বউনামা! পর্ব-১০
#বউনামা_১০
(১)
ঢাকায় আমাদের জীবনটা ভীষণ অন্যরকম। দিনে দুজনের দেখাই হয়না, রাতে খাবার টেবিলে ফেইস টাইম হয়। অর্থাৎ বাবার সাথে আমার যেমন সম্পর্ক ছিল তেমন হয়ে গেছে। নীরা বাবার মত বিরক্তিকর আচরণ করেনা এটুকুই পার্থক্য! কাপল গোলস নামক অনেক পোস্ট হয়, যেখানে লিখা থাকে মেয়ের সকাল হবে ছেলের বুকে, ঘুম থেকে জেগেই ছেলে মেয়ের কপালে চুমু খাবে। এই কথাগুলোর উপর আমার আগেও তেমন বিশ্বাস ছিলনা, এখন তো পুরোপুরি উঠে গেছে।
আমাদের সকাল টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দান বলে মনে হয়। সকাল বেলা নীরা উঠেই আমাকে টানতে শুরু করে জাগার জন্য, আর মুখে ঐ একই লাইন, “অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে!” প্রতি সকালে এই লাইন শুনতে শুনতে কান পঁচে যাচ্ছে। আর আজকাল নীরা কিছুটা মায়ের ভূমিকা পালন করছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে আংশিক ঘ্যানঘ্যান শোনা যায়। সেই সাথে মহিলাদের চিরাচরিত স্বভাব, সময় বাড়িয়ে বলা। যখন কেবল আটটা বাজে তখন ভীষণ জোরে চেঁচাবে “দশটা বেজে গেছে, খেয়াল আছে তোমার?” কিন্তু আজকাল ঐ ট্রিক টা ধরে ফেলেছি, তাই ও যে টাইম টা বলে তার থেকে এক দেড় ঘণ্টা বিয়োগ করে সেটাকে মূল সময় হিসেবে ধরে তারপর ঘুম থেকে উঠি।
কিন্তু একদিন ভীষণ রকম বিপদে পড়ে গেছি এমন করতে গিয়ে, ঐ যে মিথ্যেবাদী রাখালের গল্পের মত। প্রতিদিনের মত ঐদিন ও দুঘণ্টা বিয়োগ করে শুয়েছিলাম, একটু পর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি সত্যিই নয়টা ত্রিশ! তড়িঘড়ি করে রেডি হতে গিয়ে এটা ওটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, পরে আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে নীরারও অফিসে দেরি হয়ে গেল। তাই এরপর থেকে নীরা যা ই সময় বলে, উঠে বসে থাকি। আমার এই সিন্সিয়ারিটি দেখে ঐদিন নীরা আমাকে জব্দ করার জন্য নামায পড়ে ঘুমানোর আধঘণ্টা পরেই জাগিয়ে দিল, আমি লাল চোখ নিয়ে তিনঘণ্টা বিছানায় বসে শুধু ভাবছিলাম কি প্রতিশোধ নেয়া যায়। কিন্তু একজন গর্ভবতী নারীর খেয়াল রাখতে হয়, যত্ন নিতে হয়, তাই নিজেকে সংযত করা ছাড়া উপায় ছিলনা।
সকালের নাস্তার টেবিলে আমাদের একজন আরেকজনের চেহারা দেখা হয়না। কারণ এমন দেখা যায়, হয়ত আমি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুটি চিবুচ্ছি কিংবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফাইল খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর নীরা যে কখন খেয়ে নেয় সেটা কখনো জানতেই পারিনা, বাকি সময়টা ওর রেডি হতেই কেটে যায়। যতক্ষণে আমি গোসল সেরে, রেডি হয়ে, নাস্তা করে, ব্যাগ গুছিয়ে নিই ততক্ষণেও দেখা যায় হয়ত নীরার হিজাব বাঁধা বাকি রয়ে গেছে। সকালে বের হতে অবশ্য আমরা একসাথেই বের হই, প্রায়ই আমরা বাসে উঠি, কখনো কখনো সিএনজি নিয়ে নেই। বাসে চড়ে কিংবা সিএনজি তে চড়ে একসাথে অফিসে যাওয়ায় আমি রোমাঞ্চ খুঁজে পাইনা। সারাজীবন বিয়ের পরের জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম এর চেয়ে একটুখানি উন্নত, অর্থাৎ খুব বেশি হলে বিশ ডিগ্রি পার্থক্যের সপ্ন ছিল। স্বপ্ন দেখতাম দুজন একসাথে নিজেদের গাড়ি করে অফিসে যাব, আমি ওকে নামিয়ে দিয়ে যাব, যাওয়ার সময় ও আমার গালে চুমু এঁকে দেবে।
মোটরসাইকেলে প্রেমিকাকে নিয়ে চড়ার স্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি, একটা গাড়ির স্বপ্ন দেখেছি খুব। খুব জমকালো গাড়ি না হয়ত, ছোট গাড়ি, খুব সাধারণ গাড়ি, কিন্তু আমার গাড়ি! বাবার সামান্য বেতনে সাইকেল ই ছিল সবচেয়ে বড় কোন বাহন যা আমরা এফর্ট করতে পারি, সেখানে গাড়ির স্বপ্ন দেখা গরীবের ঘোড়া রোগ সমতূল্য। ভেবেছিলাম বাপের যুগ তো গেল, নিজের যুগে যদি কিছু করতে পারি! কিন্তু এখন এসে বুঝতে পারছি, বাপ ভালই রেখেছিল আমাদের, আমরা হয়ত আমাদের সন্তানদের সাইকেলের স্বপ্ন ও দেখাতে পারব না। মধ্যবিত্তদের স্বপ্নগুলো থাকেই হয়ত ভাঙার জন্য। তবে আর যাহোক, গাড়িতে করে না হোক, বাসে চড়েও যদি নীরা কে অফিসে ড্রপ করতে পারতাম, তাও কিছুটা ভাল লাগত। কিন্তু আমার অফিস পড়ে নীরার অফিসের আগে, তাই প্রতিদিন নীরাকে রেখে আমাকেই আগে নেমে যেতে হয়। এ দুঃখ গাড়ি না থাকার চেয়েও বড় দুঃখ।
(২)
অফিসে থাকাকালীন সময়ে আমি নীরাকে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর ফোন দিই। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য।
-হ্যালো।
-নীরা ম্যাম আছেন?
-জ্বি আছেন।
-উনাকে একটু দিবেন?
-উনিই কথা বলছেন, কি বলবেন বলুন।
-আমার একটা বিশাল সমস্যা।
-কি সমস্যা?
-আমার হার্টে দুইটার জায়গায় একটা শব্দ হয়।
-মানে?
-ঐ যে! হৃৎপিন্ডে লাব-ডাব শব্দ হয়না? আমার হৃৎপিন্ডে শুধু ডাব হয়, লাব হয়না!
-আমাকে কি করতে হবে?
-আপনাকে একটু লাব দিতে হবে।
-বাসায় এসে দিলে হবেনা?
-না। এখনি লাগবে।
নীরা আওয়াজ একদম ছোট করে ফিসফিসিয়ে বলে, “আই লাভ ইউ!” আর এদিকে হৃৎপিন্ডে ‘ডাব’ টা হারিয়ে গেল, প্রতিটা স্পন্দনে শোনা গেল শুধু ‘লাব’!
এভাবে একটা ঘণ্টা পরপর নতুন নতুন রোগ নিয়ে ফোন করে প্রতিদিন জ্বালিয়ে ফেলি ওকে। অথচ কি আশ্চর্য, বিন্দুমাত্র ও রাগ করেনা মেয়েটা! রাতে এসে শুধু মিষ্টি একটা বিচার বিভাগ বসে, যেখানে আসামী আমি, বাদী নীরা, বিচারপতি ও নীরাই। বিচারকার্যের সম্পূর্ণ সময়টায় থাকে ভুবনমাতানো হাসি, আর মধুর মিথ্যে রাগ। এমন বিচারে আমি মৃত্যদন্ডও মানি।
রোজ দুপুরে খেতে বসে আমি প্রচণ্ড দোয়া করি নীরার জন্য, যখন অফিসের কাজের চাপ ঠেলে লাঞ্চ আওয়ারে টিফিন খুলে নিজের প্রিয় খাবারটি দেখি। তখন খুব ভাবি, কি করে পারে ও? রোজ সকালে উঠে ঘর পরিষ্কার, নাস্তা বানানো, রেডি হওয়া, আমার জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে সব কাজকর্ম করার পরও কি করে দুপুরের জন্য স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিনে দিয়ে দিতে হয় তা ওর থেকে শেখা উচিত। পতিব্রত স্ত্রী যে আদৌও হয়, ওকে না দেখলে কখনো মানতাম ই না। আসলে আজীবন তো হিন্দি সিরিয়ালের বউ ই দেখেছি, তাই হয়ত বউ সম্বন্ধে ধারণা এমন হয়ে গেছে।
(৩)
বেশিরভাগ দিনই আমি রাত ন’টার পর ফিরি। এর মধ্যেই নীরার রান্না, বাসনকোসন ধোয়া, এমনকি আধঘণ্টা টিভি দেখাও শেষ হয়ে যায়। আমি ফিরে কলিংবেল নাড়ার ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড পর দরজা টা খুলে যায়, আর একটা মিষ্টি হাসিসমেত প্রিয় মানুষটা দরজায় দাঁড়ানো থাকে। আর মুখে থাকে একটি ছোট্ট বাক্য, “বিচার আছে আজকে, আসেন!”
আমি হাসিমুখে কারাবরণ করতে এগিয়ে যাই। এমন মিষ্টি বিচারক যদি রায় দেয় আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে, তবে দড়ি কিনতে আমি নিজেই বাজারে যাব। বিচারের আগে আমার ফ্রেশ হওয়ার পর্ব, ওয়াশরুমের সামনে হাতে তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীরা। আমি তোয়ালে টা দেখেও এড়িয়ে যাই, নীরার শাড়ির আঁচল টা টেনে নিয়ে মুখ মুছে নিই। নীরা রেগে গিয়ে আঁচল সরিয়ে নেয়। “এই তোয়ালে কি জন্য এনেছি আর? নাও” এরপর তোয়ালে টা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরণীর পেছন পেছন খাবার টেবিলে যাই। খাবার টেবিলে মানুষ মাত্র দুজন, তাও মনে হয় ভরা মজলিশে খাবার খাচ্ছি। আসলে যেই মানুষটাকে প্রয়োজন সে পাশে থাকলে, মনে হয় পুরো পৃথিবী আছে। কিন্তু সে যদি না থাকে, তবে সব থেকেও শূন্য মনে হয়।
খাবার খাওয়ার মাঝেই গল্প হয়। কত গল্প, নীরার গল্প তো শেষই হয়না! আজ এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে, ঘটনাগুলো যতটা না গুরুত্ববহ তার চেয়ে বেশী গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে নীরার কণ্ঠে। কেননা এই কণ্ঠ একটা সূর, যে সূর বাজলে বাকি পৃথিবী অসার লাগে, মনে হয় এই কথাটুকু গুরুত্বপূর্ণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ!
রাতের খাবার শেষে আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসি। অফিসের অসমাপ্ত প্রজেক্ট গুলো বাসায় বসে করতে হয় বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ল্যাপটপ টা হাতে নিতে হয়। নীরা আমার পাশে বসে, কখনো কাঁধে মাথা রাখে, কখনো চুলে বিলি কাটে।
আমার আর নীরার মাঝে এই ল্যাপটপ টা খুব বেশি আসছে আজকাল। এই ল্যাপটপ টা না থাকলে আমাদের রোমান্স অনেক বেশী জমত! মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ল্যাপটপ টাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই, কিন্তু ল্যাপটপের দামটাও তো ভাবা লাগে। এদিকে ল্যাপটপ হাতেই আমার বিচারের শুনানী শুরু হয়ে যায়। আমি কবে একেবারে ওর বসের সামনেই ফোন দিয়ে দিয়েছি, ওকে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে ওর কলিগ শুনে ফেলেছে, আরো কত কি অভিযোগ! আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি, আমার পক্ষ থেকে কোন সাক্ষী কিংবা উকিল নেই, প্রেমের কোর্টে আবার ওকালতি হয় নাকি? শুনানি শেষ হয়ে যায়, এসে যায় রায় দেয়ার পালা, কিন্তু বিচারপতি রায় পড়তে পারেন না। বিচারপতির মনটা যে এই আসামী কিনে ফেলেছে, কি শাস্তি দেবে সে? কিন্তু এভাবে তো একটা মামলা নিষ্পত্তি হয়না, তাই আসামী হয়েও নিজেই নিজেকে একদফা কানমলা দিয়ে দেই, তারপর মুখটা একটু খানি বাড়িয়ে দেই। মুখে আলতো চুমুর স্পর্শ টা আস্কারা দিয়ে দেয়, এই আস্কারা উদ্ভুদ্ধ করে অপরাধে। আস্তে আস্তে নাহয় দাগী আসামী হয়ে উঠব, রোজ দাঁড়াবো কোর্টে, ভালবাসার অপরাধে ঝুলব নাহয় ফাঁসিতে।
(চলবে……)
বউনামা! পর্ব-১০
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
5:57 PM
Rating:

No comments