বউনামা! পর্ব-০৯
#বউনামা_৯
(১)
বিয়ের পর থেকে সব অভিজ্ঞতাই নতুন, ফর্মালিটির যাঁতাকলে যেমন পিষে যাবেন, তেমনি আবার সব নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হতে অস্বাভাবিক হয়ে পড়বেন। আর প্রথমবার বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা আসলেই অন্যরকম। আপনার মনে একই সাথে আনন্দ থাকবে, ভয় থাকবে, আবার থাকবে প্রশ্ন। এদিকে আমার আর নীরার টেস্ট সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ভালবাসি সাসপেন্স আর নীরা ভালবাসে স্পয়লার। আমি গল্পে টুইস্ট চাই, কিছু জিনিস অজানা থাকবে, সারপ্রাইজ থাকবে, যেমনটা আমার বিয়ের বেলায় হল। কিন্তু নীরা সম্পূর্ণ বিপরীত, ও আগে থেকে সব জানতে চায়। একটা মুভির শুরুতেই তার এন্ডিং এ কি হল জানতে চাওয়া চাই ই চাই। এরকম একটি ঘটনা এবারো ঘটল। তার খুব ইচ্ছে জানার যে আমাদের অনাগত সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে, ঐ যে বললাম স্পয়লার!
-আমার ইচ্ছে করছে এখনি আল্ট্রা করে জেনে ফেলি আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।
-না জানলে হয় না? একটা সারপ্রাইজ হত। আগে কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। বাচ্চা হওয়ার সময় স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আর ভেতর থেকে একটা মহিলা বের হয়ে বলত, “আলহামদুলিল্লাহ, ছেলে হয়েছে!” তখনি মা-বাবা প্রথম জানতে পারত যে তাদের ছেলে হয়েছে। কেমন সারপ্রাইজ, কত মজাদার!
-ওসব পুরনো দিন আছে নাকি? এখন তো ছ’মাস হলেই জানা যায় সে ছেলে নাকি মেয়ে। বাকি তিন-চারমাস স্বপ্ন বুনতে হবে না?
নীরার স্বপ্ন গুলো আমি জানি। যদি রেজাল্ট মেয়ে হয় তবে ঐদিন ই চলে যাবে মেয়ের জন্য আগাম শপিং করতে। ছোট ছোট জামা, স্কার্ট, চুলের জন্য ফিতা অথচ চুল ও থাকবে না। এরপর বেবি অয়েল, লোশন, ক্রিম এসব তো আছেই। এরপর কত রকম খেলনা। নীরার স্বপ্ন গুলো আমিও দেখি। কিন্তু আমি স্পয়লার চাচ্ছিনা। সারপ্রাইজ টা পেয়ে সাথে সাথে বাজারে ছুটব। তার আগে দুটো লিস্ট বানিয়ে রাখব। একটা ছেলের জন্য, আরেকটা মেয়ের জন্য। if আর else স্টেটমেন্টের মত কাজ করবে। যদি ছেলে হয়, ছেলের জন্য বানানো লিস্ট নিয়ে ছুটব, আর যদি মেয়ে হয়, মেয়ের জন্য বানানো লিস্ট নিয়ে ছুটব। এসব স্বপ্নের কথা ভাবার ফাঁকেই আমার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। প্রশ্নটা নীরাকে করব কি করব না ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার মাথায় কোন প্রশ্ন ঘুরলে সেটা না জিজ্ঞেস করে পারিনা। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
-নীরা, তোমার কয়মাস হয়েছে এখন?
নীরা আমার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। নীরার এক্সপ্রেশন এমন ছিল যেন আমি ম্যাথমেটিক্সের শিক্ষক হয়েও পীথাগোরাসের উপপাদ্য জিজ্ঞেস করছি। ওর এক্সপ্রেশনে খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। আমি তার চেয়ে বরং আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী গুগলকে প্রশ্নটা করা সমীচীন মনে করলাম।
(২)
এদিকে আমরা আপুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠেছি। ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস রওয়ানা হয়েছে। বাসে ওঠার আগে আমি বেশ কটা আচার কিনে নিলাম। বাসে উঠে আমি এবারো প্রতিযোগিতা করে জানালার সিট ধরার ইচ্ছে পোষণ করলাম, কিন্তু নীরার দিকে তাকিয়ে সিট ছেড়ে দিলাম। বেচারি এমনিতে মুখোশ করে আছে, তার উপর প্রেগনেন্সী, বমি হয়ে যেতে পারে। যদিও ওকে এখনো পর্যন্ত বমি করতে দেখিনি। বাস এগুচ্ছে, আর গাছপালা গুলো সব পেছন দিকে দৌড়াচ্ছে যেন। নীরা বসে বসে সেসব দেখছে, আর আমি দেখছি নীরা কে।
নীরা বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ করল দুটো উৎসুক চোখ তাকে দেখছে। ও বাচ্চাদের মত করে ওর হাত দিয়ে আমার চোখ ঢেকে দিল। কিন্তু ও তো জানেনা, আমি ওকে চোখ মেলে যতটা না দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি চোখ বুজলে। আমাদের লুকোচুরি খেলা আরো কিছুক্ষণ চলত যদি না বাসের টিকিট চেকার এসে গলা খাঁকারি দিত। ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাটাকে আচ্ছা করে শাসিয়ে দিই, “গলায় যখন এতই সমস্যা, কাশির শিরাপ খান না। আর নাহলে আদা দিয়ে চা খান, আমাদের রোমান্সের বারোটা বাজাচ্ছেন কেন, যত্তসব!” কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই খুবই বিনয়ী স্বভাবের হওয়ায় কণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছায় না এসব রাগ। এদিকে সে টিকিট চেক করে চলে গেল। আমি বাসের সিটে মাথা রেখে শুয়ে রইলাম। আরো কিছুক্ষণ কাটার পর কিছুটা জনসেবা করতে মন চাইল। এখানে জনসেবা বলতে একজনের সেবাই, আগে নিজের ঘরে আলো দিয়ে তবেই তো পর! ব্যাগ থেকে আচারগুলো বের করে নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
-ধরো, খাও। ভাল লাগবে, বমি হবেনা আর।
-আমার এমনিও বমি হয়না।
-এ অবস্থায় টক জিনিস ভাল্লাগে।
-তুমি কিভাবে জানো?
-মুভিতে দেখেছি।
-তুমি খাও।
-আমি কেন খাব?
- তোমার খাওয়া দরকার, তোমার বেশি বমি হয়। তোমাকে একটা নাম দেয়া দরকার, বমিরাজ!
বলেই নীরা হিহি করে হাসল। নামটা প্রচণ্ড বিচ্ছিরি, শুনেই আমার গা গুলিয়ে এল। এতক্ষণ আচারের কিয়দাংশ গলধঃকরণ করার আংশিক ইচ্ছে থাকলেও এখন সে ইচ্ছে সম্পূর্ণ চলে গেছে। আচার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। নীরা এখনো মুচকি মুচকি হাসছে। আমার গা জ্বলছে, খানিকটা রাগে, বাকিটা রোদে। বাসে বসতে হলে বৈজ্ঞানিক হিসেব নিকেশ করে বসতে হয়। আগে আমরা এমন করতাম, কোন পাশে রোদ পড়বে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে তবে সিট নিতাম। কিন্তু আজ হিসেব মিলে নি। তাই আজ রোদের পাশে পড়ে গেছি। এদিকে জ্যাম পড়ল, একেই বলে মরার উপর খাড়ার ঘা! রোদ এত বেশি ছিল যে আমার প্রচণ্ড মাথা ধরে গেল। মাথা ধরেছে তো ধরেছে, বমি বমি ভাব ও হচ্ছে। এদিকে আত্মসম্মান ধরে রাখতে গিয়ে আচার ও খাচ্ছি না। এভাবে আরো কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক হয়ে গেল, আমি আর টাল সামলাতে না পেরে বমি করে দিলাম। কোথায় নিজের গর্ভবতী বউয়ের খেয়াল রাখব, সেখানে নিজেই বমি করে জিহবা বের করে পড়ে রইলাম। এদিকে নীরা মন খারাপ করে আছে, ও ভাবছে ওর জন্যই এমনটা হয়েছে। মেয়েদের এই আরেক সমস্যা, যেকোন কিছু তারা নিজের দিকে টেনে নেবেই। বিয়ের পর একদিন হঠাৎ বলেছিলাম, কিছু ভাল লাগছে না। ব্যস! হয়ে গেল! সারাদিন এটা জপতে লাগল, “আমার জন্যই হয়েছে, আমি তোমাকে ভাল রাখতে পারিনা” ইত্যাদি ইত্যাদি। বমি করার পর লোকলজ্জা ভুলে ব্যাগ থেকে আচার বের করে ভাতের মত করে খেতে লাগলাম। এটা দেখে নীরার মুখে হাসি ফুটল। আমি আচার নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, নীরাও একটু নিল, আচারের প্যাকেট ও ভালবাসার সাক্ষী হয়ে গেল!
(৩)
আমরা ঢাকায় পৌঁছালাম বিকেল পাঁচটায়। টিটি পাড়া থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা চলে গেলাম ধানমন্ডি ১৫। বাসায় পৌঁছেই আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে বিছানার সাথে একেবারে লেপ্টে গেছি, এক বমিতেই এমন কাহিল!
এদিকে নীরা এসে কাপড় ছেড়েই ঘর ঝাড় দেয়া শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ওর এত কাজ করা ঠিক না। কিন্তু আমি ভীষন রকম অকর্মন্য আর অগোছালো, নীরা এসেই সব গুছিয়েছে, আমার জীবনটাকেও প্রায় গুছিয়েই দিয়েছে মেয়েটা। প্রত্যেক অগোছালো এবং সংসার সম্পর্কে উদাসীন পুরুষের জন্য হয় এমন একজন নারী দরকার যে খুবই সংসারী, একাই একটা সংসার ধরে রাখতে পারবে নয়ত এমন একজন, যে নিজেও সংসার সম্পর্কে উদাসীন, তখন সেটা হয়ে যাবে ভাসমান সংসার, দুজনেই ভাসবে। আমার ক্ষেত্রে প্রথমটা হয়েছে। নীরা কে সাহায্য করার প্রবল ইচ্ছায় আমি বিছানা থেকে উঠে কোনরকম সোজা হয়ে নিজের জামাকাপড় ছেড়ে আবার শুয়ে পড়লাম। নীরার কাজ কমিয়ে দিয়েছি, নাহয় আমার জামা কাপড় ছাড়ানো, ওসব গুছিয়ে রাখাও ওকেই করতে হত! এদিকে নীরা ঘর গুছিয়ে আমার পাশে এসে বসল।
-রাতে কি খাবে?
-বাসায় যা আছে তাই খাব। বাজারে যেতে পারব না।
আমি সেই মেস জীবন থেকেই বাজারের প্রতি খুবই অনীহা পোষণ করি। বাবা-মায়ের সাথে থাকতে কখনো বাজার করতে হয়নি, বাবাই করতেন সবসময়। মেসে গিয়ে বাজার নামক ভয়াবহ দায়িত্ব টি কাঁধে নেয়া শিখতে হয়েছে। তাও মেসে অনেক শান্তি ছিল, মাসে তিনদিন কিংবা চারদিন বাজার করতে হত। কিন্তু সাংসারিক জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে, বাজার নামক বিভীষিকা আমার উপর আপতিত হয়ে আমার জীবন টা বিষিয়ে দিচ্ছে।
মেসের মত করে বলতেও পারিনা, “প্লিজ, আজ অন্য কাউকে পাঠা, আজ ভাল লাগছে না”। সাংসারিক জীবনে আসার পর থেকে বাবার প্রতি আমার এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, আর কিছু না হোক, অন্তত এক দিন অন্তর বাজার করে আনার জন্য হলেও!
বাজার করা খুব যে দুঃসাধ্য তা কিন্তু না, মাছ বিক্রেতা বলবে মাছ ২২০ টাকা, আপনি বলবেন ২০০ তে দেন। শেষ পর্যন্ত আপনি কিনবেন ২১০ টাকায়। এরপর মহা আনন্দে যে মাছটি আপনি রুই মাছ ভেবে কিনে এনেছেন বাড়ি এসে শুনবেন সেটি মূলত কাতল মাছ কিংবা বিগ্রেড। এরপর বেগুন কিনতে গিয়ে পোকাওয়ালা বেগুন গুলো রেখে আপনি ভাল বেগুন গুলো উঠিয়ে দেবেন, কিন্তু ঠিক বাড়ি এসে দেখবেন দু থেকে তিনটি বেগুনে পোকা। এরপর আপনি মাংসের জন্য মাংসের মশলা কিনবেন কিন্তু জিরার গুঁড়া কিনবেন না, বাসায় এসে আপনাকে আবারো বাজারে যেতে হবে। কোন চাল কিনবেন তা সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই আপনার অর্ধেক মাস চলে যাবে। একদিন চাল কিনে নিয়ে দেখবেন খুব চিকন, খাওয়া যাচ্ছেনা, পরের দিন অন্য চাল কিনে নিয়ে দেখবেন, খুবই মোটা, গলা দিয়ে নামছে না। এভাবে মাসটা কেটে যাবে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরণের চাল যাচাই করতে করতে। অর্থাৎ বাজার করা আহামরি কঠিন কিছুই নয়। কিন্তু আমি বাজার করাকে ঘৃণা করি।
নীরা রান্না করতে চলে গেল। এদিকে আমি বসে বসে টিভি দেখতে লাগলাম। বহুদিন পর টিভিতে ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভিটি দেখে চোখ আটকে গেল। জোয়ান বয়সে অধিকাংশ ছেলেই এই মুভিটি দেখে বিপথে যায় আই মিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ আগ্রহী হয় আর নিজেদের জীবন কে ঠেলে দেয় এক বিভীষিকার দিকে। যাহোক মুভিতে কয়েকটা সিন দেখে সেটা আমার বেশ চমকপ্রদ লাগল আজ অনেকবছর পরও। আমি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে নীরার পেটে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে বললাম, “আল ইজ ওয়েল!” নীরা হিহি করে হেসে দিল। “আরে বোকা, বাচ্চার এখনো পা আছে নাকি যে কিক মারবে?”
আমি নীরার কথায় সত্যি সত্যি বোকা বনে গেলাম। তাড়াতাড়ি হাত গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এদিকে রান্নাঘরের মশলার গন্ধে আমার প্রবল এলার্জি। হাচ্চু দিতে দিতে রুমে গিয়ে বসে পড়লাম। আর নীরা কে ডাক দিয়ে বললাম, “বাচ্চার পা গজালে আমাকে ডাক দিও!”
রান্নাঘর থেকে আবারো হিহি আওয়াজ শোনা গেল।
(চলবে......)
(১)
বিয়ের পর থেকে সব অভিজ্ঞতাই নতুন, ফর্মালিটির যাঁতাকলে যেমন পিষে যাবেন, তেমনি আবার সব নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হতে অস্বাভাবিক হয়ে পড়বেন। আর প্রথমবার বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা আসলেই অন্যরকম। আপনার মনে একই সাথে আনন্দ থাকবে, ভয় থাকবে, আবার থাকবে প্রশ্ন। এদিকে আমার আর নীরার টেস্ট সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ভালবাসি সাসপেন্স আর নীরা ভালবাসে স্পয়লার। আমি গল্পে টুইস্ট চাই, কিছু জিনিস অজানা থাকবে, সারপ্রাইজ থাকবে, যেমনটা আমার বিয়ের বেলায় হল। কিন্তু নীরা সম্পূর্ণ বিপরীত, ও আগে থেকে সব জানতে চায়। একটা মুভির শুরুতেই তার এন্ডিং এ কি হল জানতে চাওয়া চাই ই চাই। এরকম একটি ঘটনা এবারো ঘটল। তার খুব ইচ্ছে জানার যে আমাদের অনাগত সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে, ঐ যে বললাম স্পয়লার!
-আমার ইচ্ছে করছে এখনি আল্ট্রা করে জেনে ফেলি আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।
-না জানলে হয় না? একটা সারপ্রাইজ হত। আগে কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। বাচ্চা হওয়ার সময় স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আর ভেতর থেকে একটা মহিলা বের হয়ে বলত, “আলহামদুলিল্লাহ, ছেলে হয়েছে!” তখনি মা-বাবা প্রথম জানতে পারত যে তাদের ছেলে হয়েছে। কেমন সারপ্রাইজ, কত মজাদার!
-ওসব পুরনো দিন আছে নাকি? এখন তো ছ’মাস হলেই জানা যায় সে ছেলে নাকি মেয়ে। বাকি তিন-চারমাস স্বপ্ন বুনতে হবে না?
নীরার স্বপ্ন গুলো আমি জানি। যদি রেজাল্ট মেয়ে হয় তবে ঐদিন ই চলে যাবে মেয়ের জন্য আগাম শপিং করতে। ছোট ছোট জামা, স্কার্ট, চুলের জন্য ফিতা অথচ চুল ও থাকবে না। এরপর বেবি অয়েল, লোশন, ক্রিম এসব তো আছেই। এরপর কত রকম খেলনা। নীরার স্বপ্ন গুলো আমিও দেখি। কিন্তু আমি স্পয়লার চাচ্ছিনা। সারপ্রাইজ টা পেয়ে সাথে সাথে বাজারে ছুটব। তার আগে দুটো লিস্ট বানিয়ে রাখব। একটা ছেলের জন্য, আরেকটা মেয়ের জন্য। if আর else স্টেটমেন্টের মত কাজ করবে। যদি ছেলে হয়, ছেলের জন্য বানানো লিস্ট নিয়ে ছুটব, আর যদি মেয়ে হয়, মেয়ের জন্য বানানো লিস্ট নিয়ে ছুটব। এসব স্বপ্নের কথা ভাবার ফাঁকেই আমার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। প্রশ্নটা নীরাকে করব কি করব না ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার মাথায় কোন প্রশ্ন ঘুরলে সেটা না জিজ্ঞেস করে পারিনা। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
-নীরা, তোমার কয়মাস হয়েছে এখন?
নীরা আমার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। নীরার এক্সপ্রেশন এমন ছিল যেন আমি ম্যাথমেটিক্সের শিক্ষক হয়েও পীথাগোরাসের উপপাদ্য জিজ্ঞেস করছি। ওর এক্সপ্রেশনে খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। আমি তার চেয়ে বরং আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী গুগলকে প্রশ্নটা করা সমীচীন মনে করলাম।
(২)
এদিকে আমরা আপুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠেছি। ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস রওয়ানা হয়েছে। বাসে ওঠার আগে আমি বেশ কটা আচার কিনে নিলাম। বাসে উঠে আমি এবারো প্রতিযোগিতা করে জানালার সিট ধরার ইচ্ছে পোষণ করলাম, কিন্তু নীরার দিকে তাকিয়ে সিট ছেড়ে দিলাম। বেচারি এমনিতে মুখোশ করে আছে, তার উপর প্রেগনেন্সী, বমি হয়ে যেতে পারে। যদিও ওকে এখনো পর্যন্ত বমি করতে দেখিনি। বাস এগুচ্ছে, আর গাছপালা গুলো সব পেছন দিকে দৌড়াচ্ছে যেন। নীরা বসে বসে সেসব দেখছে, আর আমি দেখছি নীরা কে।
নীরা বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ করল দুটো উৎসুক চোখ তাকে দেখছে। ও বাচ্চাদের মত করে ওর হাত দিয়ে আমার চোখ ঢেকে দিল। কিন্তু ও তো জানেনা, আমি ওকে চোখ মেলে যতটা না দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি চোখ বুজলে। আমাদের লুকোচুরি খেলা আরো কিছুক্ষণ চলত যদি না বাসের টিকিট চেকার এসে গলা খাঁকারি দিত। ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাটাকে আচ্ছা করে শাসিয়ে দিই, “গলায় যখন এতই সমস্যা, কাশির শিরাপ খান না। আর নাহলে আদা দিয়ে চা খান, আমাদের রোমান্সের বারোটা বাজাচ্ছেন কেন, যত্তসব!” কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই খুবই বিনয়ী স্বভাবের হওয়ায় কণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছায় না এসব রাগ। এদিকে সে টিকিট চেক করে চলে গেল। আমি বাসের সিটে মাথা রেখে শুয়ে রইলাম। আরো কিছুক্ষণ কাটার পর কিছুটা জনসেবা করতে মন চাইল। এখানে জনসেবা বলতে একজনের সেবাই, আগে নিজের ঘরে আলো দিয়ে তবেই তো পর! ব্যাগ থেকে আচারগুলো বের করে নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
-ধরো, খাও। ভাল লাগবে, বমি হবেনা আর।
-আমার এমনিও বমি হয়না।
-এ অবস্থায় টক জিনিস ভাল্লাগে।
-তুমি কিভাবে জানো?
-মুভিতে দেখেছি।
-তুমি খাও।
-আমি কেন খাব?
- তোমার খাওয়া দরকার, তোমার বেশি বমি হয়। তোমাকে একটা নাম দেয়া দরকার, বমিরাজ!
বলেই নীরা হিহি করে হাসল। নামটা প্রচণ্ড বিচ্ছিরি, শুনেই আমার গা গুলিয়ে এল। এতক্ষণ আচারের কিয়দাংশ গলধঃকরণ করার আংশিক ইচ্ছে থাকলেও এখন সে ইচ্ছে সম্পূর্ণ চলে গেছে। আচার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। নীরা এখনো মুচকি মুচকি হাসছে। আমার গা জ্বলছে, খানিকটা রাগে, বাকিটা রোদে। বাসে বসতে হলে বৈজ্ঞানিক হিসেব নিকেশ করে বসতে হয়। আগে আমরা এমন করতাম, কোন পাশে রোদ পড়বে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে তবে সিট নিতাম। কিন্তু আজ হিসেব মিলে নি। তাই আজ রোদের পাশে পড়ে গেছি। এদিকে জ্যাম পড়ল, একেই বলে মরার উপর খাড়ার ঘা! রোদ এত বেশি ছিল যে আমার প্রচণ্ড মাথা ধরে গেল। মাথা ধরেছে তো ধরেছে, বমি বমি ভাব ও হচ্ছে। এদিকে আত্মসম্মান ধরে রাখতে গিয়ে আচার ও খাচ্ছি না। এভাবে আরো কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক হয়ে গেল, আমি আর টাল সামলাতে না পেরে বমি করে দিলাম। কোথায় নিজের গর্ভবতী বউয়ের খেয়াল রাখব, সেখানে নিজেই বমি করে জিহবা বের করে পড়ে রইলাম। এদিকে নীরা মন খারাপ করে আছে, ও ভাবছে ওর জন্যই এমনটা হয়েছে। মেয়েদের এই আরেক সমস্যা, যেকোন কিছু তারা নিজের দিকে টেনে নেবেই। বিয়ের পর একদিন হঠাৎ বলেছিলাম, কিছু ভাল লাগছে না। ব্যস! হয়ে গেল! সারাদিন এটা জপতে লাগল, “আমার জন্যই হয়েছে, আমি তোমাকে ভাল রাখতে পারিনা” ইত্যাদি ইত্যাদি। বমি করার পর লোকলজ্জা ভুলে ব্যাগ থেকে আচার বের করে ভাতের মত করে খেতে লাগলাম। এটা দেখে নীরার মুখে হাসি ফুটল। আমি আচার নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, নীরাও একটু নিল, আচারের প্যাকেট ও ভালবাসার সাক্ষী হয়ে গেল!
(৩)
আমরা ঢাকায় পৌঁছালাম বিকেল পাঁচটায়। টিটি পাড়া থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা চলে গেলাম ধানমন্ডি ১৫। বাসায় পৌঁছেই আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে বিছানার সাথে একেবারে লেপ্টে গেছি, এক বমিতেই এমন কাহিল!
এদিকে নীরা এসে কাপড় ছেড়েই ঘর ঝাড় দেয়া শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ওর এত কাজ করা ঠিক না। কিন্তু আমি ভীষন রকম অকর্মন্য আর অগোছালো, নীরা এসেই সব গুছিয়েছে, আমার জীবনটাকেও প্রায় গুছিয়েই দিয়েছে মেয়েটা। প্রত্যেক অগোছালো এবং সংসার সম্পর্কে উদাসীন পুরুষের জন্য হয় এমন একজন নারী দরকার যে খুবই সংসারী, একাই একটা সংসার ধরে রাখতে পারবে নয়ত এমন একজন, যে নিজেও সংসার সম্পর্কে উদাসীন, তখন সেটা হয়ে যাবে ভাসমান সংসার, দুজনেই ভাসবে। আমার ক্ষেত্রে প্রথমটা হয়েছে। নীরা কে সাহায্য করার প্রবল ইচ্ছায় আমি বিছানা থেকে উঠে কোনরকম সোজা হয়ে নিজের জামাকাপড় ছেড়ে আবার শুয়ে পড়লাম। নীরার কাজ কমিয়ে দিয়েছি, নাহয় আমার জামা কাপড় ছাড়ানো, ওসব গুছিয়ে রাখাও ওকেই করতে হত! এদিকে নীরা ঘর গুছিয়ে আমার পাশে এসে বসল।
-রাতে কি খাবে?
-বাসায় যা আছে তাই খাব। বাজারে যেতে পারব না।
আমি সেই মেস জীবন থেকেই বাজারের প্রতি খুবই অনীহা পোষণ করি। বাবা-মায়ের সাথে থাকতে কখনো বাজার করতে হয়নি, বাবাই করতেন সবসময়। মেসে গিয়ে বাজার নামক ভয়াবহ দায়িত্ব টি কাঁধে নেয়া শিখতে হয়েছে। তাও মেসে অনেক শান্তি ছিল, মাসে তিনদিন কিংবা চারদিন বাজার করতে হত। কিন্তু সাংসারিক জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে, বাজার নামক বিভীষিকা আমার উপর আপতিত হয়ে আমার জীবন টা বিষিয়ে দিচ্ছে।
মেসের মত করে বলতেও পারিনা, “প্লিজ, আজ অন্য কাউকে পাঠা, আজ ভাল লাগছে না”। সাংসারিক জীবনে আসার পর থেকে বাবার প্রতি আমার এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, আর কিছু না হোক, অন্তত এক দিন অন্তর বাজার করে আনার জন্য হলেও!
বাজার করা খুব যে দুঃসাধ্য তা কিন্তু না, মাছ বিক্রেতা বলবে মাছ ২২০ টাকা, আপনি বলবেন ২০০ তে দেন। শেষ পর্যন্ত আপনি কিনবেন ২১০ টাকায়। এরপর মহা আনন্দে যে মাছটি আপনি রুই মাছ ভেবে কিনে এনেছেন বাড়ি এসে শুনবেন সেটি মূলত কাতল মাছ কিংবা বিগ্রেড। এরপর বেগুন কিনতে গিয়ে পোকাওয়ালা বেগুন গুলো রেখে আপনি ভাল বেগুন গুলো উঠিয়ে দেবেন, কিন্তু ঠিক বাড়ি এসে দেখবেন দু থেকে তিনটি বেগুনে পোকা। এরপর আপনি মাংসের জন্য মাংসের মশলা কিনবেন কিন্তু জিরার গুঁড়া কিনবেন না, বাসায় এসে আপনাকে আবারো বাজারে যেতে হবে। কোন চাল কিনবেন তা সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই আপনার অর্ধেক মাস চলে যাবে। একদিন চাল কিনে নিয়ে দেখবেন খুব চিকন, খাওয়া যাচ্ছেনা, পরের দিন অন্য চাল কিনে নিয়ে দেখবেন, খুবই মোটা, গলা দিয়ে নামছে না। এভাবে মাসটা কেটে যাবে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরণের চাল যাচাই করতে করতে। অর্থাৎ বাজার করা আহামরি কঠিন কিছুই নয়। কিন্তু আমি বাজার করাকে ঘৃণা করি।
নীরা রান্না করতে চলে গেল। এদিকে আমি বসে বসে টিভি দেখতে লাগলাম। বহুদিন পর টিভিতে ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভিটি দেখে চোখ আটকে গেল। জোয়ান বয়সে অধিকাংশ ছেলেই এই মুভিটি দেখে বিপথে যায় আই মিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ আগ্রহী হয় আর নিজেদের জীবন কে ঠেলে দেয় এক বিভীষিকার দিকে। যাহোক মুভিতে কয়েকটা সিন দেখে সেটা আমার বেশ চমকপ্রদ লাগল আজ অনেকবছর পরও। আমি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে নীরার পেটে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে বললাম, “আল ইজ ওয়েল!” নীরা হিহি করে হেসে দিল। “আরে বোকা, বাচ্চার এখনো পা আছে নাকি যে কিক মারবে?”
আমি নীরার কথায় সত্যি সত্যি বোকা বনে গেলাম। তাড়াতাড়ি হাত গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এদিকে রান্নাঘরের মশলার গন্ধে আমার প্রবল এলার্জি। হাচ্চু দিতে দিতে রুমে গিয়ে বসে পড়লাম। আর নীরা কে ডাক দিয়ে বললাম, “বাচ্চার পা গজালে আমাকে ডাক দিও!”
রান্নাঘর থেকে আবারো হিহি আওয়াজ শোনা গেল।
(চলবে......)
বউনামা! পর্ব-০৯
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
5:56 PM
Rating:

No comments