিজেকে তুচ্ছ লাগল ওর সামনে। আমি ভাবতাম আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রেমিক যে তার প্রেয়সীকে সর্বস্ব দিয়ে ভালবেসেছে। কিন্তু চারদিক থেকে হিসেব মিলিয়ে নিজের ভালবাসা পরিমাপ করতে গিয়ে দেখি ফলাফল শূন্য। বিয়ের পর থেকে শুধু কষ্টই দিয়ে এসেছি ওকে। প্রতিটা মূহুর্তে আঘাত দিয়েছি, ফেলেছি কতশত বিপদে, লজ্জায়। ভাবতেই আমার চোখও কান্নায় ভরে এল।
-তুমি কেন ক্ষমা চাইছো? ক্ষমা তো আমি চাইব। আমি প্রত্যেকবার কোন না কোন গণ্ডগোল পাকিয়েছি, তোমাকে শুধু কাঁদিয়েছি।
আমার কান্না দেখে নীরার কান্না থেমে গেল। হঠাৎ হঠাৎ প্রয়োজনবোধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলার অসীম এক ক্ষমতা আছে মেয়েটার। ও আমাকে শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল।
-তুমি তো একটা বোকা ছেলে। এতটা সরল, পুরাই বাচ্চা। আমার বোঝা উচিত ছিল, এই বাচ্চাটাকে সামলে রাখা উচিত ছিল।
ছোটবেলায় একটা নিয়ম ছিল আমাদের কে কেউ আদর করে কান্না থামানোর চেষ্টা করলে আমাদের কান্না দ্বিগুণ হয়ে যেত। হয়ত কোনদিন মা মেরেছে। সেদিন বাবা আসার সাথে সাথে কান্না জুড়ে দিতাম। বাবা যখন আদর করে জিজ্ঞেস করতো, “কি হয়েছে মনা?” তখন সাথে সাথে কান্না দ্বিগুন হয়ে যেত। এখন নীরার আদরে আমার কান্না দ্বিগুন হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু নীরা একটা সতর্কবার্তা দিয়ে আমার কান্না থামিয়ে দিল। “কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে পাগল টা?”
এই কথার সাথে সাথে আমার কান্না এমন ভাবে থেমে গেল যেন একশো কিলোমিটার স্পিডে আসা একটা গাড়ি, সামনে একটা খোঁড়া লোককে পার হতে দেখে হার্ড ব্রেক কষল। যেকোন ধরণের হার্ডব্রেক ই ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকর। আমি নিজেও আমার বুকের মধ্যে একটা কেমন ব্যাথা অনুভব করলাম অর্থাৎ এই হার্ডব্রেক ইঞ্জিন নিতে পারেনি।
এদিকে নীরা শাড়ির আচল দিয়ে আমার চোখ মুছে দিল, আমি ওর কোলে মাথা রাখলাম। নীরা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। এ প্রথম আমি নীরার হাতের স্পর্শ পেলাম। এটা আমাদের প্রেমের প্রথম স্পর্শ বোধহয়। প্রথম স্পর্শ অন্যরকম, আপনি এই অনুভূতি টাকে কোন শব্দে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। অবশ্য এর আগে একবার আবেগে চুমু দিয়ে ফেয়েছিলাম ওর কপালে। ফুপি দেখে যাওয়ায় নার্ভাসনেসে রোমান্সের বারোটা বেজে গিয়েছিল। আজ সম্পূর্ণ বাধাহীন। আমি প্রায় হারিয়েই গেছিলাম স্পর্শের অনুভূতিতে, সম্বিত ফিরল দরজায় করাঘাতের শব্দে। এবারো পণ্ড করার জন্য কেউ না কেউ এসে হাজির হয়েছে। নীরা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল, মা কয়েল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা দেখেই আমার মেজাজ তিরিক্ষ্মি হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম,
-আমাদের এখানে মশারি আছে মা। আবার কয়েল কেন আমি এটাই বুঝিনা।
-মশারির ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে যায় মশা, কয়েল দিচ্ছি, মরে পড়ে থাকবে।
-কয়েলে আমার দমবন্ধ হয়ে যায়।
-তাইলে তুই দশ মিনিট রুমের বাইরে যা। মশা সব আগে মরুক, তারপর আসিস।
এবং সত্যি সত্যিই তাই হল। আমাকে রুমের বাইরে গিয়ে দশমিনিট অপেক্ষা করতে হল মশা দমন কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত। যতক্ষণ ভেতরে মশা দমন কর্মসূচি চলল, ততক্ষণ আমি বাইরে দাঁড়িয়ে বহিরাগত মশাদের আন্দোলনের সম্মুখীন হলাম। ভেতরে তাদের সজাতিদের কয়েলের ধোঁয়ায় হত্যা করা হচ্ছে এটা তারা কিছুতেই বরদাশত করতে পারছেনা। এজন্য তারা আমি, যে কিনা এই কর্মকাণ্ডের সাথে বিন্দুমাত্র ও জড়িত নই, সেই নিরীহ লোককে আক্রমণ করছে। এদিকে আমিও নিরাপত্তার জন্য হাত চালালাম এদিক ওদিক, এতে কেবল ঠাস ঠাস করে নিজের গায়েই আঘাত লাগল, মশাদের একটা লোম ও বাঁকা করতে পারলাম না। এবং তারই সাথে সাথে এই দশমিনিটে আমার রোমান্টিক মুড বদলে গেল চরম বিরক্তিতে।
সেই বিরক্তি চড়ানো মুখ নিয়েই ফিরলাম রুমে, মা বোধহয় খেয়াল করলেন না, তবে নীরা খেয়াল করল। খাটে উঠেই অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লাম সোজা হয়ে, যদিও প্রতিদিন আমি পা দুটো ভাজ করে ডানকাত হয়ে ঘুমাই। আজ একেবারে টানটান সোজা হয়ে বামপাশ ফিরে শুয়ে আছি। নীরা আস্তে আস্তে শব্দ করে হাসতে লাগল, আর আমার চুল টানতে লাগল। এতে আমার রাগরাগ ভাবটা কিছুটা কমল। রাতে প্রথমবারের মত কোলবালিশের বদলে বউকে জড়িয়ে ঘুমালাম। বউকে জড়িয়ে ঘুমানো আর কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমানোয় আকাশ পাতাল তফাত। এতদিন ভাবতাম, দুটোই বুঝি সমান। কিন্তু আজ সে ধারণা বদলে গেল। বউকে জড়িয়ে ঘুমানোয় একটা আলাদা এডভেঞ্চার আছে। এডভেঞ্চার তো পেলাম ই, পাশাপাশি ফ্যানের বাতাস ও পেলাম।
(৩)
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল নীরার ডাকে। মনে মনে ভাবলাম, যাক কিছু অন্তত পরিবর্তন এসেছে। আগে মায়ের চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙত, আজকে নীরার ডাকে ভাঙল।
-আসিফ! ওঠো। ঝামেলা হয়ে গেছে!
আমি শুরুতে শুধু আসিফ শুনেছিলাম। এখন দেখি শেষে ‘ঝামেলা হয়ে গেছে’ কথাটাও আছে। ক্লাসে ঘুমুতে গিয়ে ধরা খেয়ে শিক্ষকের কান মলা খেয়ে যেমন ঘুম থেকে উঠতাম তেমন ধড়ফড় করে উঠে বসে গেলাম।
-কি হয়েছে?
-আমি নুডুলসে লবণের বদলে চিনি দিয়ে দিয়েছি।
-তুমি নুডুলস বানাচ্ছো? মা কোথায়?
-আজ মা কে বলেছি নাস্তা আমি বানাব। মা ও রাজি হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। আর আমি গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছি।
-কিভাবে হল এটা? চিনি তো দানা দানা, লবণ তো একদম গুড়ো, তাও বুঝোনি?
-আমি চামচ দিয়ে দিয়েছি, খেয়াল করিনি।
-ওগুলো ফেলে দাও। নতুন করে বানাও।
-মা রান্না হয়েছে দেখেই সাথে সাথে বাটিতে ঢেলে বাবার জন্য নিয়ে গেছেন, নাফিসকেও দিয়ে এসেছে।
-তুমি তখন জানতা না? বলোনি মা কে?
-জানতাম না তো। আমি আর টেস্ট করেও দেখিনি। এখন টেস্ট করে দেখি একদম মিষ্টি।
-বেশি মিষ্টি হয়ে গেছে?
-হুম।
নীরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভ্রু কুঁচকে আছে, কাঁদো কাঁদো চেহারা। বেচারি আজ প্রথমবার কিছু একটা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। বাবা-মা কে ইম্প্রেস করার প্রথম চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। আমি তাড়াহুড়া করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম।
-তুমি আমার নুডুলসের প্লেট টা তাড়াতাড়ি দাও।
-কেন?
-দিতে বললাম দাও না।
আমি নীরা থেকে প্লেট নিয়ে তাড়াতাড়ি বাবার রুমে গেলাম। বাবা মাত্র নুডুলসের বাটি হাতে নিয়েছেন। এদিকে আমার ব্রাশ করাও হয়নি, তাও মুখের মধ্যে এক চামচ পুরে দিয়ে বললাম,
-উমম, মিষ্টি নুডুলস, নতুন আইটেম। আজকাল খুব চলে ঢাকায়।
বাবা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। আমার কথার আগা মাথা বুঝতে পারছেন না। বাবা বোধহয় আজকাল ভাবছেন আমার মেন্টাল প্রব্লেম দেখা দিয়েছে। এরপর এক চামচ মুখে দিয়েই ঘটনা বুঝে গেলেন। চিবুতে চিবুতে আমার দিকে তাকালেন।
-বলেছিলাম না? মিষ্টি নুডুলস। টেস্টি না বাবা? ঢাকাতে খুব চলে।
আমি মিথ্যে হাসিহাসি মুখ বজায় রাখতে রাখতে বাবাকে বললাম। আমি বারবার ‘ঢাকাতে খুব চলে’ কথাটা বলছি কারণ ঢাকা সম্পর্কে বাবার ধারণা খুব কম। তাই আমি তাকে ভুংভাং বুঝিয়ে দিতে চাইলাম। বাবাকে দেখলাম বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন। মুখে আরেক চামচ দিতে দেখেই আমি কেটে পড়লাম। তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে দেখি নীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এদিকে ছোটভায়ের টেবিলে নুডুলস পড়ে আছে, সে বোধহয় ফ্রেশ হতে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর থেকে নুডুলসের বাটিটা নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। কেমন একটা চোর চোর মনে হল নিজেকে। তাও নিজেকে শান্ত্বনা দিলাম, যাই করছি ভালবাসার মানুষের জন্য করছি।
-এখানে তাড়াতাড়ি লবণ দাও।
-মিষ্টি আর কড়া মিলে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। একেবারে খাওয়ার অযোগ্য। আসিফ! আমি আসলেই একটা অকর্মা মেয়ে। আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা। জানিনা বাবা কি ভাবছেন।
বলেই নীরা মুখ টা বিষন্ন করে বসে রইল। বাস্তব জীবনে চন্দ্রগ্রহণ বোধহয় এটাই। আস্তে আস্তে আমার চাঁদের মুখ টা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কিন্তু অমাবস্যা এসেছে বলে কি পূর্ণিমার আশা করা ভুলে যাব। আমি নীরাকে অভয় দিলাম।
-আরে বাবাকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। বলেছি এটা মিষ্টি নুডুলস, ঢাকায় খুব চলে, বাবা খাচ্ছে ও দেখলাম।
আমি নীরা কে শান্ত্বনা বাক্য শোনাচ্ছি, এমন সময় বাবা জোরে চিৎকার করে মা কে ডাক দিলেন। আমি ঢোক গিললাম। বোধহয় মা কে জেরা করছেন এই নুডুলস কে রেঁধেছে, কেন এভাবে রেঁধেছে এসব বিষয়ে। নীরা আর নিজেকে সামলাতে পারল না, কেঁদেই দিল। আমি ঠিক কিভাবে ওকে শান্ত্বনা দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর এক্ষেত্রে শান্ত্বনায় চিড়ে ভিজবে না, তাই পদক্ষেপ নিলাম।
-চলো, আবার রান্না করি। কতক্ষণ ই বা লাগবে।
বলেই দুজনে মিলে আবার রান্না চড়ালাম, এবার খুব সূক্ষ্মভাবে মনোযোগ দিয়ে রান্না করলাম। লবণের বয়ামে যেটা আছে সেটা লবণ কিনা তা তিনবার পরীক্ষা করলাম। আশেপাশে রসায়নের ল্যাব থাকলে সোডিয়াম ক্লোরাইডের রাসায়নিক পরীক্ষাও করে ফেলতাম। যাহোক রান্না শেষে আবার সবাইকে ডেকে বেশ খাতিরযত্ন করে পরিবেশন করলাম। সবাই এবার নীরার রান্নার খুব প্রশংসা করল। সেটা ফর্মালিটি হিসেবেই হোক, আর সত্যি করেই হোক। সবার প্রশংসার পরও নীরার মুখে পূর্ণ হাসি ফুটল না। বোধহয় ওর একজনের কমপ্লিমেন্টের অপেক্ষা ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে কলে গিয়ে দুটো কুলি করে এসে এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়েই তৃপ্তি সহকারে টাক দিলাম। হাত দিয়ে দারুণ দেখালাম, মুখে বললাম “বেস্ট!” এবার নীরা পূর্ণ হাসি দিল। আহা, কেমন মুক্তোঝরা হাসি। এ হাসির জন্য তো আমি ঐ অখাদ্য মিষ্টি নুডুলস ও পুরো পাতিল এক নিমিষে খেয়ে ফেলতে পারি।
খাওয়া পর্ব শেষ করে আমি রুমে বসে আছি। কাল কিভাবে কিভাবে সব সামলাবো সেটাই ভাবছি। হুট করে ঢাকায় গিয়ে নতুন বাসা, সব গোছগাছ, অনেক বেশী ঝামেলা অপেক্ষা করছে কাল। এসব ভাবছি এর মধ্যে নীরা এসে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। নীরা মুচকি মুচকি হাসছে। ঐ হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না আমি। আমি ক্যাবলাকান্তের মত চেয়ে রইলাম। নীরা আমার কাছে এসে দাঁড়াল। কতটা কাছে ঠিক বলতে পারব না, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম আমাদের মাঝে সব দূরত্ব ঘুচে গেছে। নীরা আমাকে প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরল। আমাকে ঠিক কি করতে হত জানিনা, সম্মোহিত হয়ে গেছিলাম! আমিও ওকে ঠিক তেমনি আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। নীরা আমার কানে কানে বলল, “অনেক ভালবাসি আসিফ!” আমার চোখ দিয়ে একফোটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, প্রথমবারের মত এই বোকা ছেলেটাকে কেউ ভালবেসেছে! আমি আজীবন অকূল সমুদ্রে সাতরে বেড়িয়েছি, আজ মনে হল একটা কূল পেলাম। আজীবন যেই নামটি হৃদয়ের ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে লিখে বেড়িয়েছি, আজ সে নাম বুকে ধারণ করেছি। যে সুরে আজীবন মাতাল হয়েছি, সে সুরে আজ আমায় নিয়ে গান হয়েছে। যে ভালবাসা ছিল একতরফা, আজ সেটা পূর্ণতা পেয়েছে। বহুবছর পর আজ অনুপম যেন বলতে পারল, “এইতো জায়গা পেয়েছি!”
(চলবে……)
(১)
মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। রাতে খাওয়ার সময় ও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু ছোটভাই ডেকে নিয়ে এল। বাবা ডেকেছেন, আলাদা আলাদা করে খাওয়া তিনি পছন্দ করেন না, সবাই একসাথে খেলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। কিন্তু আজ একসাথে বসে খাওয়া মানে হচ্ছে আমার কনডেম সেল তৈরি করে ফেলা, তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম কিন্তু অবশেষে আর বাঁচতে পারলাম না। আজও খাবার টেবিলে বাবা সভাপতিত্ব করছেন, মা আজ প্রতিদিনের মত খাবার পরিবেশন করছেন না। আজ নীরা সে দায়িত্ব নিয়েছে, কারণ সে এখন আমাদের পরিবারেরই অংশ। বাবা গলা খাঁকারি দিলেন, বুঝতে পারলাম তিনি কিছু বলবেন।
-এখন তোর সিদ্ধান্ত কি?
-কোন বিষয়ে?
-ঢাকায় কোথায় উঠবি, কি করবি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
-জ্বি। বাসা ঠিক করেছি একটা দু’রুমের। আমার অফিসের পাশেই। ভাল বাসা।
শেষের কথাটা বলে আমি নিজেই থ মেরে গেলাম। ছোটভাই মাথা নামিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এখনকার মডার্ণ ছেলেমেয়েরাও যদি এসব সস্তা বিষয়ে হাসে তাহলে একেবারেই অড লাগে। এখনকার ছেলেমেয়েদের সেন্স অফ হিউমার হবে অনেক উঁচু। তারা গম্ভীর থাকবে, খুবই উঁচুমানের কোন কৌতুক না হলে হাসবেনা। আর এরকম কথায় হাসবে বাচ্চারা, তাই ছোটভাইকে বেশ করে চোখ রাঙিয়ে দিলাম। মা অবাক বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর ধারণা ছিলনা যে আমি এর মধ্যে একটা বাসাও ঠিক করে ফেলতে পারি।
-এখন জিনিসপত্র কেনাকাটা, ঘর-দুয়ার রেডি করা এসব কাজকর্ম ও তো আছে। কবে যাবি ভাবছিস?
-আমি ভাবছিলাম কাল বা পরশু চলে যাই। জিনিসপত্র কিছু তো আগের বাসাটায় আছে, আর কিছু নতুন কিনতে হবে।
মাঝখান থেকে মা বললেন, “তো বউ যেয়ে কি করবে এখন? তুই সব রেডি টেডি করে আয়, তারপর নাহয় বউ যাবে”।
-রেডি করা আর বিশেষ কি? দুটো লোক হলেই হয়ে যাবে।
আমরা এতসব আলোচনা করছি এর মধ্যে নীরা একটি শব্দও করছে না। চুপচাপ সবকিছু শুনে যাচ্ছে। আমার মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে হয় জানতে, ঠিক এই মূহুর্তে ও কি ভাবছে? অনেকেই নাকি চেহারা দেখে ভাবনা পড়তে পারে, আমি কেন পারিনা? পারলে খুব ভাল হত, এখন নীরার মতামত টা ওর চেহারা দেখেই জেনে নিতাম।
সভা শেষে সিদ্ধান্ত হল, আমরা পরশু সকালে ভোরে ভোরে রওয়ানা হচ্ছি। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম, বিয়ের ঝামেলা বোধহয় এবার সম্পূর্ণরূপে শেষ হতে যাচ্ছে। সভাশেষে লক্ষ্য করলাম, আমাকে কোন বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। অর্থাৎ নীরা কোন মামলা দায়ের করেনি, নিজের মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে বোধহয় সব। আমার খুব ভয় হয়, মনের মধ্যে জমানো এ ক্ষোভগুলোর একদিন খুব বড় বিস্ফোরণ ঘটবে না তো?
(২)
খাওয়া শেষে রুমে গিয়েই খাটের বাম পাশে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নীরা এসে খাটে বসল। ওকে দেখে মনে হল, ও কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই। তাই ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
-আসিফ!
নীরার কোমল কণ্ঠ। এমনিতেই এই কণ্ঠটা একটা মায়া, তার উপর অধিক কোমলত্ব আনায় সেটা আরো বেশি বিশেষ শোনাচ্ছে। আমি সস্নেহে বলে উঠলাম, “জ্বি”
মাথা ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি নীরার চোখভর্তি পানি। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার এই মূহুর্তে ঠিক কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে নীরা কেঁদেই চলেছে। আমি ওর হাত চেপে ধরলাম।
-নীরা! কি হয়েছে? কেন কাঁদছো। বলোনা।
-আসিফ! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি খুব বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।
এই কথাটি বলতে গিয়ে নীরার নিঃশ্বাস আটকে আটকে যাচ্ছিল। মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট গুলো হঠাত বের হতে থাকলে বোধহয় এমন হয়। অথচ আমি ভেবেছিলাম ওর মনে ক্ষোভ জমে আছে, কতটা বোকা আমি! ও বোধহয় ধরে নিয়েছে ওর আচরণে আমি কষ্ট পেয়েছি, তাই আজকে ওভাবে চলে এলাম, আবার আজকে পুরোদিন পালিয়ে বেড়ালাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটার প্রেম, নিজেকে তুচ্ছ লাগল ওর সামনে। আমি ভাবতাম আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রেমিক যে তার প্রেয়সীকে সর্বস্ব দিয়ে ভালবেসেছে। কিন্তু চারদিক থেকে হিসেব মিলিয়ে নিজের ভালবাসা পরিমাপ করতে গিয়ে দেখি ফলাফল শূন্য। বিয়ের পর থেকে শুধু কষ্টই দিয়ে এসেছি ওকে। প্রতিটা মূহুর্তে আঘাত দিয়েছি, ফেলেছি কতশত বিপদে, লজ্জায়। ভাবতেই আমার চোখও কান্নায় ভরে এল।
-তুমি কেন ক্ষমা চাইছো? ক্ষমা তো আমি চাইব। আমি প্রত্যেকবার কোন না কোন গণ্ডগোল পাকিয়েছি, তোমাকে শুধু কাঁদিয়েছি।
আমার কান্না দেখে নীরার কান্না থেমে গেল। হঠাৎ হঠাৎ প্রয়োজনবোধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলার অসীম এক ক্ষমতা আছে মেয়েটার। ও আমাকে শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল।
-তুমি তো একটা বোকা ছেলে। এতটা সরল, পুরাই বাচ্চা। আমার বোঝা উচিত ছিল, এই বাচ্চাটাকে সামলে রাখা উচিত ছিল।
ছোটবেলায় একটা নিয়ম ছিল আমাদের কে কেউ আদর করে কান্না থামানোর চেষ্টা করলে আমাদের কান্না দ্বিগুণ হয়ে যেত। হয়ত কোনদিন মা মেরেছে। সেদিন বাবা আসার সাথে সাথে কান্না জুড়ে দিতাম। বাবা যখন আদর করে জিজ্ঞেস করতো, “কি হয়েছে মনা?” তখন সাথে সাথে কান্না দ্বিগুন হয়ে যেত। এখন নীরার আদরে আমার কান্না দ্বিগুন হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু নীরা একটা সতর্কবার্তা দিয়ে আমার কান্না থামিয়ে দিল। “কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে পাগল টা?”
এই কথার সাথে সাথে আমার কান্না এমন ভাবে থেমে গেল যেন একশো কিলোমিটার স্পিডে আসা একটা গাড়ি, সামনে একটা খোঁড়া লোককে পার হতে দেখে হার্ড ব্রেক কষল। যেকোন ধরণের হার্ডব্রেক ই ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকর। আমি নিজেও আমার বুকের মধ্যে একটা কেমন ব্যাথা অনুভব করলাম অর্থাৎ এই হার্ডব্রেক ইঞ্জিন নিতে পারেনি।
এদিকে নীরা শাড়ির আচল দিয়ে আমার চোখ মুছে দিল, আমি ওর কোলে মাথা রাখলাম। নীরা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। এ প্রথম আমি নীরার হাতের স্পর্শ পেলাম। এটা আমাদের প্রেমের প্রথম স্পর্শ বোধহয়। প্রথম স্পর্শ অন্যরকম, আপনি এই অনুভূতি টাকে কোন শব্দে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। অবশ্য এর আগে একবার আবেগে চুমু দিয়ে ফেয়েছিলাম ওর কপালে। ফুপি দেখে যাওয়ায় নার্ভাসনেসে রোমান্সের বারোটা বেজে গিয়েছিল। আজ সম্পূর্ণ বাধাহীন। আমি প্রায় হারিয়েই গেছিলাম স্পর্শের অনুভূতিতে, সম্বিত ফিরল দরজায় করাঘাতের শব্দে। এবারো পণ্ড করার জন্য কেউ না কেউ এসে হাজির হয়েছে। নীরা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল, মা কয়েল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা দেখেই আমার মেজাজ তিরিক্ষ্মি হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম,
-আমাদের এখানে মশারি আছে মা। আবার কয়েল কেন আমি এটাই বুঝিনা।
-মশারির ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে যায় মশা, কয়েল দিচ্ছি, মরে পড়ে থাকবে।
-কয়েলে আমার দমবন্ধ হয়ে যায়।
-তাইলে তুই দশ মিনিট রুমের বাইরে যা। মশা সব আগে মরুক, তারপর আসিস।
এবং সত্যি সত্যিই তাই হল। আমাকে রুমের বাইরে গিয়ে দশমিনিট অপেক্ষা করতে হল মশা দমন কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত। যতক্ষণ ভেতরে মশা দমন কর্মসূচি চলল, ততক্ষণ আমি বাইরে দাঁড়িয়ে বহিরাগত মশাদের আন্দোলনের সম্মুখীন হলাম। ভেতরে তাদের সজাতিদের কয়েলের ধোঁয়ায় হত্যা করা হচ্ছে এটা তারা কিছুতেই বরদাশত করতে পারছেনা। এজন্য তারা আমি, যে কিনা এই কর্মকাণ্ডের সাথে বিন্দুমাত্র ও জড়িত নই, সেই নিরীহ লোককে আক্রমণ করছে। এদিকে আমিও নিরাপত্তার জন্য হাত চালালাম এদিক ওদিক, এতে কেবল ঠাস ঠাস করে নিজের গায়েই আঘাত লাগল, মশাদের একটা লোম ও বাঁকা করতে পারলাম না। এবং তারই সাথে সাথে এই দশমিনিটে আমার রোমান্টিক মুড বদলে গেল চরম বিরক্তিতে।
সেই বিরক্তি চড়ানো মুখ নিয়েই ফিরলাম রুমে, মা বোধহয় খেয়াল করলেন না, তবে নীরা খেয়াল করল। খাটে উঠেই অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লাম সোজা হয়ে, যদিও প্রতিদিন আমি পা দুটো ভাজ করে ডানকাত হয়ে ঘুমাই। আজ একেবারে টানটান সোজা হয়ে বামপাশ ফিরে শুয়ে আছি। নীরা আস্তে আস্তে শব্দ করে হাসতে লাগল, আর আমার চুল টানতে লাগল। এতে আমার রাগরাগ ভাবটা কিছুটা কমল। রাতে প্রথমবারের মত কোলবালিশের বদলে বউকে জড়িয়ে ঘুমালাম। বউকে জড়িয়ে ঘুমানো আর কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমানোয় আকাশ পাতাল তফাত। এতদিন ভাবতাম, দুটোই বুঝি সমান। কিন্তু আজ সে ধারণা বদলে গেল। বউকে জড়িয়ে ঘুমানোয় একটা আলাদা এডভেঞ্চার আছে। এডভেঞ্চার তো পেলাম ই, পাশাপাশি ফ্যানের বাতাস ও পেলাম।
(৩)
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল নীরার ডাকে। মনে মনে ভাবলাম, যাক কিছু অন্তত পরিবর্তন এসেছে। আগে মায়ের চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙত, আজকে নীরার ডাকে ভাঙল।
-আসিফ! ওঠো। ঝামেলা হয়ে গেছে!
আমি শুরুতে শুধু আসিফ শুনেছিলাম। এখন দেখি শেষে ‘ঝামেলা হয়ে গেছে’ কথাটাও আছে। ক্লাসে ঘুমুতে গিয়ে ধরা খেয়ে শিক্ষকের কান মলা খেয়ে যেমন ঘুম থেকে উঠতাম তেমন ধড়ফড় করে উঠে বসে গেলাম।
-কি হয়েছে?
-আমি নুডুলসে লবণের বদলে চিনি দিয়ে দিয়েছি।
-তুমি নুডুলস বানাচ্ছো? মা কোথায়?
-আজ মা কে বলেছি নাস্তা আমি বানাব। মা ও রাজি হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। আর আমি গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছি।
-কিভাবে হল এটা? চিনি তো দানা দানা, লবণ তো একদম গুড়ো, তাও বুঝোনি?
-আমি চামচ দিয়ে দিয়েছি, খেয়াল করিনি।
-ওগুলো ফেলে দাও। নতুন করে বানাও।
-মা রান্না হয়েছে দেখেই সাথে সাথে বাটিতে ঢেলে বাবার জন্য নিয়ে গেছেন, নাফিসকেও দিয়ে এসেছে।
-তুমি তখন জানতা না? বলোনি মা কে?
-জানতাম না তো। আমি আর টেস্ট করেও দেখিনি। এখন টেস্ট করে দেখি একদম মিষ্টি।
-বেশি মিষ্টি হয়ে গেছে?
-হুম।
নীরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভ্রু কুঁচকে আছে, কাঁদো কাঁদো চেহারা। বেচারি আজ প্রথমবার কিছু একটা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। বাবা-মা কে ইম্প্রেস করার প্রথম চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। আমি তাড়াহুড়া করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম।
-তুমি আমার নুডুলসের প্লেট টা তাড়াতাড়ি দাও।
-কেন?
-দিতে বললাম দাও না।
আমি নীরা থেকে প্লেট নিয়ে তাড়াতাড়ি বাবার রুমে গেলাম। বাবা মাত্র নুডুলসের বাটি হাতে নিয়েছেন। এদিকে আমার ব্রাশ করাও হয়নি, তাও মুখের মধ্যে এক চামচ পুরে দিয়ে বললাম,
-উমম, মিষ্টি নুডুলস, নতুন আইটেম। আজকাল খুব চলে ঢাকায়।
বাবা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। আমার কথার আগা মাথা বুঝতে পারছেন না। বাবা বোধহয় আজকাল ভাবছেন আমার মেন্টাল প্রব্লেম দেখা দিয়েছে। এরপর এক চামচ মুখে দিয়েই ঘটনা বুঝে গেলেন। চিবুতে চিবুতে আমার দিকে তাকালেন।
-বলেছিলাম না? মিষ্টি নুডুলস। টেস্টি না বাবা? ঢাকাতে খুব চলে।
আমি মিথ্যে হাসিহাসি মুখ বজায় রাখতে রাখতে বাবাকে বললাম। আমি বারবার ‘ঢাকাতে খুব চলে’ কথাটা বলছি কারণ ঢাকা সম্পর্কে বাবার ধারণা খুব কম। তাই আমি তাকে ভুংভাং বুঝিয়ে দিতে চাইলাম। বাবাকে দেখলাম বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন। মুখে আরেক চামচ দিতে দেখেই আমি কেটে পড়লাম। তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে দেখি নীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এদিকে ছোটভায়ের টেবিলে নুডুলস পড়ে আছে, সে বোধহয় ফ্রেশ হতে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর থেকে নুডুলসের বাটিটা নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। কেমন একটা চোর চোর মনে হল নিজেকে। তাও নিজেকে শান্ত্বনা দিলাম, যাই করছি ভালবাসার মানুষের জন্য করছি।
-এখানে তাড়াতাড়ি লবণ দাও।
-মিষ্টি আর কড়া মিলে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। একেবারে খাওয়ার অযোগ্য। আসিফ! আমি আসলেই একটা অকর্মা মেয়ে। আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা। জানিনা বাবা কি ভাবছেন।
বলেই নীরা মুখ টা বিষন্ন করে বসে রইল। বাস্তব জীবনে চন্দ্রগ্রহণ বোধহয় এটাই। আস্তে আস্তে আমার চাঁদের মুখ টা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কিন্তু অমাবস্যা এসেছে বলে কি পূর্ণিমার আশা করা ভুলে যাব। আমি নীরাকে অভয় দিলাম।
-আরে বাবাকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। বলেছি এটা মিষ্টি নুডুলস, ঢাকায় খুব চলে, বাবা খাচ্ছে ও দেখলাম।
আমি নীরা কে শান্ত্বনা বাক্য শোনাচ্ছি, এমন সময় বাবা জোরে চিৎকার করে মা কে ডাক দিলেন। আমি ঢোক গিললাম। বোধহয় মা কে জেরা করছেন এই নুডুলস কে রেঁধেছে, কেন এভাবে রেঁধেছে এসব বিষয়ে। নীরা আর নিজেকে সামলাতে পারল না, কেঁদেই দিল। আমি ঠিক কিভাবে ওকে শান্ত্বনা দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর এক্ষেত্রে শান্ত্বনায় চিড়ে ভিজবে না, তাই পদক্ষেপ নিলাম।
-চলো, আবার রান্না করি। কতক্ষণ ই বা লাগবে।
বলেই দুজনে মিলে আবার রান্না চড়ালাম, এবার খুব সূক্ষ্মভাবে মনোযোগ দিয়ে রান্না করলাম। লবণের বয়ামে যেটা আছে সেটা লবণ কিনা তা তিনবার পরীক্ষা করলাম। আশেপাশে রসায়নের ল্যাব থাকলে সোডিয়াম ক্লোরাইডের রাসায়নিক পরীক্ষাও করে ফেলতাম। যাহোক রান্না শেষে আবার সবাইকে ডেকে বেশ খাতিরযত্ন করে পরিবেশন করলাম। সবাই এবার নীরার রান্নার খুব প্রশংসা করল। সেটা ফর্মালিটি হিসেবেই হোক, আর সত্যি করেই হোক। সবার প্রশংসার পরও নীরার মুখে পূর্ণ হাসি ফুটল না। বোধহয় ওর একজনের কমপ্লিমেন্টের অপেক্ষা ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে কলে গিয়ে দুটো কুলি করে এসে এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়েই তৃপ্তি সহকারে টাক দিলাম। হাত দিয়ে দারুণ দেখালাম, মুখে বললাম “বেস্ট!” এবার নীরা পূর্ণ হাসি দিল। আহা, কেমন মুক্তোঝরা হাসি। এ হাসির জন্য তো আমি ঐ অখাদ্য মিষ্টি নুডুলস ও পুরো পাতিল এক নিমিষে খেয়ে ফেলতে পারি।
খাওয়া পর্ব শেষ করে আমি রুমে বসে আছি। কাল কিভাবে কিভাবে সব সামলাবো সেটাই ভাবছি। হুট করে ঢাকায় গিয়ে নতুন বাসা, সব গোছগাছ, অনেক বেশী ঝামেলা অপেক্ষা করছে কাল। এসব ভাবছি এর মধ্যে নীরা এসে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। নীরা মুচকি মুচকি হাসছে। ঐ হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না আমি। আমি ক্যাবলাকান্তের মত চেয়ে রইলাম। নীরা আমার কাছে এসে দাঁড়াল। কতটা কাছে ঠিক বলতে পারব না, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম আমাদের মাঝে সব দূরত্ব ঘুচে গেছে। নীরা আমাকে প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরল। আমাকে ঠিক কি করতে হত জানিনা, সম্মোহিত হয়ে গেছিলাম! আমিও ওকে ঠিক তেমনি আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। নীরা আমার কানে কানে বলল, “অনেক ভালবাসি আসিফ!” আমার চোখ দিয়ে একফোটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, প্রথমবারের মত এই বোকা ছেলেটাকে কেউ ভালবেসেছে! আমি আজীবন অকূল সমুদ্রে সাতরে বেড়িয়েছি, আজ মনে হল একটা কূল পেলাম। আজীবন যেই নামটি হৃদয়ের ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে লিখে বেড়িয়েছি, আজ সে নাম বুকে ধারণ করেছি। যে সুরে আজীবন মাতাল হয়েছি, সে সুরে আজ আমায় নিয়ে গান হয়েছে। যে ভালবাসা ছিল একতরফা, আজ সেটা পূর্ণতা পেয়েছে। বহুবছর পর আজ অনুপম যেন বলতে পারল, “এইতো জায়গা পেয়েছি!”
(চলবে……)
বউনামা! পর্ব-০৫
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
5:51 PM
Rating:

No comments