বউনামা! পর্ব-০৪

#বউনামা_৪
#মধুচন্দ্রিমা
(১)
মা আমাকে আর নীরাকে পাশাপাশি বসিয়ে দোয়াদরূদ পড়ে ফু দিচ্ছেন। নীরা অনুগত মেয়ের মত মাথা নিচু করে বসে আছে। আর আমি অবাধ্য ছেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ফু দেয়া শেষ হলে মা উপদেশ বাক্য শোনালেন।
-কক্সবাজার যাচ্ছিস, ওখানে গিয়ে কিন্তু স্পীডবোটে উঠবি না। স্পীডবোটে উঠে গতবার…
“মা! মৃত্যুর খবর নাইবা বলো”
আমি মা কে মাঝপথে থামিয়ে দিলাম। মা আবার শুরু করলেন,
-ঠাণ্ডা লাগাবি না একদম। আর টাকা পয়সা সাবধানে রাখিস, চুরি ডাকাতি হয় প্রচুর। বউ, তোমার গয়নাগাটি রেখে যাও, নেয়ার দরকার নাই কিছু। গয়নার জন্য মানুষ খুন করে ফেলে।
আমার বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও মা খুনের কথাটি বললেন ই। নীরা বাধ্য মেয়ের মত মেয়ের উপদেশ গিলছে আর আমি নীরা কে দেখছি। মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী, আমি যত প্রশংসা করি, একটু যেন কম পড়ে যায়। ওর মত চোখদুটো স্রষ্টা এ পৃথিবীতে কাউকে দেন নি। সে চোখের মায়ায় বড় বড় পালোয়ান লুটিয়ে পড়বে, সেখানে আমি তো ক্ষীণকায় এক প্রেমিক। লুটিয়েই পড়তাম, বাবার ডাকে হুঁশ ফিরল। বাবা তাড়া দিচ্ছেন, কোথাও যাওয়ার জন্য বের হতে নাকি দেরি করতে নেই। আমি আর নীরা বাবাকে সালাম করলাম, মা কে সালাম করার পর আমি ভয় পাচ্ছিলাম মা আবার না কেঁদে দেন, যেটা ভাবলাম সেটাই হল, মা আবারো কান্না জুড়ে দিলেন। কান্না তো কান্না, একেবারে মরা কান্না, মনে হল সদ্য তার পুত্রবিয়োগ ঘটেছে। তবে আজ কান্না টা স্থায়ী হল না, বাবার চোখরাঙানীতে মা থেমে গেলেন। আমি বাবা থেকে এক্সপ্রেশন টা শিখে নিলাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। নীরাও খুব আবেগী কিনা!
(২)
বাসের টিকিট কেটে আমি দৌড়ে গিয়ে জানালার সিটে বসে পড়লাম। মনে পড়ে কলেজ যাওয়ার সময় বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করতাম জানালার সিট ধরার জন্য, সে প্রতিযোগিতার রেশ এখনো কাটেনি। তবে তখন প্রতিযোগিতা জমত, কারণ তখন অপর প্রতিযোগী ও আমার মত সমান শক্তি দিয়ে সিট তখল করতে চাইত, কিন্তু নীরা কোন চেষ্টাই করল না, বলা যায় ফাঁকা মাঠে গোল দিলাম। কিন্তু নীরার চোখের দৃষ্টিতে আগুন দেখে নিজের সাফাই নিজেই গাইলাম।
-জানালার পাশে না বসলে আমার অস্বস্তি হয়।
-নেকাব করা আমার, অস্বস্তি হবে তোমার?
নীরা কথায় যুক্তি আছে, আবার কণ্ঠে অভিমান। তাই সিট দখল করে যে বীরের ভাবটা নিয়েছিলাম সেটা মূহুর্তে বিলীন হয়ে গেল। এরপর নীরা কে জানালার পাশে দিলাম। মনে মনে বললাম, “রাতে ফ্যানের বাতাস ও তোমার, এখানে জানালার বাইরের আকাশ ও তোমার। আমার কি?” কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। পাছে মধুচন্দ্রিমার পরিবেশ টাই না নষ্ট হয়ে যায়। নীরা পুরো রাস্তা জুড়ে বাইরের গাছপালা, মাঠ আর আকাশ দেখে কাটাল আর আমি পাশের সিটে বসে থাকা আমারই মত আরেক হতভাগার বাংলা পাঁচের মত মুখ। বাস থেকে যখন নামি তখন প্রায় দুপুর হয় হয়। আমি নেমেই বললাম,
-আরে! সমুদ্র কই? সৈকত কই? রাস্তা, দোকানপাট কেন?
-এটা কক্সবাজার শহর, সমুদ্র সৈকত না। বাস তোমাকে সোজা সমুদ্র সৈকতে নামাবে?
নীরার উত্তরে আমি নিজেকে খুবই নির্বোধ হিসেবে আবিষ্কার করলাম। আসলেই তো, শহর দেখলেই আজকাল কেমন যেন ঢাকা ঢাকা মনে হয়। কক্সবাজার বললেই শুধু সমুদ্র মাথায় আসে, সেন্টমার্টিন বললে নারিকেল গাছ মাথায় আসে, সিলেট বললে জাফলং এর পাথর মাথায় আসে কিংবা সাতরঙের চা, আর বরিশাল বললে শুধু লঞ্চ মাথায় আসে। মস্তিষ্কের মধ্যে এসব ডিফল্ট ভাবে সেট করা আছে। তাই হয়ত এমন।
-নীরা, চল সৈকতে যাই।
-হোটেলে যাব না আগে?
-কার হোটেল?
-মানে? রুম বুকিং দাওনি?
-আগে থেকে দিতে হয় নাকি?
নীরার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মনে হচ্ছে সদ্য জন্ম নিয়েছি এ পৃথিবীতে।
-ভাল কোন হোটেলে সিট পাব এখন? আগে থেকে বুকিং এর ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হত।
-রাতে করব, এখন চল সৈকতে যাই, গোসল করি।
-মজা করছ আমার সাথে? রুম নিব না আগে?
-আগে রুম নিব কেন? আমরা তো আগে বন্ধুরা মিলে পিকনিকে গেলে আগে গিয়ে সারাদিন ঘুরতাম, এরপর রাতে একটা রুম নিয়ে ঘুমাতাম।
-পাওয়া যেত?
-মানে নরমাল রুম আরকি। কোনরকম থাকতাম।
-তো, আমরা তেমন কোন রুমে থাকব?
-না। মানে….
আমাকে তোতলাতে দেখে নীরা পেয়ে বসল।
-তুমি তোমার বন্ধুর সাথে এসেছো এখন? সারাদিন ঘুরে রাতে কোনরকম একটা রুম নিয়ে থাকবা না?
-ঘুরা ই তো মেইন। কক্সবাজার আসিনাই কখনো। ঘুরব না?
-ঘুরো তুমি। আমি যাচ্ছি।
বলে নীরা সত্যি সত্যি উলটো দিকে হাঁটা ধরল। কোন উপায়ন্তর না দেখে আমি আমার পূর্বের পদ্ধতি ফলো করলাম।
-নীরু! শোনোনা!
বলে ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম।
(৩)
নীরাকে অনেক কষ্টে মানিয়েছি। মানিনীর মান ভাঙানো খুবই কষ্টের। অবশেষে আমরা স্থানীয় এক দোকানদার থেকে ঠিকানা নিয়ে একটা বেশ নামিদামি হোটেলের বুকিং দিতে চললাম। এদিকে রাস্তায় নীরা কোন কথা বলছে না, গাল ফুলিয়ে আছে বোধহয়, মুখ ঢাকা থাকায় বুঝতে পারছিনা। অথচ আমার মনের মধ্যে কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, যেগুলো না করলেই নয়।
-আচ্ছা নীরা, আমরা যে বিবাহিত তার প্রমাণ কি?
-মানে?
-মানে হোটেল কতৃপক্ষ যদি জিজ্ঞেস করে আপনারা যে বিবাহিত তার প্রমাণ কি? তখন কি প্রমাণ দেখাব?
-তোমার মাথা দেখাবা।
-আমার মাথা দেখিয়ে কি প্রমাণ হবে?
এবার নীরা আবারো সেই লুক দিল। অর্থাৎ গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেয়া লুক। আমি চুপ করে গেলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই প্রশ্ন টা সরাতে পারছিলাম না।
হোটেলে পৌঁছেই দেখলাম বুকিং দেয়ার জন্য আলাদা রুম আছে। রুমে ঢুকে দেখি এক মহিলা বসে আছে। মহিলার আচরণ অনেকটা রোবটের মত। ঘাড় সোজা করে রেখেছেন, চশমা পরে আছেন অথচ দেখছেন চশমার উপর দিয়ে। মহিলা আমাদের ভালমত দেখলেন এরপর বললেন,
-স্যার, আপনাদের কিভাবে হেল্প করতে পারি?
-আমাদের একটা রুম লাগবে। ভাল দেখে।
-আপনারা কি আগে থেকে কোন বুকিং দিয়েছেন?
-জ্বি না।
-নিউ বুকিং।
-কত দিনের জন্য?
আমি নীরার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি নীরাও আমার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা আমতা করতে করতে উত্তর দিলাম।
-আ আ আমরা পরে জানাই দিব কতদিন থাকি।
-সরি স্যার। এমন কোন নিয়ম নেই, আপনাকে আগে থেকেই একটা নির্দিষ্ট সময় বলে তারপর বুকিং দিতে হবে।
আমি কতদিন বলব বুঝতে না পেরে বলে দিলাম দুইদিন। মহিলাটা দু ডে, ওয়ান নাইট হিসেবে এন্ট্রি করল খাতায়। আমি তখনো জানতাম না আমি যে দুইদিন বলেছি এটার অর্থ হচ্ছে আজকের দিন, আজকের রাত এবং কালকের দিন। আমি হাসিহাসি মুখ করে নীরার দিকে তাকিয়ে দেখি ও আবারো আমার দিকে বিধ্বংসী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আজকাল নীরা কে কেমন জানি বাবা বাবা মনে হয়। বাবা আমার দিকে কখনো ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকান না। নীরাও খানিকটা অমন হয়ে যাচ্ছে। এরপর মহিলা আমাকে বললেন “আপনাদের নাম গুলো বলুন”।
-আসিফ মাহমুদ এবং নীরা।
-পুরো নাম।
হঠাত খেয়াল করলাম আমি নীরার পুরো নাম জানিনা! কিংবা জানলেও সেটা ভুলে গেছি। কিন্তু নীরার বাবার নামটা স্পষ্ট মনে আছে। ধারণা করলাম বাবার শেষ নামের সাথে নীরার শেষ নাম মিলতে পারে। নীরা কিছু বলার আগেই আমি বলে দিলাম,
-নীরা উদ্দিন।
মহিলা আমি বলার পর মূহুর্তকাল ও দেরি করলেন না, খসখস করে লিখে ফেললেন। আমি নামটা কেমন অসংগত বলেছি সেটাও তার খেয়াল করার সময় নেই। এখন মনে হচ্ছে আমি যদি বলতাম আমার নাম “রাবেয়া আক্তার” আর ওর নাম “গিঁয়াস উদ্দিন” তাও তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই লিখে ফেলতেন। এদিকে রুম বুক করে চাবি নিয়ে রুমে এসে পৌঁছালাম। রুমে এসে নীরা মুখ খুলল, দেখলাম ওর মুখ রক্তলাল হয়ে গেছে, চোখেও কেমন লালচে ভাব, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেখে আমি নিরাপত্তা বেষ্টনী স্বরূপ চোখ নামিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
(৪)
নীরা আমার সাথে কথা ধর্মঘট করেছে। অর্থাৎ আমার সাথে সে কথা বলবে না। তবে এ ধর্মঘট অঘোষিত, আমাকে এ বিষয়ে কোন আগাম সংকেত কিংবা হুঁশিয়ারি দেয়া হয়নি। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে, আমরা সৈকতে ও বেড়াতে যাইনি, একজন আরেকজনের সাথে সময়ও কাটাইনি। সময় কাটাইনি বললে ভুল হবে, সারাক্ষণ ই এক রুমে আছি, কিন্তু কোন কথা হয়নি।
বাড়িতে হলে নীরা কে পাওয়াই যেত না, সে এদিক ওদিক পালিয়ে যেত, রাগ করলে প্রতিবার এমন করে। কিন্তু এখানে তো একটাই রুম, তাই এভয়েড করতেও অনেক কষ্ট হচ্ছে। তাও খাটে বসে ওপাশ ফিরে আছে, আমার দিকে বোধহয় আর তাকাবেই না এমন পণ করেছে। রাতের খাবার ও খাচ্ছেনা। এ দিকে আমি কয়েকটা পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম ওকে খাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করার। প্রথমে খুব শব্দ করে করে খেয়েছি, এবং খাবার খুবই মজাদার হয়েছে বলে জোরে জোরে মন্তব্য করেছি। এতে কোন কাজ না হওয়ায় বয়কে দিয়ে আবারো খাবার আনিয়েছি, যাতে ও বুঝতে পারে খাবার টা আসলেই সুস্বাদু হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু না হওয়ায় আমি হতাশ হয়ে বালিশ কোলে নিয়ে বসে আছি।
বেশিক্ষণ বালিশ কোলে দিয়ে কোমরে ব্যাথা হয়ে যাওয়ায় আর ওভাবে বসে থাকতে পারলাম না। কিন্তু একটু শুলেই যে ঘুম এসে যাবে সেটা ভেবেই শুতে মন চাইল না। কিন্তু কোমরে ব্যাথা আর এসির বাতাস ঘুমের পক্ষে ধনাত্মক প্রভাবক হিসেবে কাজ করল। কখন যে মাথার নিচে বালিশ টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই বলতে পারলাম না।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে যে জিনিসটা নজরে পড়ল সেটা হল নীরা ব্যাগ গুছাচ্ছে। ব্যাগ গুছাচ্ছে ভাল কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাগের কাপড়চোপড় বের করার প্রয়োজন পড়ল কখন আবার!
-কি হল? ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন?
-চলে যাব।
-কোথায়?
-বাড়িতে। মানুষ কোথায় যায় আর?
-কেন? বীচে যাবা না?
-তুমি একাই যাও। ঘুরতে এসেছো না? ঘুরে আসো যাও।
-একা ঘুরে মজা নেই। এজন্যই তো তোমাকে নিয়ে এলাম।
-ও আচ্ছা! একা ঘুরতে ভাল্লাগেনা এজন্য নিয়ে এসেছো তুমি আমাকে? আমি তো ভাবলাম আমার সাথে একান্ত সময় কাটানোর, ঘুরার, খুব ইচ্ছে তোমার। তোমাকে চিনতে খুব ভুল হয়ে গেছে আমার।
নীরা প্রফেশনাল দের মত ঝগড়া করছে। কিন্তু ঝগড়া করার বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। তাই আমি হা করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না।
-আমি চলে যাচ্ছি।
-আরে আজকে দিনটা থেকে রাতের বাসে যাই। হোটেল ভাড়া দিয়েছি না?
-তুমি হোটেল ভাড়া নিয়ে পড়ে আছো? আর এদিকে রাতে আমি খেয়েছি কিনা সে খোঁজ নিয়েছো?
-আমি টাক মারছিলাম খেয়াল করো নি? ওটা তোমাকে খাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য। তাহলে খোঁজ নিইনি কি করে বলো।
-ও আচ্ছা! অনেক ধন্যবাদ! এতটা কেয়ার করার জন্য।
নীরার উত্তরের সংলাপ টা নরমালি বললে এটা আমার জন্য পজিটিভ। কিন্তু ও কথাটা বলল মুখকে বিশেষ ভঙ্গিতে বাঁকা করে আর চোখ উলটে। এটা আমার জন্য নেগেটিভ। অর্থাৎ এ কথা দ্বারা সে আমাকে বিদ্রুপ করেছে। এদিকে নীরার সাথে সাথে আমিও রেডি হয়ে গেলাম। হানিমুনের নিকুচি করি। কে বলেছিল এসব হানিমুনের পাল্লায় পড়তে। বস বলেছিল। এখন ইচ্ছে করছে বসের টাকমাথায় দু’দুটো নারকেল ভাঙি, এত বেশী রাগ হচ্ছে। নীরা বোধহয় রাগের সাথে সাথে ক্ষোভ, কষ্ট, কান্না, কয়েক ধরণের অনুভূতির মিশ্রণ মনে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটার জন্য মায়া হয়, খুব মায়া হয়!
(৫)
ফেরার বেলা গাড়িতে উঠে জানালার সিটের জন্য আমি কোন প্রতিযোগিতা করলাম না, নীরা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় জানালার পাশে বসল। এবারো নীরা যাওয়ার বেলায় গাছপালা, মাঠ, আকাশ, নদী সব দেখল আর আমি দেখলাম নীরা কে। নীরা একবারো আমার দিকে তাকাল না, আমার কাছে পৃথিবী টা কেমন শূন্য মনে হতে লাগল। পাশে বসে থাকা আমার নীরা কে মনে হতে লাগল শত আলোকবর্ষ দূরের কোন তারা, যাকে আমি কেবল দেখতে পারি, যার প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু এই দূরত্ব কখনো ঘোচাতে পারিনা।
সময় গড়িয়ে গেল, দেখতে দেখতে বাড়ির কাছাকাছি চলে এলাম। আমি বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বাসে উঠলেই প্রচুর ঘুম আসে আমার। যখন জাগলাম, তখন বাস থেমে গেছে। বাস থেকে নেমে একটা সিএনজি নিয়ে বাড়ির দিকে চললাম। নীরা এখনো কোন কথা বলছেনা। আজ বাড়ি গিয়ে নামলে চারদিক থেকে সাংবাদিকরা ছুটে আসবে, সবাই মাইক বাড়িয়ে দেবে। “হানিমুন থেকে এসে আপনার অনুভূতি কি?” “এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ কি?” “ভাবির সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?” আমি বলব, “নো কমেন্টস প্লিজ” বলে মাইক গুলো সরিয়ে দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাব। বাড়িতে প্রতিটা ঘরে ঘরে নিউজ হবে। “নবদম্পতির ঝগড়া ও একটি সুখের সংসার তছনছ” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে। যা ভাবলাম ঠিক তাই ই হল। বাড়িতে ঢুকতেই ছেলেবুড়ো সব এগিয়ে এল। আমি আর নীরা কারো সাথে কোন কথা না বলে সিএনজিওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই বাবার সামনাসামনি হলাম। নীরা রুমে চলে গেল, বাবা আমার চোখের দিকে তাকালেন। বাবার চোখে একটাই প্রশ্ন, “আবার গণ্ডগোল ঘটিয়েছিস?”
-কি গণ্ডগোল ঘটাবো?
-মানে? আমি তো কিছু বলি ই নি।
বাবার গম্ভীর উত্তর। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি বাবার চোখের প্রশ্নটি পড়ে বাস্তবে উত্তর দিয়ে দিয়েছি। লজ্জা পেয়ে রুমে চলে গেলাম। আজকের রাত নিয়ে আমি খুবই ভীত সন্ত্রস্ত! দিনটাতো এদিক ওদিক পালিয়ে পার করে দেব কিন্তু রাত ঠিক আদালত বসবে। আজ নির্ঘাত আমার নামে মামলা হবে, বাদী নীরা, আর সবসময়ের মত প্রধান বিচারপতি বাবা। আর অভিযোগ সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হলে যে আমার কি হবে তা ভাবতে পারছিনা। এমনিতেই বাবা শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় আছেন। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি তিনটা বাজে। আমার বিচার শুরু হতে আর খুববেশি হলে ৪ঘণ্টা আছে।
(চলবে……..)
বউনামা! পর্ব-০৪ বউনামা! পর্ব-০৪ Reviewed by গল্প প্রেমিক on 5:08 PM Rating: 5

No comments

হৃদয়স্পর্শী গল্প

হৃদয়স্পর্শী গল্প