বউনামা! পর্ব-১১



#বউনামা_১১
(১)
সময় খুব দ্রুত কেটে যায়, এই যে দেখতে দেখতে আরো পাঁচটি মাস কেটে গেল। যেন পাঁচটি ঘণ্টার মত সময় গুলো পার হয়ে গেছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্র কে এই রকম পরিস্থিতিতে এসেই সত্যি বলে মনে হয়। একটি একটি করে দিন যাচ্ছে, নীরার মাঝে আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে একটু একটু করে, ‘আব্বু আব্বু!’ ডাক ঘনিয়ে আসছে ভেবেই আনন্দ হয় খুব! আর এদিকে নীরার পেট ফুলে গেছে, আমি ওকে ভীষণ জ্বালাই এটা নিয়ে।
-এই, তুমি মোটা হয়ে গেছো না অনেক? বাবার ভুড়ি ও তো এত বড় না।
আমার কথা শুনে নীরা হাসে, ভেতর থেকে পিচ্চি টাও বোধহয় হাসে। দুই হাসির শব্দের উপরিপাতনে নতুন শব্দ হয়, শব্দ না বলে সুর বলি, সেটাই বোধহয় বেশি স্যুট করবে।
যাহোক, গত কয়েক মাসে আমি গভীর পর্যবেক্ষণ করে বের করেছি, গর্ভাবস্থা নিয়ে প্রচলিত বহু কথাই মিথ্যে। প্রথমটি হচ্ছে থ্রি ইডিয়টস মুভিতে দেখানো বিষয়টি। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই নীরার পেটে হাত দিয়ে “আল ইজ ওয়েল” বলেছি, কিন্তু কখনো কোন লাথি অনুভব করিনি। সুতরাং এটি একটি ডাহা মিথ্যে, যাকে আমি এতদিন সত্যি ভেবে এসেছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে গর্ভবতী মেয়েরা নাকি খুব টক খায়। এই ধ্রুব সত্য কথাটিও মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়েছে আমার কাছে। এ পর্যন্ত আমি নীরার জন্য যত আচার এনেছি তা দিয়ে আমি কয়েকটা আচারের দোকান স্বাচ্ছন্দ্যে চালাতে পারতাম। কিন্তু নীরা বড়জোর দুয়েকটি প্যাকেট খুলেছে। বাকিগুলো আমার পেটে চালান হয়ে গেছে। আচার খেয়ে খেয়ে প্রচুর গ্যাস হয়েছে পেটে, তাই আচার আনা বন্ধ করে দিয়েছি।
এদিকে নীরা প্রেগন্যান্সি লিভ নিয়েছে, এখন সে বাসায় হ্যাপি গৃহিনী হিসেবে দিনাতিপাত করছে। নারীবাদী রা পারলে এই অংশটুকুরও বিরোধিতা করে। তারা হয়ত এটা বলতে পারে, একজন গর্ভবতী মহিলা কেন কাজে যেতে পারবেনা? হয়ত এটাও বলতে পারে, যেহেতু গর্ভবতী মহিলা কাজে যেতে পারবেনা, সুতরাং তাদের গর্ভবতী হওয়ার ও প্রয়োজন নেই! তবে নীরা কে আমি অন্য সবার সাথে মিলাতে পারিনা। যেখানে সারাদেশের মেয়েরা স্বামীর সাথে কাজ ভাগ করছে, সেখানে সে শুধু চেষ্টা করে কিভাবে আমার কাজ একটু কমিয়ে দেবে। আমাদের মাঝে প্রেমের প্রতিযোগিতা হয়। এ প্রতিযোগিতায় আমরা কেউই জিতি না, যেদিন একজন জিতে যাব, সেদিন প্রেম হেরে যাবে।
(২)
অফিস থেকে লিভ নেয়ার পর থেকে নীরা আদর্শ স্ত্রী এর ভূমিকায় চলে এসেছে। সারাদিন ঘরদোর গুছিয়ে, রান্না করে আমার অপেক্ষায় বসে থাকে। আমি আসলে আমার সেবায় নিয়োজিত হয়ে যায়। এদিকে মা আমাকে রোজ ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, নীরাদের বাড়ি থেকে কেউ এসে থাকবে কিনা ঢাকায়। এই জিনিসগুলো মা একান্তই আমাকে বলছেন। বলতে গেলে গোপনে জিজ্ঞেস করার মতই ব্যাপার। গোপন কথা বলতে হয় ফিসফিসিয়ে, তাই মা ফোনের মধ্যেও আমাকে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন। আমি বললাম, “ফোনের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলার কি আছে? এখানে তো শুধু আমি আর আপনি”। মা আমার কথায় কান দেন না, তিনি আগের মতই ফিসফিসিয়ে আমাকে কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দেন। মায়ের কথা বুঝিনা ঠিক, আমি ভেবেছিলাম মা কেই আসতে বলব। নীরার এই অবস্থায় কাউকে তো প্রয়োজন যে পাশে থাকবে। কিন্তু মা তার আগেই আমাকে অন্য হিন্ট দিয়ে দিয়েছেন। এবার নীরা কে জিজ্ঞেস করা ব্যতীত সমাধান পাচ্ছিনা মনে হচ্ছে।
-নীরা।
-জ্বি।
-আম্মা কি এসে থাকবেন কিছুদিন?
-কেন?
-না মানে তোমার এ অবস্থা। কেউ থাকলে ভরসা লাগে।
-আম্মু আসলে আব্বুকে কে দেখবে এখন? আব্বু বাড়িতে একা পড়ে যাবে তো।
নীরার এই কথার উত্তরে আমি কিছুটা চুপ হয়ে গেলাম। আসলেই তো, উনি কিভাবে আসবে, আমার শ্বশুর অসুস্থ মানুষ, তার একা থাকা সম্ভব নয়।
এদিকে আমি বিষয়টা আলোচনা করার জন্য মা জননীকে ফোন করলাম। কোন এক অজ্ঞাত কারণে মা ছেলের কনভারসেশন বউয়ের পেছনে হয়। এটার হেতু আমার জানা নেই, কিন্তু আমি বাই ডিফল্ট এই পদ্ধতি ই অনুসরণ করে আসছি সেই শুরু থেকেই। এটার উৎপত্তির কারণ জানা না থাকলেও এটার ফলাফল যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বউ শ্বাশুড়ির ঝগড়া তা উপলব্ধিযোগ্য। মা কে ফোন করে এ কথা বলতেই মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
-আসতে পারবে না কেন?
-আমার শ্বশুর অসুস্থ মানুষ। উনাকে রেখে কিভাবে আসবে?
-মেয়ের বাচ্চা হবে। আর সে আসতে পারবেনা? কেমন মা এটা!
অন্য মহিলার দোষ ধরা মহিলা দের স্বভাবগত সমস্যা। মা কে আমি মাত্রই বলেছি কেন তিনি আসতে পারবেন না, তাও মা একই প্রশ্নটাই রিপিট করেছেন, যেন আগের কথাটা তাঁর কানেই যায়নি।
-মা, আমি ভাবছি, নীরাকে দিয়ে আসব নাকি?
-তুই ও কি অফিস থেকে লিভ নিয়েছিস নাকি? ফাদার্স লিভ আছে?
-না না। আমি নীরা কে দিয়ে চলে আসব আরকি।
-থাকবি কেমনে? খাবি কি? রান্না কে করবে?
-দুপুরে বাইরে খেয়ে রাতে নাহয় রান্না করলাম।
-কর। যা ভাল বুঝস কর। বিয়ে করা বউ থাকতে ব্যাচেলর থাকবে……
মা আরো কিছু বললেন ঘ্যানঘ্যান করে যার বেশীরভাগ অর্থই আমি উদ্ধার করতে অসমর্থ হলাম। মা ভাবছে আমি এখানে কিভাবে খাওয়াদাওয়া করব আমি সেই চিন্তা করে আমি উদ্বিগ্ন, কিন্তু মা জানে না, আমি কি নিয়ে উদ্বিগ্ন! দেহ থেকে আত্মা আলাদা করে দিয়ে আমি খাওয়ার চিন্তায় উদ্বিগ্ন হব? রোজ রাতে ঘুমুতে গিয়ে খালি বুকের যে কষ্ট, খালি পেটের কষ্ট তার কিয়দাংশ ও না। দরজা খুলে প্রিয় মুখের হাসি না দেখে, আচলে মুখ না মুছে, তার মিষ্টি বকুনি না খেয়ে খাবার খেতে পারব? ফোন রাখার পর থেকে এসব ভাবতে ভাবতে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। তখন মনে হল, ওকে কিভাবে বলব এ কথা? নীরা খুবই ইমোশনাল। ইমোশনের ডিব্বা একবার খুলে গেলে ওকে শান্ত করতে পারব না। কিন্তু সমাধানে তো পৌঁছাতে হবে। ওকে জোর করে হলেও রাজি করাতে হবে। ভাবতেই অবাক লাগে, সংসারে সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমি ভেবেছিলাম আমাদের জীবনটা হবে ভীষণ স্মুথ। আমাদের দুজনের মাঝে যতটুকু ভালবাসা আছে তা যথেষ্ট একটা জীবন পার করার জন্য, হয়ত একটুখানি বাকিও থেকে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সমস্যাগুলো কাটাতেই প্রচুর বেগ পোহাতে হবে।
(৩)
আমি ভয়ে ভয়ে নীরার পাশে এসে দাঁড়ালাম। নীরা কাঁথা সেলাই করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। আমি অবাক হলাম, কাঁথাও সেলাই করতে পারে ও! আমি অপার এক মুগ্ধতার সাথে ওর পাশে বসলাম। কলম দিয়ে কাঁথার উপর বেশ সুন্দর একটা ফুল ডিজাইন করা। সেই কলমের দাগের উপর দিয়ে সুই চলছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কাঁথা বানানো চলছে, তার উপর মুখে হাসি আর গুনগুন গান। খুব খুশি আজ নীরা টা। এর মধ্যে ওকে কি করে বলি কথাটা।
-নীরা।
-জ্বি।
-আমি বলছিলাম কি, তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি। একা একা এখানে থাকাটা নিরাপদ না। দেখাশুনার প্রয়োজন আছে।
নীরা চুপ করে আছে। সুই এর বুনন থেমে গেছে, হাসি মিলিয়ে গেছে, গুনগুন বন্ধ হয়ে গেছে।
-নীরা, দেখো। এসময় তোমার দেখাশুনার জন্য কেউ থাকা খুব জরুরী। এ ছাড়া আর উপায় নেই।
-আর তোমার দেখাশোনা কে করবে?
নীরার চোখের কোণে একফোটা জলের আনাগোনা দেখলাম।
-তুমি ই করবা। তুমি দূরে গেলেও তো আমার পাশেই থাকো সবসময়।
-তুমি কিভাবে থাকবা? কি খাবা? রান্নাবান্না কে করবে?
-ওসব চিন্তা করো না, দুপুরে তো বাইরে থাকি, বাইরেই খেয়ে নিব। আর রাতে রান্না করে নিব।
নীরা এ কথা শুনেই কান্না করে দিল। আমি কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি নীরাকে কথা দিয়েছিলাম ওর চোখ থেকে কখনো এক ফোঁটা পানি ঝরতে দিব না। কিন্তু মুখের কথাগুলো কেমন যেন মুখেই রয়ে যায়! আর আজ ইমোশনের ডিব্বা খুলে গেছে, এ অশ্রুধারা কোন বাঁধ দিয়েও দমিয়ে রাখা যাবেনা।
-এখনো তো অসুবিধা হচ্ছেনা। আমি একাই পারছি সব করতে। আর কিছুদিন পরে নাহয় যাই?
ছলছল চোখের আকুতি কে প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু প্রেমের প্রতিযোগিতায় যে অংশ নিয়েছি, হারতে পারব না। ওকে কাছে পাওয়ার জন্য ওর ক্ষতি তো করতে পারিনা। আমি নিষ্ঠুরের মত বলে দিলাম, “না। আমরা কালই যাচ্ছি”
নীরা মাথা নিচু করে রইল। আমি চোখের পানি আড়াল করতে সরে পড়লাম। পুরুষদের কাঁদতে নেই, কান্না এক ভীষণ রকম দুর্বলতা।
(৪)
প্রতিটি মেয়েই নিজেকে সামলে নেয়ার এক অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। নীরার এই ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সকাল হতেই নীরাকে বেশ হাসিখুশি পেলাম। কিন্তু হাসিখুশি চেহারা টার পেছনে যে কান্না লুকিয়ে আছে, হাজার পর্দা দিয়েও কি সেটা লুকোনো যাবে। আমি বুঝতে পারি, তাও না বোঝার ভান করি। জীবন একটা নাটক, আমরা সবাই অভিনয় করছি। প্রেমিক-প্রেমিকা সম্পর্কে জড়ানোর দুবছর পর সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেও অভিনয় করে যায়, অনুভূতিশূন্য হৃদয় নিয়ে মুখে বলে, “খুব ভালবাসি তোমায়!” জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষগুলো হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায়, মুখে বলে, “ভাল আছি!” অথচ ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া! দুনিয়া মাতিয়ে রাখা মানুষগুলো কখনোই পারেনা নিজেকে মাতিয়ে রাখতে। মানুষকে প্রচণ্ড হাসানো মানুষটা কখনোই পারেনা নিজেকে হাসাতে। যার হাজারটা বন্ধু, সেও ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসেই খুব একা পড়ে যায়। জীবনটা এমনি। সবাই এখানে অভিনেতা। জীবন যদি সিনেমা হত, আমরা সবাই অস্কার পেতাম! আজ দুজনের মাঝে একহাত দূরত্ব, এইটুকু দূরত্বেও হাজারটা পর্দা পড়ে গেল। কিন্তু চাওয়া দুজনের একটাই, “ও যেন ভাল থাকে!”
নীরা ব্যাগ গুছিয়ে নিল, আজ আর ওর তৈরি হতে সময় লাগল না। ব্যাগ গুছিয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো”। এই একটি শব্দে পাহাড়সম অভিমান, কষ্ট, কান্না মিশে আছে। বুকের মাঝখান টায় কেমন যেন একটা ব্যাথা অনুভব হল। মনে হয় ছোট্ট একটা জায়গা জুড়ে কিছু যেন কামড়ে ধরে আছে। এটাই বোধহয় বেদনা! লোকে বলে বেদনার রঙ নীল। আসলে কি তাই? বেদনার নির্দিষ্ট কোন রঙ থাকতে পারেনা। যখন মানুষ কষ্টে থাকে তখন সব রঙই বেদনাময়!
দুজন বেরিয়ে পড়লাম। টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলাম। আজ আর নীরা জানালার বাইরে তাকাল না। বাইরের গাছগুলো বোধহয় অভিমান ও করল খানিকটা! আকাশের গুমোট ভাব মেঘই বলে দিচ্ছে। বাতাস বইল কেমন শুকনো। পাখিগুলোও ঝাঁক বেঁধে উড়ল না। সব ফুল যেন ঝরে গেছে! প্রকৃতি আজ অনশন করেছে। সবাই যেন বলছে, “আজ নীরার মন খারাপ!”
(চলবে………)
বউনামা! পর্ব-১১ বউনামা! পর্ব-১১ Reviewed by গল্প প্রেমিক on 5:58 PM Rating: 5

No comments

হৃদয়স্পর্শী গল্প

হৃদয়স্পর্শী গল্প