বউনামা! পর্ব-০৬

#বউনামা_৬

(১)
বিয়ের পর প্রায় তিনমাস পেরিয়ে গেছে। আজ আমি আর নীরা এসেছি হাসপাতালে। আপনাদের ধারণাই সত্য, প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্টের জন্যই এসেছি। অথচ এক সময় আমি ভাবতাম, জীবনটা বাংলা সিনেমার মত, জসীম কাজ করে বাড়ি ফিরলে শাবানা জসীমের কানে কানে বলে তার পরীক্ষায় পাস করার কথা অর্থাৎ শাবানা প্রেগনেন্ট। এই কথা শুনে জসীম শাবানাকে কোলে উঠিয়ে কয়েক পাক ঘুরিয়ে বমি আসবে আসবে এমন সময়ই নামিয়ে দেয় আর দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যাকেই পায়, তাকেই ধরে বলে “আমি বাবা হতে চলেছি!” উল্লাস করতে করতে মিষ্টি দোকান থেকে মিষ্টি কিনে রাস্তায় সবাইকে বিলাতে বিলাতে ঘরে এসে মিষ্টিই ফুরিয়ে যায়, শুধু ঝোল রয়ে যায়, সেগুলো বোধহয় সকাল বেলায় পাউরুটির সাথে খাওয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়।
অর্থাৎ বাবা হওয়া এক অতি আনন্দের ব্যাপার, যেটা স্বামীর জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে রাখা হয়। আর এদিকে আমি আমার বউয়ের প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্টের জন্য নিজে এসে বসে আছি, এবং রিপোর্ট টা বোধহয় আমাকেই পড়তে হবে। নীরা কিছুক্ষণ পরপর আমার হাত চেপে ধরছে টেনশনে, যেন একটু পরেই তার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।
-এত ভয় পাচ্ছ কেন?
-কি রিপোর্ট আসে না আসে। খুব ভয় লাগছে।
-আরে এটা তো এইচএসসি পরীক্ষা না, এখানে ফেল করলে আবারো পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে।
নীরা আমার বাহুতে ছোট্ট করে একটা ঘুষি মারল, এরপর হাসতে লাগল, আমিও হাসতে শুরু করলাম। এদিকে হঠাৎ দেখি রিপোর্ট এসে হাজির। মূহুর্তেই দুজনের হাসি মিলিয়ে গেল, আমি অনুভব করলাম, আমিও কিছুটা ভয় পাচ্ছি। মনের মধ্যে একই সাথে এক হাজার লাইনের একটা প্রোগ্রাম রান হতে লাগল, যেখানে অসংখ্য শর্ত। বলা যায় শত শত নেস্টেড ইফ-এলস অর্থাৎ কয়েক শত যদি সংক্রান্ত প্রশ্ন। যদি পজিটিভ না হয়? কি হবে? এসব ভাবতে ভাবতে রিপোর্ট কার্ড আমার হাতে চলে এল। এবার আমার কাছে রিপোর্ট কার্ড টা সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার মার্কশীটের মত মনে হতে লাগল। মার্কশীট কে আমরা আমলনামা বলতাম। আমলনামা হাতে পেলেই গুণতাম কয়টা ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেয়া যাবে, কখনো কখনো দেখা যেত ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ নেই, আজকেও সেই ভয়টা কাজ করছে। যদি দেখি কোন ইম্প্রুভমেন্ট দেয়ার সুযোগ নেই! এসব ভাবছি এর মধ্যেই টিভিতে মারজুক রাসেলের সেই বিজ্ঞাপন চলে এল কোত্থেকে, “বাচ্চা হবেনা, বাচ্চা হবেনা, বাচ্চা হবেনা” এক সময় যে বিজ্ঞাপনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তাম, আজকে সেই বিজ্ঞাপন দেখে টিভি টা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এমনি ই ভয়ে শেষ, তার উপর এসব।
আল্লাহর নাম করে রিপোর্ট কার্ড খুলে দেখি রেজাল্ট পজিটিভ। আমাকে আর পায় কে? “ইয়েস!” বলে চিৎকার দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জনপ্রিয় গোল উদযাপনের মত করেই অনেকটা উদযাপন করে ফেললাম। হাসপাতালে যারা ওয়েটিং রুমে ছিল সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, নিজের সুপারপাওয়ার আবার স্মরণ হল। নীরার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম, আবার নিশ্চিত গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেয়া লুকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখি নীরা মুচকি মুচকি হাসছে। ঐ হাসি আমার লোকলজ্জা ভেঙে চুরমার করে দিল। আমি যেভাবে ছিলাম ওভাবেই দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলাম। লোকে আমাকে কত কি ভাবল, কিন্তু আমার প্রেয়সী একটু হাসল, তাইতো অনেক!
(২)
আজ খাবার টেবিলে সবাই খুব নীরব। নীরার প্রেগনেন্সীর ব্যাপারটা কারো অজানা নয়, বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট, কিন্তু তাও সবার মুখে কুলুপ। সবাই জেনেও না জানার ভান করবে। আবার আমাকেও কিছু ফর্মালিটি মানতে হবে। যেমন মোটামুটি প্রাপ্ত বয়স্ক কোন ছোটভাই ও যদি এসে জিজ্ঞেস করে, “ভাবির কি হয়েছে?” আমাকে বলতে হবে “অসুস্থ একটু!” যখন পেট কিছুটা ফুলে উঠবে তখন যদি তূলনামূলক ছোট কেউ প্রশ্ন করবে, “ভাবির কি হয়েছে?” তখন বলতে হবে, “ভাবি বেশি খেয়ে মোটা হয়ে গেছে”। আর তখন মোটামুটি প্রাপ্তবয়স্ক আর অতিপাকনা অথচ আমার চেয়ে ছোট রা আর কোন প্রশ্ন করবে না। এটা হয়ে যাবে তার ফিসফিসানির একটা অন্যতম টপিক। একজন আরেকজন কে ফিসফিসিয়ে বলবে, “জানিস, ভাবির বাচ্চা হবে” বলেই সবাই খিলখিলিয়ে হাসবে।
যাহোক খাবার টেবিলে এমন পিনপতন নিরবতা আমার মোটেই সহ্য হচ্ছেনা। এদিকে আজ আমি সীমাহীন খুশি। আমি যে বাবা হচ্ছি এটা প্রত্যেকটা মানুষকে জানানো পর্যন্ত আমার তর সইছেনা। ইতিমধ্যে যত বন্ধুকে সম্ভব বলে ফেলেছি। ফেসবুকে লাইফ ইভেন্টে “Becoming a father” স্ট্যাটাস প্রায় দিয়েই ফেলছিলাম, নীরা এসে থামাল। আমার কাছে বাবার অনেকগুলো অপছন্দের কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে শব্দ করে খাবার খাওয়া। খাওয়ার সময় বিশ্রি শব্দ হয় তাঁর মুখ দিয়ে। মনে হচ্ছে দুনিয়ায় তিনি একাই ভাত খাওয়া শিখেছেন এবং ভাত খাদক হিসেবে নিজেকে জাহির করছেন। কিন্তু আজ সেই শব্দটাও ভাল লাগছে। বাবা আমার দিকে একবার তাকালেন, এটাকেই উপযুক্ত মূহুর্ত ভেবে বলে ফেললাম কথাটা।
-বাবা, আমি বাবা হব।
-মানে?
-মানে নীরা মা হবে।
-তোরা কোথায় আবার বাবা-মায়ের রোল প্লে করছিস?
বাবার সারকাজমে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বাবা আমাকে পুরোপুরি বোল্ড করার চেষ্টা করেছেন, আমি ফুলটস ভেবে ব্যাট চালিয়েছি, পড়েছে লোয়ার ফুলটস, আর আমি ক্লিনবোল্ড। এদিকে নীরা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমার নীরাকে লিটমাস কাগজ মনে হয়, ওর মুখ হঠাত হঠাত লাল হয়। এটা একবার ওকে বলেছিলাম, ও খুব রেগে গিয়েছিল। বলেছিল, “আর কি কোন উপমা ছিলনা?”
আমি মাথা চুলকাচ্ছিলাম। ও বলল, “কৃষ্ণচুড়াও তো বলতে পারতে”
“কিন্তু কৃষ্ণচূড়া তো হলুদ ও হয়”
আমার উত্তর শুনে নীরা একেবারে চুপ হয়ে যায়। রাগ করেছিল কিনা তাও বুঝিনি, কারণ ওর রাগের কোন বর্ণ নেই, শুধু লজ্জার বর্ণ আছে, লাল- টকটকে লাল।
এদিকে আমাকে বোল্ড করে বাবা মনের আনন্দে আঙুল চাটছেন। আমি ইতস্তত করতে করতেই বললাম, “নীরা প্রেগনেন্ট, আমি বাবা হব, এটাই বললাম”
এবার আমার কথা শুনে সবাই হা হয়ে গেল। নাফিসের দিকে একবার তাকিয়ে মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন, অর্থাৎ আমি ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছি। কিন্তু আমার জানামতে নাফিস এ সম্পর্কে বুঝে যাওয়ার কথা, কয়দিন পর তো ক্লাস টেনে উঠবে। কিন্তু তাও ফর্মালিটির একটা ব্যাপার আছে, নাফিস মাথা নিচু করে রেখেছে, ফর্মালিটি রক্ষার জন্য হাসতেও পারছেনা বেচারা। এদিকে নীরা ততক্ষণে রুমে চলে গেছে তাড়াহুড়ো করে। বাবার আঙুল চাটা শেষ হয়নি, চোখ গুলো ছানাবড়া হয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে হাত ধুয়ে রুমে চলে এলাম। বাবা কখন আবার মহাবিপদ সংকেত জারি করে দেন কে জানে!
(৩)
সারারাত ঘুম হল না, শুধু ভাবতে লাগলাম বাচ্চাটার ব্যাপারে। আচ্ছা সে কি ছেলে হবে, নাকি মেয়ে? ছেলে হলে আব্দুল্লাহ, মেয়ে হলে ফাতিমা। বাহ! নাম ও সিলেক্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা সে কি আমাকে বাবা ডাকবে নাকি আব্বু? আর এদিকে তাকে কেমন আদর করব তা ভেবেই আমার আনন্দে তর সইল না। এমনিতেই বাচ্চারা আমার খুব প্রিয়, ছোট বাচ্চা পেলে আদর করার কম্পিটিশনে লেগে যাই। তুলতুলে নরম গাল, ছোট ছোট হাত-পা, ছোটছোট আঙুল। সবচেয়ে বেশী ভাললাগে যখন ছোট হাতের মুঠির মধ্যে আঙুল টা চেপে ধরে রাখে।
এসব ভাবনা আমার ঘুম কেড়ে নিল। তর সইছে না, ইচ্ছে করছে এখনি হাজির করি তাকে। যেমন পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে পরীক্ষার পর কি কি করব এসব যখন ভেবে ফেলি তখন আর তর সয়না। ইচ্ছে করে এখনি সব পরীক্ষা দিয়ে শেষ করে ফেলি। এখনো তেমন হচ্ছে। কিন্তু আমার আনন্দ বেশিক্ষণ টিকল না। বাচ্চাদের নিয়ে আমার ভাল স্মৃতির পাশাপাশি অসংখ্য খারাপ স্মৃতিও আছে। এ পর্যন্ত আমি যতবার কোন বাচ্চাকে কোলে নিয়েছি তার আশি শতাংশ বারই সে আমার কোলে প্রস্রাব কিংবা পায়খানা করেছে। এগুলো স্মৃতি না, দুঃসহ অভিজ্ঞতা। তাই আগেভাগেই বিষয়টা ক্লিয়ার করে রাখাটা প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।
-আচ্ছা নীরা, মেয়েদের আর ছেলেদের কাজ আলাদা হয় তাইনা?
আমি কৌশলে কনভারসেশন শুরু করতে চাইলাম। নীরা আমার কথার হেতু বুঝতে পারল না।
-মানে?
-মানে ধর মেয়েদের কাজ হয় রান্নাবান্না, কিংবা গৃহস্থালী কাজ, চাকরির পাশাপাশি। এমন না যে পুরুষ ঘরের কাজ করবে না, করবে, কিন্তু পুরুষের কাজগুলো হবে সহনীয় মাত্রার তাইনা?
নীরা এবার আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল, ওর বোধহয় মনে হচ্ছে আমি ওর চাকরি নিয়ে কিছু বলব।
-তুমি কি বলতে চাইছো স্পষ্ট করে বলবা?
-আমি বাবুর প্রস্রাব-পায়খানা সাফ করতে পারবনা।
কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে রইলাম। নীরার এক্সপ্রেশন দেখার সাহস হচ্ছেনা। আস্তে আস্তে করে চোখ খুলতে লাগলাম। চোখ খুলে দেখি নীরা মুখ চেপে চেপে হাসছে। আমার ভয় কিছুটা দূর হল। যাক! বাঁচা গেল, আমাকে এসব করতে হবেনা তাহলে। আমি আবেগে বলেই ফেললাম।
-আমার ভাল বউ টা!
এ কথাটা ব্যাকফায়ার করল। মূহুর্তেই নীরার এক্সপ্রেশন পরিবর্তন হয়ে গেল। হাসি মিলিয়ে গেল।
-শুধু প্রস্রাব-পায়খানা না, ওর প্রস্রাব-পায়খানা ওয়ালা কাঁথাও তুমি ধুবে।
নীরার কথা শুনে আমি ক্যাবলাকান্তের মত চেয়ে রইলাম। এর চেয়ে বোধহয় পরীক্ষায় ফেল করাই ভাল ছিল।
(চলবে……)
বউনামা! পর্ব-০৬ বউনামা! পর্ব-০৬ Reviewed by গল্প প্রেমিক on 5:50 PM Rating: 5

No comments

হৃদয়স্পর্শী গল্প

হৃদয়স্পর্শী গল্প