বউনামা! পর্ব-০৩
#বউনামা_৩
-Asif Mahmud
(১)
শ্বশুর বাড়ি দুদিন বেড়িয়ে ফিরে এসেছি। প্রথমত ফর্মালিটির ডোজ এত বেশি হয়ে গেছিল যে বউয়ের সাথেও ফর্মাল আচরণ শুরু করে দিয়েছিলাম। বউ রুমে ঢুকলে আমি দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করি, বউ আমাকে “পানির গ্লাস টা দাও তো একটু” বললে আমি দুহাতে গ্লাস টা ধরে সসম্মানে বাড়িয়ে দেই, বউ রোমান্টিক কিছু বলতে চাইলে আমি শ্বশুরের সাথে কথা বলার স্টাইলে তার সাথে কথা বলে ফেলি। ভাববেন না এসব ইচ্ছে করে করছি। বিয়ের চক্করে এই কয়দিন যে পরিমাণ ফর্মালিটির ডোজ পড়েছে সেটা সাপোজিটরের থেকেও বেশি তীব্র।
শুধুমাত্র এজন্য যে শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি সেটা নয়, আরো দুটি কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মায়ের হুঁশিয়ারি। মা বলেছেন শ্বশুর বাড়িতে বেশী থাকলে নাকি আদর কমে যায়। তাই আদরের মাত্রা টা সুষম রাখতে পালিয়ে এসেছি। আর অন্য কারণ টি হল, ছুটি আছে আর অল্প কদিন। এরপর ঢাকায় ফিরতে হবে, চাকরি সামলাতে হবে। বাড়ি ফিরতেই শুরুতেই বাবার সাথে দেখা, বাবার মাথা বেশ শুকনো শুকনো লাগছে। অর্থাৎ কয়েকদিন তেলের মালিশ বন্ধ আছে বোধহয়। মনে হল বাবার প্রেশারের আমার সাথেই কানেকশন, আমি থাকলেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাবার প্রেশার উঠে যায়।
বাবা সামনে পড়ে যেতেই নীরা পা ছুঁয়ে সালাম করল। অর্থাৎ নীরার ফর্মালিটির ডোজ শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মনে হল একটা ছেলের ফর্মালিটির মধ্যে থাকতে হয় ক’টা দিন মাত্র, তাতেই এত বিরক্তি! আর একটা মেয়েকে সারাজীবন ফর্মালিটির বেড়াজালে থাকতে হয়, কেমন বোধ করে ওরা! এসব ভাবতেই নিজেকে নারীবাদী নারীবাদী মনে হতে লাগল, তাই তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করলাম।
-মাথা ঝাঁকাচ্ছিস কেন?
বাবা এটাও খেয়াল করে ফেলেছেন।
-এমনি। ঘাড় একটু সোজা করে নিলাম।
-তোর ঘাড় জীবনেও সোজা হবেনা।
বাবা এই কথা বলে মূহুর্তেই কেটে পড়লেন। বাবার কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। তিনি সুকৌশলে আমাকে অপমান করেছেন। আমিও “হেটার্স রা কত কথাই বলবে!” টাইপ একটা ভাব নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
ঘরে ঢুকতেই মা ছুটে আসলেন। মায়ের চেহারা ইমোশনাল, দেখে মনে হচ্ছে আমি বিশ বছর পরে এসেছি আর বিশ বছর ধরে মা রেডিওতে “খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে” গান শুনছিলেন। মা আসতেই নীরা ফর্মালিটি সেরে নিল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মা আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর নীরা কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আমাকে আর পাত্তাই দিলেন না, অর্থাৎ “ইটস গার্লস টাইম!” আমিও ঘরে বসে রইলাম, একে একে চাচাতো ভাইরা আসল, আর আমি তাদের গল্প শোনালাম শ্বশুরবাড়ির। প্রত্যেকটা গল্পের মূলভাব একই, “আর যাই হোক, জীবনে বিয়ে করিস না”।
(২)
নীরা আমার উপর রেগে আছে। আমি নাকি চাচাতো ভাইবোন দের কাছে শ্বশুর বাড়ির বদনাম করেছি। কথাটা আংশিক সত্য, কারণ আমি শ্বশুর বাড়িতে ভয়ংকর ফর্মালিটিস গুলোর আলোচনা করতে গিয়ে হয়ত দুয়েকটা কথা বদনামি টাইপের বলে ফেলেছি। যেমন শ্বশুরের কথা বলার মাঝখানে ভাত মুখে পুরে দেয়ার কথাটা বলে ফেলেছি। এতে সবাই খুব হাসাহাসি করেছে, এটা বোধহয় বেচারির খারাপ লেগেছে। গাল ফুলিয়ে বসে আছে তখন থেকে।
-কি হয়েছে বলবা তো?
-কিছু হয়নি।
-তাহলে গাল ফুলিয়ে আছ কেন?
-আমার গাল এমনই।
-না। এমন না, একটু বর্ধিত ফোলা মনে হচ্ছে।
নিরা ফিক করে হেসে দিল। বাবা-মা সবসময় আমাকে বলতেন আমি বোকা বোকা কথা বলে লোক হাসিয়ে বেড়াই। আজ হঠাৎ করেই বোকামির প্রতি আবারো খুব গর্ব হচ্ছে। একটা বিজ্ঞাপন ছিল, “দাগ থেকে যদি দারুন কিছু হয় তাহলে তো দাগ ই ভাল”। আমিও তাই ভাবছি, বোকামি থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তাহলে তো বোকামি ই ভাল। বোকামি আমাকে নীরা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, আবার এ বোকামি ই নীরার মুখে ফুটিয়েছে হাসি, আর কি চাই! নীরার হাসি অসম্ভব সুন্দর, পৃথিবীতে সব সুন্দরী মেয়ের হাসি সুন্দর হয় না, যেসব মেয়ের হাসি সুন্দর তারা রুপবতী না হলেও প্রচণ্ড মায়াবী। আর নীরা দুটোই, রূপবতী ও, মায়াবতী ও। আমি হলফ করে বলতে পারি যদি পৃথিবীর সব ছেলেরই একটা করে নীরা থাকত, তবে সবাই ই বোকা হওয়ার যুদ্ধে নেমে পড়ত।
-কি ভাবছ এভাবে উদাসীন হয়ে?
-ভাবছি মা-কে কিভাবে বলব ঢাকা চলে যাওয়ার ব্যাপারে।
-কেন? যেতে তো হবেই। মা তো জানেন ই।
-তাও ফর্মালি বলার একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না।
-ফর্মালি কেন? মা ছেলের মধ্যে আবার ফর্মালিটি কি?
-তাও ঠিক। বিয়ের পর থেকে এতসব ফর্মালিটি দেখতে দেখতে এখন মাথাজুড়ে ফর্মালিটি ঘুরছে শুধু।
নীরা জবাব দিল না। অবশ্য আমার কথাটার জবাব আমি নিজেও জানিনা। মায়ের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম, বিষয়টা মা কে জানানো দরকার।
(৩)
আমার কথা শুনে মায়ের চোখ কপালে উঠে গেল।
-বিয়ের মাত্র দুদিন হল, এখন থেকেই আলাদা থাকার কথা বলছিস?
-মা! আমি কি বললাম আর আপনি কি বুঝলেন? আলাদা কেন থাকব? ঢাকায় যাব না আমি? চাকরি করা লাগবে না? বাবার রিটায়ারম্যান্ট পর্যন্ত আপনাদের কে তো নিয়ে যেতে পারছিনা, আর নীরারও তো ঢাকাতেই…
-ঠিক আছে। যা তোরা।
মা মুখ গোমরা করে বললেন। মায়ের বোধহয় স্বপ্ন ছিল শাবানার মত কোন পূত্রবধু। যে সংসারটাকে সোনার সংসার বানিয়ে দেবে। রোজ ভাল ভাল রান্না করবে, বিদ্যুৎগতিতে ঘরের কাজকর্ম করবে, সুযোগ করে আবার শাশুড়ির চুলে তেল মেখে দেবে, আবার শ্বশুরের ওজুর পানি গরম করে দিবে। আর এদিকে নীরা শিক্ষিতা মেয়ে, চাকরি পেয়েছে ঢাকায়, সে তো আর ঘরে বসে থাকবে না। মায়ের স্বপ্ন ও পূরণ হল না। তবে একসাথে থাকাই যায়। বাবাকে বলেছিলাম এ ব্যাপারে, বাবা রিটায়ারম্যান্টের জন্য অপেক্ষা করছেন, চার বছর বাকি আর। আর তাছাড়া এমনিতেও তিনি গ্রাম ছাড়তে নারাজ। নাহয় আমারও স্বপ্ন ছিল পুরো পরিবার একসাথে থাকব। নীরা রোজ ঘরের রান্না না করুক, ছুটির দিনে কিংবা অবকাশ পেলেই রান্নাঘরে ঢুকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়া রান্না করবে, মা প্রশংসা না করতে চেষ্টা করেও পারবেন না। কিংবা অফিস শেষে বাসায় এসে এক কাপ চা বানিয়ে বাবাকে দিয়ে আসবে। সময় করে কখনো মায়ের চুল আঁচড়ে দেবে। কিন্তু পরিস্থিতির জন্য সেটা আর সম্ভব হল না।
-সারাজীবন খাটো আর খাটো। আর কি জীবনে!
মা গুনগুন করে বলছেন, এটাকে অনেকটা ঘ্যানঘ্যান বলা যায়। এটা সত্যি যে মা অনেক খেটেছেন এ জীবনে, তাঁর ও অবসরের প্রয়োজন খানিকটা।
-একটা বুয়া জোগাড় করে দিব মা?
-বুয়ার রান্না খাব আমরা? এতটাও খারাপ দিন আসেনাই।
-কেন? বুয়া কি মহিলা না? সে রান্না জানেনা?
-তুই বুঝবিনা। যেমন তেমন করে রান্না করে এরা।
-আচ্ছা রান্না টা নাহয় আপনি করলেন, বাকি কাজ গুলা বুয়া করবে, সহযোগিতা হবে না? পরিশ্রম কমবে আপনার।
মা কিছু বলছেনা। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিলাম। একটা বুয়ার খোঁজ করতে হবে তাড়াতাড়ি। তাতে যদি মায়ের কিছুটা অবসর মেলে আর দুয়েক ঘণ্টা বেশি সিরিয়াল দেখতে পারেন। অবশ্য আজকাল সিরিয়াল দেখা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন, যার প্রধান কারণ বাবার মাত্রাতিরিক্ত বকাবকি। বাবার ধারণা এসব সিরিয়াল থেকে মানুষের মধ্যে কুটিলতা বিস্তার করছে। মা অবশ্য বাবার সাথে তর্কে যান মাঝেমাঝে কিন্তু বাবার সাথে তর্কে পেরে ওঠা সহজ না তাই আত্মসমর্পণপূর্বক কয়েকটা সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়েছেন।
এদিকে আমার বুয়া খোঁজাখুঁজির খবর বাবা পর্যন্ত পৌঁছার পরপর ই বাবা হুংকার ছাড়লেন।
-আকামের আর জায়গা পাস না। এখনকার বুয়াদের বিশ্বাস আছে? চুরি করবে, ডাকাতি করবে, খুন করবে।
-চুরি করবে বুঝলাম। শেষের দুটো কিভাবে?
-এইসব বুয়াদের লিংক থাকে ডাকাতদের সাথে। আর রহমানের মা কে যে বুয়া খুন করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছিল ভুলে গেছিস তুই?
বাবার যুক্তিতে কোন ফাটল নেই। আমি চুপ করে রইলাম। বাবা তর্কে জিতে বিজয়ী ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, মায়ের কপালে আর সুখ আসল না।
(৪)
আমরা এভাবে ঢাকায় চলে গেলে সবাই কি ভাববে তা নিয়ে নীরার চিন্তার অন্ত নেই।
-মা আমাকে খুব খারাপ ভাববে। বলবে এসব আমার ই কীর্তিকলাপ।
-আরে মা এটা ভাবতে যাবে কেন? এতদিন আমি ব্যাচেলর বাসায় ছিলাম, বুয়ার রান্না খেতাম, এলোমেলো লাইফ, এখন বউ থাকবে। মায়ের তো টেনশন উলটো রিডিউস হবে।
-সেটা না। মায়ের একটা প্রত্যাশা আছে না? বউ ঘরে থাকবে, তাঁকে হেল্প করবে এই টাইপ কিছু। মুখে না বললেও মনে মনে তো অনুভব করেন।
আমি মনে মনে বললাম, মনে মনে না, মা মুখেও আমাকে এটাই বলেছে। তবে নীরার চিন্তাভাবনা দেখে মুগ্ধ হলাম অনেক। মেয়েরা সাধারণত নিজের টা ভাবে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কথা ভাবার সময় কোথায়, কিন্তু নীরা ভাবছে, এবং অনেক গভীরভাবে ভাবছে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি এতেই ওর প্রতি সন্তুষ্ট। আমি নীরাকে অভয় দিলাম, বললাম, “মা কে আমি বুঝিয়ে বলেছি, তুমি ভেব না”। এতে নীরা বোধহয় কিছুটা সাহস পেল।
এদিকে চাচাতো ভাইরা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে হানিমুন অর্থাৎ মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার জন্য। আমার অফিসের ছুটি শেষ হয়ে আসছে, আর তাছাড়াও এসবে আমার প্রচণ্ড অনীহা। একটা লজ্জাকর ব্যাপার ও জিনিসটা। মানে জিনিসটা এমন যে সবাই জানে আমরা কি জন্য যাচ্ছি, ওপেন সিক্রেট। কিন্তু তাও আমরা কেমন সুশীল সেজে বলছি, “ঘুরতে যাচ্ছি” বত্রিশটি দাঁত কেলিয়ে। আমি খুব শক্তভাবে বলে দিলাম, “না হবেনা। এসবে নাই আমি” বলেই উঠে চলে এলাম।
এদিকে বসকে একটা ফোন করা জরুরি বলে বোধ হল। দাওয়াত করেছিলাম বিয়েতে, তিনি ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি। ফোন দিচ্ছি বেশ ভালবাসা থেকে এমন না, ফোন দিচ্ছি কারণ বসের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে হয় উপরে উঠতে গেলে। তাকে দেখতে বিচ্ছিরি লাগলেও বলতে হবে “আপনাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে স্যার, মনে হচ্ছে ত্রিশ বছরের কোন যুবক”
-আরে কি যে বল? ত্রিশ বছরের নাহয় পাঁচ-ছ বছর বেশী হবে।
মনে মনে বলছিলাম, “ষাটোর্ধ বুড়া ষাঁড়, নিজেকে জোয়ান সাজাচ্ছে!” বসকে ফোন দিয়ে কানে ফোন ধরে বসে রইলাম। এই মূহুর্ত টা নার্ভাস মূহুর্ত। ক্রিং করে যখন আওয়াজ টা হয় তখন কেমন বুক ধক ধক করে ওঠে, ইচ্ছে হয় ফোন কেটে দিই।
-হ্যালো!
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার!
আমার এই সালাম টা তার পছন্দ না। তার মতে এই সালাম টা শুনলে নাকি মক্তব পড়ুয়া ছোট বাচ্চাদের মত শোনায়। কিন্তু সালাম তো এভাবেই দিতে হয়, যে যা বলুক তাতে কি। তবে আজ তিনি বেশ ফুরফুরা মেজাজে আছেন বলে মনে হল। সালাম নিয়ে কিছু বললেন না। সালাম নেয়ার সময় কিন্তু নিজের স্টাইল ধরে রাখলেন।
-ওয়ালাইকুম স্লাম!
-স্যার কেমন আছেন?
-হ্যাঁ ভাল আছি। আপনার কি অবস্থা আসিফ সাহেব? বিয়েশাদি তো করলেন? কেমন অনুভূতি।
আজ তিনি অতিরিক্ত কথা বলছেন। অন্যদিন দুয়েকটা ছোট ছোট কথা বলেন তাও গম্ভীর ভাবে। আজ বোধহয় কোন কারণে খুব খুশি আছেন।
-জি স্যার ভাল আছি আলহামদুলিল্লাহ। স্যার বিয়ে করা আর অফিস করার মাঝে তেমন পার্থক্য নেই, ওখানেও ফর্মাল থাকতে হয়, এখানেও।
-ভাল বলেছেন? আপনার স্ত্রী কেমন আছে? খুশি তো?
-জ্বি ভাল আছে। তবে খুশি কিনা জানিনা। মিশ্র অনুভূতি, প্রতি মূহুর্তে তার অনুভূতি বদলাচ্ছে।
-হা হা হা। মাত্র তো শুরু। তো হানিমুনে যাবেন না?
বসের এই প্রশ্নে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলব বুঝতে না পেরে বললাম, “স্যার আমি তো অফিসে জয়েন করছি পরশু থেকে”
-আরে বিয়ে করলেন দুদিন হল। পরশু থেকে অফিস জয়েন করার কি প্রয়োজন? ছুটি লাগলে বলেন। হানিমুনে যান, ঘুরে আসেন কোথাও থেকে। ইয়ং মানুষ, পরে আর এ সুযোগ পাবেন নাকি।
-জ্বি স্যার। সত্য বলেছেন। তবে কি যাব স্যার?
-অবশ্যই যাবেন। আজই চলে যান। আপনার ছুটির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-জ্বি। থ্যাংকিউ স্যার।
-ওকে বাই।
বস ফোন রেখে দিলেন। ছুটি মঞ্জুরের আনন্দ ও ছিল, আবার হানিমুনে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করার লজ্জা আর ভীতি দুই ই ছিল।
(৫)
-নীরা, বস ছুটি দিয়েছেন হানিমুনে যাওয়ার জন্য।
-কিসের জন্য?
-শুনেছোই তো। কনফিউজ করছো কেন। এই শব্দ টা একবার বলতেই আমার জান ছুটে গেছে।
-কি বলবে মানুষ?
-সেটা তো আমিও ভাবছি। কিন্তু আর কখনো সুযোগ পাব নাকি একসাথে নির্বিঘ্নে সময় কাটানোর। তাই বলছিলাম আরকি।
আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললাম। নীরা বোধহয় বুঝতে পারল আমি লজ্জা পাচ্ছি।
-আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু সবাইকে কিভাবে বলবে?
আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি আমার পরিবারের কাছে বিশেষত বাবার কাছে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে হলে মায়ের মাধ্যমেই করেছি। যেমন টাকার প্রয়োজন পড়লে মা কে গিয়ে চুপিচুপি বলতাম, “মা আমার কিছু টাকা লাগবে”। মা বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিতেন। আজ ঢাকা যাওয়ার ব্যাপার টাও মাকে বললাম। কিন্তু হানিমুন শব্দটা মায়ের সামনে কি করে উচ্চারণ করব তা-ই ভেবে পাচ্ছিনা। তাও সাহস সঞ্চয় করে এগুলাম।
মা চুলোয় ভাত চড়িয়েছেন সবে। আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসলাম।
-মা! অনেকদিন কোথাও ঘুরা হয়না।
মা আমার কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
-ইয়ে, বলছিলাম কোথাও থেকে গিয়ে ঘুরে আসি। মানে পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র কতকিছু আছে না দেখার?
-মাত্র বিয়ে করলি, ঘরে বউ, এখন তুই ঘুরতে যাচ্ছিস?
মা অবাক হয়ে তাকালেন। আশ্চর্য! আমি কি বলতে চাইছি মা কি একটুও বুঝতে পারছে না!
-আমি বউকে নিয়েই ঘুরতে যেতে চাইছি।
-মেয়ে মানুষ, পাহাড়ে চড়বে? ঝর্ণা টর্ণায় কত রিস্ক জানিস? ঐদিন ও খৈয়াছড়ায় কত বড় একটা ছেলে মারা গেল।
মা ছেলে কত টুকু বড় হাত দিয়ে মেপে দেখালেন।
-আচ্ছা তাহলে সমুদ্রে যাই, কক্সবাজার।
-স্পিডবোটে উঠিস না যেন। কয়েকদিন আগেও….
মা আরো একটা মৃত্যুর খবর শোনাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি মাকে থামালাম।
-দেখেন। পুরো বাংলাদেশের মানুষ যাচ্ছে ঘুরতে। যার মৃত্যু লিখা আছে তার মৃত্যু হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। মা চুপ করে চুলো গুঁতাতে লাগলেন।
-কিন্তু তোর ছুটি?
-বস ছুটি দিয়েছে।
-আচ্ছা যা তাহলে। আল্লাহর হাওলা।
বলেই মা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। আমি ক্যাবলা টাইপ মুখভঙ্গি করে বললাম, “এখনি যাচ্ছি না আমি। কাল সকালে বের হব আমরা। বাবাকে বলেন একটু”
“আচ্ছা”
রাতে খাবার টেবিলে বাবার সভাপতিত্বে আমরা সবাই খাবার খাচ্ছি। বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর তার বক্তব্য শুরু করলেন।
-যাবি, ঠিক আছে, কিন্তু খেয়াল রাখা জরুরি যে এসব ভ্রমণে অনেক বিপদ আসে।
-যেভাবে বিপদের নাম নিচ্ছেন, ফেসবুকের মত যদি মেনশন সিস্টেম থাকত তবে এতক্ষণে বিপদ আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করত।
বাবা ফেসবুক মেনশনের বিষয়টি ধরতে পারলেন না। ছোট ভাই আর নীরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমরা যতক্ষণে খাওয়া শেষ করলাম ততক্ষণে আমাদের ভাত কম, বাবার উপদেশ গেলা হয়েছে বেশি। আর সেটা এত বেশী যে বদহজম হওয়ার দশা। যাহোক, খাবার টেবিলে এই সিদ্ধান্ত মোটামুটি চূড়ান্ত হল যে আমরা মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছি। যদিও বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম, কিন্তু তার চেয়ে বেশি অজানা এক আনন্দ ছিল। এই আনন্দ টা বিয়ের আগে সব পুরুষের মধ্যে বিরাজ করে, সে জানেনা আনন্দ টা কেমন, কিন্তু সে অনুভব করে এটাই একমাত্র স্বর্গীয় আনন্দ। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্তও আনন্দ টা ছিল, ঘুমাতে যাওয়ার সময় সেটা স্তিমিত হয়ে গেল। আজও খাটের বাম পাশে শুতে হবে।
(চলবে…..)
-Asif Mahmud
(১)
শ্বশুর বাড়ি দুদিন বেড়িয়ে ফিরে এসেছি। প্রথমত ফর্মালিটির ডোজ এত বেশি হয়ে গেছিল যে বউয়ের সাথেও ফর্মাল আচরণ শুরু করে দিয়েছিলাম। বউ রুমে ঢুকলে আমি দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করি, বউ আমাকে “পানির গ্লাস টা দাও তো একটু” বললে আমি দুহাতে গ্লাস টা ধরে সসম্মানে বাড়িয়ে দেই, বউ রোমান্টিক কিছু বলতে চাইলে আমি শ্বশুরের সাথে কথা বলার স্টাইলে তার সাথে কথা বলে ফেলি। ভাববেন না এসব ইচ্ছে করে করছি। বিয়ের চক্করে এই কয়দিন যে পরিমাণ ফর্মালিটির ডোজ পড়েছে সেটা সাপোজিটরের থেকেও বেশি তীব্র।
শুধুমাত্র এজন্য যে শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি সেটা নয়, আরো দুটি কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মায়ের হুঁশিয়ারি। মা বলেছেন শ্বশুর বাড়িতে বেশী থাকলে নাকি আদর কমে যায়। তাই আদরের মাত্রা টা সুষম রাখতে পালিয়ে এসেছি। আর অন্য কারণ টি হল, ছুটি আছে আর অল্প কদিন। এরপর ঢাকায় ফিরতে হবে, চাকরি সামলাতে হবে। বাড়ি ফিরতেই শুরুতেই বাবার সাথে দেখা, বাবার মাথা বেশ শুকনো শুকনো লাগছে। অর্থাৎ কয়েকদিন তেলের মালিশ বন্ধ আছে বোধহয়। মনে হল বাবার প্রেশারের আমার সাথেই কানেকশন, আমি থাকলেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাবার প্রেশার উঠে যায়।
বাবা সামনে পড়ে যেতেই নীরা পা ছুঁয়ে সালাম করল। অর্থাৎ নীরার ফর্মালিটির ডোজ শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মনে হল একটা ছেলের ফর্মালিটির মধ্যে থাকতে হয় ক’টা দিন মাত্র, তাতেই এত বিরক্তি! আর একটা মেয়েকে সারাজীবন ফর্মালিটির বেড়াজালে থাকতে হয়, কেমন বোধ করে ওরা! এসব ভাবতেই নিজেকে নারীবাদী নারীবাদী মনে হতে লাগল, তাই তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করলাম।
-মাথা ঝাঁকাচ্ছিস কেন?
বাবা এটাও খেয়াল করে ফেলেছেন।
-এমনি। ঘাড় একটু সোজা করে নিলাম।
-তোর ঘাড় জীবনেও সোজা হবেনা।
বাবা এই কথা বলে মূহুর্তেই কেটে পড়লেন। বাবার কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। তিনি সুকৌশলে আমাকে অপমান করেছেন। আমিও “হেটার্স রা কত কথাই বলবে!” টাইপ একটা ভাব নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
ঘরে ঢুকতেই মা ছুটে আসলেন। মায়ের চেহারা ইমোশনাল, দেখে মনে হচ্ছে আমি বিশ বছর পরে এসেছি আর বিশ বছর ধরে মা রেডিওতে “খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে” গান শুনছিলেন। মা আসতেই নীরা ফর্মালিটি সেরে নিল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মা আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর নীরা কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আমাকে আর পাত্তাই দিলেন না, অর্থাৎ “ইটস গার্লস টাইম!” আমিও ঘরে বসে রইলাম, একে একে চাচাতো ভাইরা আসল, আর আমি তাদের গল্প শোনালাম শ্বশুরবাড়ির। প্রত্যেকটা গল্পের মূলভাব একই, “আর যাই হোক, জীবনে বিয়ে করিস না”।
(২)
নীরা আমার উপর রেগে আছে। আমি নাকি চাচাতো ভাইবোন দের কাছে শ্বশুর বাড়ির বদনাম করেছি। কথাটা আংশিক সত্য, কারণ আমি শ্বশুর বাড়িতে ভয়ংকর ফর্মালিটিস গুলোর আলোচনা করতে গিয়ে হয়ত দুয়েকটা কথা বদনামি টাইপের বলে ফেলেছি। যেমন শ্বশুরের কথা বলার মাঝখানে ভাত মুখে পুরে দেয়ার কথাটা বলে ফেলেছি। এতে সবাই খুব হাসাহাসি করেছে, এটা বোধহয় বেচারির খারাপ লেগেছে। গাল ফুলিয়ে বসে আছে তখন থেকে।
-কি হয়েছে বলবা তো?
-কিছু হয়নি।
-তাহলে গাল ফুলিয়ে আছ কেন?
-আমার গাল এমনই।
-না। এমন না, একটু বর্ধিত ফোলা মনে হচ্ছে।
নিরা ফিক করে হেসে দিল। বাবা-মা সবসময় আমাকে বলতেন আমি বোকা বোকা কথা বলে লোক হাসিয়ে বেড়াই। আজ হঠাৎ করেই বোকামির প্রতি আবারো খুব গর্ব হচ্ছে। একটা বিজ্ঞাপন ছিল, “দাগ থেকে যদি দারুন কিছু হয় তাহলে তো দাগ ই ভাল”। আমিও তাই ভাবছি, বোকামি থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তাহলে তো বোকামি ই ভাল। বোকামি আমাকে নীরা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, আবার এ বোকামি ই নীরার মুখে ফুটিয়েছে হাসি, আর কি চাই! নীরার হাসি অসম্ভব সুন্দর, পৃথিবীতে সব সুন্দরী মেয়ের হাসি সুন্দর হয় না, যেসব মেয়ের হাসি সুন্দর তারা রুপবতী না হলেও প্রচণ্ড মায়াবী। আর নীরা দুটোই, রূপবতী ও, মায়াবতী ও। আমি হলফ করে বলতে পারি যদি পৃথিবীর সব ছেলেরই একটা করে নীরা থাকত, তবে সবাই ই বোকা হওয়ার যুদ্ধে নেমে পড়ত।
-কি ভাবছ এভাবে উদাসীন হয়ে?
-ভাবছি মা-কে কিভাবে বলব ঢাকা চলে যাওয়ার ব্যাপারে।
-কেন? যেতে তো হবেই। মা তো জানেন ই।
-তাও ফর্মালি বলার একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না।
-ফর্মালি কেন? মা ছেলের মধ্যে আবার ফর্মালিটি কি?
-তাও ঠিক। বিয়ের পর থেকে এতসব ফর্মালিটি দেখতে দেখতে এখন মাথাজুড়ে ফর্মালিটি ঘুরছে শুধু।
নীরা জবাব দিল না। অবশ্য আমার কথাটার জবাব আমি নিজেও জানিনা। মায়ের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম, বিষয়টা মা কে জানানো দরকার।
(৩)
আমার কথা শুনে মায়ের চোখ কপালে উঠে গেল।
-বিয়ের মাত্র দুদিন হল, এখন থেকেই আলাদা থাকার কথা বলছিস?
-মা! আমি কি বললাম আর আপনি কি বুঝলেন? আলাদা কেন থাকব? ঢাকায় যাব না আমি? চাকরি করা লাগবে না? বাবার রিটায়ারম্যান্ট পর্যন্ত আপনাদের কে তো নিয়ে যেতে পারছিনা, আর নীরারও তো ঢাকাতেই…
-ঠিক আছে। যা তোরা।
মা মুখ গোমরা করে বললেন। মায়ের বোধহয় স্বপ্ন ছিল শাবানার মত কোন পূত্রবধু। যে সংসারটাকে সোনার সংসার বানিয়ে দেবে। রোজ ভাল ভাল রান্না করবে, বিদ্যুৎগতিতে ঘরের কাজকর্ম করবে, সুযোগ করে আবার শাশুড়ির চুলে তেল মেখে দেবে, আবার শ্বশুরের ওজুর পানি গরম করে দিবে। আর এদিকে নীরা শিক্ষিতা মেয়ে, চাকরি পেয়েছে ঢাকায়, সে তো আর ঘরে বসে থাকবে না। মায়ের স্বপ্ন ও পূরণ হল না। তবে একসাথে থাকাই যায়। বাবাকে বলেছিলাম এ ব্যাপারে, বাবা রিটায়ারম্যান্টের জন্য অপেক্ষা করছেন, চার বছর বাকি আর। আর তাছাড়া এমনিতেও তিনি গ্রাম ছাড়তে নারাজ। নাহয় আমারও স্বপ্ন ছিল পুরো পরিবার একসাথে থাকব। নীরা রোজ ঘরের রান্না না করুক, ছুটির দিনে কিংবা অবকাশ পেলেই রান্নাঘরে ঢুকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়া রান্না করবে, মা প্রশংসা না করতে চেষ্টা করেও পারবেন না। কিংবা অফিস শেষে বাসায় এসে এক কাপ চা বানিয়ে বাবাকে দিয়ে আসবে। সময় করে কখনো মায়ের চুল আঁচড়ে দেবে। কিন্তু পরিস্থিতির জন্য সেটা আর সম্ভব হল না।
-সারাজীবন খাটো আর খাটো। আর কি জীবনে!
মা গুনগুন করে বলছেন, এটাকে অনেকটা ঘ্যানঘ্যান বলা যায়। এটা সত্যি যে মা অনেক খেটেছেন এ জীবনে, তাঁর ও অবসরের প্রয়োজন খানিকটা।
-একটা বুয়া জোগাড় করে দিব মা?
-বুয়ার রান্না খাব আমরা? এতটাও খারাপ দিন আসেনাই।
-কেন? বুয়া কি মহিলা না? সে রান্না জানেনা?
-তুই বুঝবিনা। যেমন তেমন করে রান্না করে এরা।
-আচ্ছা রান্না টা নাহয় আপনি করলেন, বাকি কাজ গুলা বুয়া করবে, সহযোগিতা হবে না? পরিশ্রম কমবে আপনার।
মা কিছু বলছেনা। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিলাম। একটা বুয়ার খোঁজ করতে হবে তাড়াতাড়ি। তাতে যদি মায়ের কিছুটা অবসর মেলে আর দুয়েক ঘণ্টা বেশি সিরিয়াল দেখতে পারেন। অবশ্য আজকাল সিরিয়াল দেখা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন, যার প্রধান কারণ বাবার মাত্রাতিরিক্ত বকাবকি। বাবার ধারণা এসব সিরিয়াল থেকে মানুষের মধ্যে কুটিলতা বিস্তার করছে। মা অবশ্য বাবার সাথে তর্কে যান মাঝেমাঝে কিন্তু বাবার সাথে তর্কে পেরে ওঠা সহজ না তাই আত্মসমর্পণপূর্বক কয়েকটা সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়েছেন।
এদিকে আমার বুয়া খোঁজাখুঁজির খবর বাবা পর্যন্ত পৌঁছার পরপর ই বাবা হুংকার ছাড়লেন।
-আকামের আর জায়গা পাস না। এখনকার বুয়াদের বিশ্বাস আছে? চুরি করবে, ডাকাতি করবে, খুন করবে।
-চুরি করবে বুঝলাম। শেষের দুটো কিভাবে?
-এইসব বুয়াদের লিংক থাকে ডাকাতদের সাথে। আর রহমানের মা কে যে বুয়া খুন করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছিল ভুলে গেছিস তুই?
বাবার যুক্তিতে কোন ফাটল নেই। আমি চুপ করে রইলাম। বাবা তর্কে জিতে বিজয়ী ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, মায়ের কপালে আর সুখ আসল না।
(৪)
আমরা এভাবে ঢাকায় চলে গেলে সবাই কি ভাববে তা নিয়ে নীরার চিন্তার অন্ত নেই।
-মা আমাকে খুব খারাপ ভাববে। বলবে এসব আমার ই কীর্তিকলাপ।
-আরে মা এটা ভাবতে যাবে কেন? এতদিন আমি ব্যাচেলর বাসায় ছিলাম, বুয়ার রান্না খেতাম, এলোমেলো লাইফ, এখন বউ থাকবে। মায়ের তো টেনশন উলটো রিডিউস হবে।
-সেটা না। মায়ের একটা প্রত্যাশা আছে না? বউ ঘরে থাকবে, তাঁকে হেল্প করবে এই টাইপ কিছু। মুখে না বললেও মনে মনে তো অনুভব করেন।
আমি মনে মনে বললাম, মনে মনে না, মা মুখেও আমাকে এটাই বলেছে। তবে নীরার চিন্তাভাবনা দেখে মুগ্ধ হলাম অনেক। মেয়েরা সাধারণত নিজের টা ভাবে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কথা ভাবার সময় কোথায়, কিন্তু নীরা ভাবছে, এবং অনেক গভীরভাবে ভাবছে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি এতেই ওর প্রতি সন্তুষ্ট। আমি নীরাকে অভয় দিলাম, বললাম, “মা কে আমি বুঝিয়ে বলেছি, তুমি ভেব না”। এতে নীরা বোধহয় কিছুটা সাহস পেল।
এদিকে চাচাতো ভাইরা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে হানিমুন অর্থাৎ মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার জন্য। আমার অফিসের ছুটি শেষ হয়ে আসছে, আর তাছাড়াও এসবে আমার প্রচণ্ড অনীহা। একটা লজ্জাকর ব্যাপার ও জিনিসটা। মানে জিনিসটা এমন যে সবাই জানে আমরা কি জন্য যাচ্ছি, ওপেন সিক্রেট। কিন্তু তাও আমরা কেমন সুশীল সেজে বলছি, “ঘুরতে যাচ্ছি” বত্রিশটি দাঁত কেলিয়ে। আমি খুব শক্তভাবে বলে দিলাম, “না হবেনা। এসবে নাই আমি” বলেই উঠে চলে এলাম।
এদিকে বসকে একটা ফোন করা জরুরি বলে বোধ হল। দাওয়াত করেছিলাম বিয়েতে, তিনি ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি। ফোন দিচ্ছি বেশ ভালবাসা থেকে এমন না, ফোন দিচ্ছি কারণ বসের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে হয় উপরে উঠতে গেলে। তাকে দেখতে বিচ্ছিরি লাগলেও বলতে হবে “আপনাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে স্যার, মনে হচ্ছে ত্রিশ বছরের কোন যুবক”
-আরে কি যে বল? ত্রিশ বছরের নাহয় পাঁচ-ছ বছর বেশী হবে।
মনে মনে বলছিলাম, “ষাটোর্ধ বুড়া ষাঁড়, নিজেকে জোয়ান সাজাচ্ছে!” বসকে ফোন দিয়ে কানে ফোন ধরে বসে রইলাম। এই মূহুর্ত টা নার্ভাস মূহুর্ত। ক্রিং করে যখন আওয়াজ টা হয় তখন কেমন বুক ধক ধক করে ওঠে, ইচ্ছে হয় ফোন কেটে দিই।
-হ্যালো!
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার!
আমার এই সালাম টা তার পছন্দ না। তার মতে এই সালাম টা শুনলে নাকি মক্তব পড়ুয়া ছোট বাচ্চাদের মত শোনায়। কিন্তু সালাম তো এভাবেই দিতে হয়, যে যা বলুক তাতে কি। তবে আজ তিনি বেশ ফুরফুরা মেজাজে আছেন বলে মনে হল। সালাম নিয়ে কিছু বললেন না। সালাম নেয়ার সময় কিন্তু নিজের স্টাইল ধরে রাখলেন।
-ওয়ালাইকুম স্লাম!
-স্যার কেমন আছেন?
-হ্যাঁ ভাল আছি। আপনার কি অবস্থা আসিফ সাহেব? বিয়েশাদি তো করলেন? কেমন অনুভূতি।
আজ তিনি অতিরিক্ত কথা বলছেন। অন্যদিন দুয়েকটা ছোট ছোট কথা বলেন তাও গম্ভীর ভাবে। আজ বোধহয় কোন কারণে খুব খুশি আছেন।
-জি স্যার ভাল আছি আলহামদুলিল্লাহ। স্যার বিয়ে করা আর অফিস করার মাঝে তেমন পার্থক্য নেই, ওখানেও ফর্মাল থাকতে হয়, এখানেও।
-ভাল বলেছেন? আপনার স্ত্রী কেমন আছে? খুশি তো?
-জ্বি ভাল আছে। তবে খুশি কিনা জানিনা। মিশ্র অনুভূতি, প্রতি মূহুর্তে তার অনুভূতি বদলাচ্ছে।
-হা হা হা। মাত্র তো শুরু। তো হানিমুনে যাবেন না?
বসের এই প্রশ্নে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলব বুঝতে না পেরে বললাম, “স্যার আমি তো অফিসে জয়েন করছি পরশু থেকে”
-আরে বিয়ে করলেন দুদিন হল। পরশু থেকে অফিস জয়েন করার কি প্রয়োজন? ছুটি লাগলে বলেন। হানিমুনে যান, ঘুরে আসেন কোথাও থেকে। ইয়ং মানুষ, পরে আর এ সুযোগ পাবেন নাকি।
-জ্বি স্যার। সত্য বলেছেন। তবে কি যাব স্যার?
-অবশ্যই যাবেন। আজই চলে যান। আপনার ছুটির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-জ্বি। থ্যাংকিউ স্যার।
-ওকে বাই।
বস ফোন রেখে দিলেন। ছুটি মঞ্জুরের আনন্দ ও ছিল, আবার হানিমুনে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করার লজ্জা আর ভীতি দুই ই ছিল।
(৫)
-নীরা, বস ছুটি দিয়েছেন হানিমুনে যাওয়ার জন্য।
-কিসের জন্য?
-শুনেছোই তো। কনফিউজ করছো কেন। এই শব্দ টা একবার বলতেই আমার জান ছুটে গেছে।
-কি বলবে মানুষ?
-সেটা তো আমিও ভাবছি। কিন্তু আর কখনো সুযোগ পাব নাকি একসাথে নির্বিঘ্নে সময় কাটানোর। তাই বলছিলাম আরকি।
আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললাম। নীরা বোধহয় বুঝতে পারল আমি লজ্জা পাচ্ছি।
-আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু সবাইকে কিভাবে বলবে?
আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি আমার পরিবারের কাছে বিশেষত বাবার কাছে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে হলে মায়ের মাধ্যমেই করেছি। যেমন টাকার প্রয়োজন পড়লে মা কে গিয়ে চুপিচুপি বলতাম, “মা আমার কিছু টাকা লাগবে”। মা বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিতেন। আজ ঢাকা যাওয়ার ব্যাপার টাও মাকে বললাম। কিন্তু হানিমুন শব্দটা মায়ের সামনে কি করে উচ্চারণ করব তা-ই ভেবে পাচ্ছিনা। তাও সাহস সঞ্চয় করে এগুলাম।
মা চুলোয় ভাত চড়িয়েছেন সবে। আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসলাম।
-মা! অনেকদিন কোথাও ঘুরা হয়না।
মা আমার কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
-ইয়ে, বলছিলাম কোথাও থেকে গিয়ে ঘুরে আসি। মানে পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র কতকিছু আছে না দেখার?
-মাত্র বিয়ে করলি, ঘরে বউ, এখন তুই ঘুরতে যাচ্ছিস?
মা অবাক হয়ে তাকালেন। আশ্চর্য! আমি কি বলতে চাইছি মা কি একটুও বুঝতে পারছে না!
-আমি বউকে নিয়েই ঘুরতে যেতে চাইছি।
-মেয়ে মানুষ, পাহাড়ে চড়বে? ঝর্ণা টর্ণায় কত রিস্ক জানিস? ঐদিন ও খৈয়াছড়ায় কত বড় একটা ছেলে মারা গেল।
মা ছেলে কত টুকু বড় হাত দিয়ে মেপে দেখালেন।
-আচ্ছা তাহলে সমুদ্রে যাই, কক্সবাজার।
-স্পিডবোটে উঠিস না যেন। কয়েকদিন আগেও….
মা আরো একটা মৃত্যুর খবর শোনাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি মাকে থামালাম।
-দেখেন। পুরো বাংলাদেশের মানুষ যাচ্ছে ঘুরতে। যার মৃত্যু লিখা আছে তার মৃত্যু হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। মা চুপ করে চুলো গুঁতাতে লাগলেন।
-কিন্তু তোর ছুটি?
-বস ছুটি দিয়েছে।
-আচ্ছা যা তাহলে। আল্লাহর হাওলা।
বলেই মা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। আমি ক্যাবলা টাইপ মুখভঙ্গি করে বললাম, “এখনি যাচ্ছি না আমি। কাল সকালে বের হব আমরা। বাবাকে বলেন একটু”
“আচ্ছা”
রাতে খাবার টেবিলে বাবার সভাপতিত্বে আমরা সবাই খাবার খাচ্ছি। বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর তার বক্তব্য শুরু করলেন।
-যাবি, ঠিক আছে, কিন্তু খেয়াল রাখা জরুরি যে এসব ভ্রমণে অনেক বিপদ আসে।
-যেভাবে বিপদের নাম নিচ্ছেন, ফেসবুকের মত যদি মেনশন সিস্টেম থাকত তবে এতক্ষণে বিপদ আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করত।
বাবা ফেসবুক মেনশনের বিষয়টি ধরতে পারলেন না। ছোট ভাই আর নীরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমরা যতক্ষণে খাওয়া শেষ করলাম ততক্ষণে আমাদের ভাত কম, বাবার উপদেশ গেলা হয়েছে বেশি। আর সেটা এত বেশী যে বদহজম হওয়ার দশা। যাহোক, খাবার টেবিলে এই সিদ্ধান্ত মোটামুটি চূড়ান্ত হল যে আমরা মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছি। যদিও বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম, কিন্তু তার চেয়ে বেশি অজানা এক আনন্দ ছিল। এই আনন্দ টা বিয়ের আগে সব পুরুষের মধ্যে বিরাজ করে, সে জানেনা আনন্দ টা কেমন, কিন্তু সে অনুভব করে এটাই একমাত্র স্বর্গীয় আনন্দ। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্তও আনন্দ টা ছিল, ঘুমাতে যাওয়ার সময় সেটা স্তিমিত হয়ে গেল। আজও খাটের বাম পাশে শুতে হবে।
(চলবে…..)
বউনামা! পর্ব-০৩
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
4:58 PM
Rating:

No comments