একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০২
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছিনা। কেন বলতে
পারছিনা জানিনা। বাকশক্তিই যেন হারিয়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে আমার। আমাকে
এভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি এবার বললো,
-আমি কি আসবো ভেতরে? নাকি, আসলে পড়ার ডিস্টার্ব হবে?
সুমু চুপ করে রইলো। ও অপেক্ষা করছে আমিই কিছু বলি কিনা। কিছু বলছিনা দেখে সুমু বললো,
-স্যার, ওকে ভেতরে আসতে বলবো কি?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-হ্যা, বলো! এতে পারমিশন নেয়ার কি আছে। আসতে বলো।
কথাগুলো বলে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়লাম। মেয়েটি এসে সুমুর বাম পাশে বসলো। দুজনেরই সেইম ড্রেস। বলতে, দুজনের পরনেই থ্রিপিস। গাঢ় নীল রংয়ের। সাদা ওড়না। জুতোজোড়াও এক! আর গলার গলার স্বর, সেটাও এক! এত মিল মানুষের হয় কি করে? কিন্ত, এদের মধ্যে ঠিক কার সাথে আমার ফ্লেক্সিলোডের দোকানে সাক্ষাৎ হয়েছিলো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা।
নাহ, এভাবে হেরে গেলে চলবেনা। গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে হবে আমায়। যেভাবেই হোক আমার জানতেই হবে এদের মধ্যে সেসময় কে ঐ দোকানে ছিলো। তবে, সে রহস্য উদঘাটনের জন্য আমার আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলোনা। একটি কল আসলো ঐ মেয়েটির ফোনে। আমি এখনো ওর নাম জানতে পারিনি। মেয়েটি বললো,
-এক্সকিউজ মি স্যার, ক্যান আই পিকআপ দ্যা কল?
আমি,
-ইয়াহ শিউর।
ফোন রিসিভ করলো ও। ওপাশ থেকে কে কি বললো শুনিনি। শুনতে না পাওয়ারই কথা। কিছুক্ষণ চুপচাপ ও শুধু কথা শুনলো। তারপর বলতে লাগলো,
-শোন জেসিয়া, তুই এসব নিয়ে একদম ভাববিনা। কতজনকে এভাবে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছি তার কোন হিসেব নেই। কাল কলেজে এসব নিয়ে কথা হবে। আর আমার ফোনে টাকা বা মিনিট কিছুই ছিলোনা তাই ঐসময় কল ব্যাক করতে পারিনি। একটু আগে মিনিট কার্ড নিয়েছি। কিছু মন করিসনা। এখন রাখছি। বাই।
ফোনে কথা বলা শেষ করে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
-সরি স্যার। আসলে, আমার এক বান্ধবী একটা প্রবলেমে ফেসে গেছে। এজন্য ফোনটা পিকআপ করতে হলো। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!
আমি,
-নাহ, আমি কিছু মনে করিনি। তা, আপনারা দুজনই কি পড়বেন নাকি শুধু একজন?
মেয়েটি বললো,
-শুধু সুমু পড়বে। আমি বাইরে পড়ি।
আমি,
-ওহ আচ্ছা।
ও চলে গেলো এবার। আমি পড়াতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার আসলো সে। এবার হাতে ট্রে। তাতে বিস্কুট, পানি আর কফি।
মেয়েটি,
-নিন স্যার, আগে গরম গরম কফি নিন আর বলুন কেমন হয়েছে।
আমি একগাল হেসে দিয়ে বললাম,
-শুধু যে আমার জন্যেই আনলেন, আপনাদের জন্যে আনেননি যে।
মেয়েটি,
-আপনি নিন তো।
কফিতে এক চুমুক দেয়ার পর, 'হুমম, বেশ ভালো হয়েছে কফিটা। আপনি বানিয়েছেন নাকি?'
জিজ্ঞেস করলাম নাম না জানা সেই নীল পরীকে। আমার কথা শুনে হেসে দিলো সে। মাথা নাড়িয়ে জানালো, 'জ্বী, আমিই বানিয়েছি।' কফির প্রশংসা করায় বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। মেয়েরা এমনই হয়। ওদের হাতের রান্না করা কিছু খেয়ে যদি কেউ প্রশংসা করে তাহলে পরবর্তীতে যখনই সুযোগ পাবে তখনই তাকে কিছুনা কিছু খাওয়াতে চাইবেই। এটা ওদের জাতিগত স্বভাব। পরীক্ষা করেও দেখতে পারেন নিজের আশেপাশের এমন মেয়েদের উপর।
এমন সময় খালা আসলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন,
-মেডাম এসেছেন। ড্রয়িংরুমে আপনাদের সবাইকে ডেকেছেন।
ভদ্র মহিলার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। দেখিনি এখনো। কথা বলে মনে হয়েছে খুব ভালো মনের মানুষ। এবার আমরা সবাই চলে গেলাম ড্রয়িংরুমে যেখানে তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষায় বসে ছিলেন। সুমু উনার পাশে গিয়ে বসলো। সুমুর বোন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বসতে বলায় আমি তাদের পাশের সোফায় বসলাম। এবার ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,
-নাতাশা, দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো!
এতক্ষণে জানলাম ঐ নীল পরীর নাম নাতাশা। তবে অবাক হলাম, ও একেবারে আমার গাঁ ঘেষে এসে বসে পড়ায়। এমনটি করায় সুমু আর নাতাশার মধ্যে আমি তাৎক্ষণিক চক্ষু লড়াই দেখতে পেলাম। চক্ষু লড়াই আবার কি? হ্যা, আমি ঠিকই বলছি। সুমু চোখে চোখে যেন কি বললো নাতাশাকে। নাতাশাও পাল্টা জবাব দিলো। সুমু আবার কি যেন বললো। নাতাশাও জবাব দিলো। বিষয়টি ভদ্রমহিলার নজর এড়ালো না। তিনি বললেন,
-সুমু! নাতাশা! হচ্ছেটা কি এখানে। আমাকে দেখতে পাচ্ছোনা নাকি?
ব্যাস, এক ধমকেই ওদের লড়াই থেমে গেল। তবে, ওদের চোখের ভাষাগুলো বুঝতে পারিনি আমি। লড়াই করেছে তাই হয়ত বুঝতে পারিনি। তবে, শুনেছি, প্রেমিক-প্রেমিকারাও নাকি চোখে চোখে কথা বলে। শুধু যে কথাই বলে তা নয়। একজনের চোখের দিকে তাকালে নাকি আরেকজন সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে-ওপারে কি আছে না আছে সবই দেখে ফেলতে পারে। যদিও এখনো প্রেম-টেম করিনি তবে, বন্ধুদের মুখে ওসব শুনি।
এবার ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তা, কেমন লাগলো পড়িয়ে?
আমি,
-জ্বী, খুব ভালো লেগেছে।
ভদ্রমহিলা,
-আমার এই দুই মেয়েই। ওরাই আমার সব। ওদের বাবা দুবছর আগে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। বিজনেস যা রেখে গেছেন সেসব আমাকেই এখন দেখাশোনা করতে হয়। আমি ওদেরকে সময় দিতে পারিনা। তবে, আপনার কাছে রেগুলার শুধু সুমু পড়বে। আর নাতাশার যেদিন বাইরে পড়া থাকবেনা সেদিন আপনার কাছে পড়বে। আপনি থাকেন কোথায়?
আমি,
-এই তো পাশেই। জেনারেল হসপিটালের সামনে। বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ারে থাকি।
ভদ্রমহিলা,
-বাইরে গার্ডেনের দক্ষিণ পাশে আমাদের বেশ কয়েকটি ঘর খালি আছে। বলতে, আমরা আগে সেখানেই থাকতাম। তারপর যখন এটি বানানো হলো তখন থেকে শুধু পরিষ্কার করে রাখা হয়। কেউ থাকেনা সেখানে। আপনি চাইলে সেখানে উঠতে পারেন। আর সেখানে উঠলে আমি বেশ খুশিই হবো। মনে করবো, আমাদের পরিবারের আরেকজন সদস্য বাড়লো। কি, উঠতে কি কোন আপত্তি আছে?
আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এমন কিছু হয়ে যাবে। আমি বললাম,
-আমার কোন আপত্তি নেই। বরং এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হবে।
ভদ্রমহিলা,
-তাহলে তো হলোই হয়। তবে হ্যা, আপনি যেন এটা না ভাবেন যে আপনি এখানে আমাদের সাথে থাকবেন আর খাবেন বলে ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে পড়াতে হবে। আপনি বাইরে থেকে এসে যেটুকু সময় আর যেভাবে পড়াতেন এখানে থেকেও ঠিক সেটুকু সময় আর সেভাবেই পড়াবেন। ঠিক আছে?
আমি,
-জ্বী, ঠিক আছে।
ভদ্রমহিলা,
-আপনার কি বিকাশ নম্বর আছে?
আমি,
-জ্বী, আছে।
ভদ্রমহিলা,
-যে নম্বরে কথা বলেছিলাম সেটাই কি?
আমি,
-না। এটি আলাদা নম্বর।
ভদ্রমহিলা,
-নম্বরটি বলুন তো!
আমি এবার আমার দ্বিতীয় সিমের এগারোটি ডিজিট বললাম। নম্বরটি বলে শেষ করার পরই খেলাম একটা চিমটি! বাঁ হাতের কব্জির ঠিক উপরে চিমটিটা দিলো নাতাশা। আর বিড়বিড় করে বললো,
-কি মিস্টার, নম্বর যে ভাইরাল হয়ে গেল। কি করবেন এবার?
অনেক মেয়েরাই শখের বসে বা স্টাইলের জন্য নিজেদের নক বড় করে রাখে। ভাল্লুক, বিড়াল এগুলোর মতো। লম্বা নখ রেখে এরা যে শুধু স্টাইলই করে তা নয়। এরা যখন স্বজাতিদের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন এই নখগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায়। একে অন্যকে এগুলোর দ্বারা রক্তাক্ত করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনা। আর যদি সৌভাগ্যক্রমে কেউ এমন কোন মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পায় যার কিনা স্বীয় নখের দ্বারা যুদ্ধ করার অভ্যেস রয়েছে তাহলে তো কোন কথাই নেই। এই পুরুষকে দেখবেন তার বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই মুখের অবস্থা এমন হবে যে, মনে হবে, এই যেন কোন ট্যাফে ট্রাক্টর দিয়ে কেউ হালচাল করে গেছে। তাই সাবধান!
কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি সন্ধে হয়। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। ভদ্রমহিলা এবার আমার থাকার ঘর দেখিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা নাতাশাকেই দিলেন।
গার্ডেনে এলাম দুজন। আমি একদম চুপচাপ। আমাকে চুপচাপ দেখে নাতাশা বললো,
-কি ব্যাপার মিঃ সাইলেন্ট। একেবারে নিরব যে!
আমি,
-আমার নাম রিয়াদ, সাইলেন্ট নয়।
নাতাশা হেসে দিয়ে বললো,
-ওহ সরি মিঃ রিয়াদ। তা, চিমটিটা কেমন লেগেছিলো?
আমি,
-কিসের চিমটি?
নাতাশা,
-কেন, ব্যথা পাননি আপনি?
আমি,
-আরে আজব তো! কিসের চিমটি আর কিসের ব্যথা পাবো আমি?
নাতাশা এবার নিজের নখগুলো দেখতে দেখতে বললো,
-সত্যিই কি আপনি কিছুই টের পাননি?
আমি,
-কি জানি আপনি কিসব আজগুবি বকছেন। চলুন তো ঘর দেখাবেন আমায়।
নাতাশা এবার হকচকিয়ে গেল। কিছু বুঝতে পারছেনা ও। এমন চিমটি খাইনি কখনো। তবে, এবার ওকে এসব বলে উল্টো অবাক করে দিলাম। এবার আমরা ঘরে ঢুকলাম। এটিও বিল্ডিং। দুতলা। তবে, বিল্ডিংটি পুরনো নকশায় বানানো। এই পঞ্চাশ-ষাট দশকের হবে। বেডরুম, গেস্ট রুম, ওয়াশরুম, কিচেন, ড্রয়িংরুম, সবই দেখিয়ে দিলো ও। নিয়ে আসলো ছাদেও। দ্বিতীয় তলার রুমগুলোতে তালা দেয়া। নিচ তলায় আমাকে থাকতে হবে। ছাদ ব্যবহার করা যাবে।
ততক্ষণে সন্ধা নেমে গেছে। এগুলো পরিচর্যার জন্য লোক রাখা আছে। আধার নামছে দেখে চারদিকের সব লাইট অন করে দেয়া হলো। বেশ নিরিবিলি একটা পরিবেশ। নাতাশাদের ঘর থেকে এর দূরত্ব আনুমানিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ গজের মতো হবে।
আমি বললাম,
-সবই তো দেখালেন। এবার চলুন তাহলে।
নাতাশা,
-কেন, আমার সাথে সময় কাটাতে কি আপনার খারাপ লাগছে?
এধরণের প্রশ্নের জন্য আমি আদৌ প্রস্তত ছিলামনা। বললাম,
-নাহ, আসলে তা নয়। খারাপ লাগার কি আছে। সন্ধা নেমে গেছে। চলুন আমরা যাই!
নাতাশা,
-আপনি কি জোৎস্না ভালোবাসেন?
আমি চলে যাবার কথা বলছি আর ও আমার কাছে জানতে চাইছে আমি জোৎস্না ভালোবাসি কিনা! রীতিমতো অবাক হলাম। বললাম,
-ভেতরে অনুভূতি আছে অথচ জোৎস্না ভালোবাসেনা পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। জোৎস্নার সাথে মানুষের প্রেম তাদের প্রথম দেখা থেকেই।
এমন সময় আমাকে থামিয়ে দিয়ে নাতাশা বলে উঠলো,
-আমি যদি বলি ঠিক এভাবেই প্রথম দেখাতেই আমি কারোর প্রেমে পড়ে গিয়েছি তাহলে!
আমি,
-চাঁদের সাথে মানুষের প্রেম দূর থেকেই হয়। চাঁদের ছড়ানো জোৎস্নায় কবিরা তাঁদের ছন্দ খুঁজে পায়। হাজার বছর ধরে প্রেমিকেরা চাঁদকে পিয়ন হিসেবে ব্যবহার করে বসছে। তারা তাদের ভালোবাসার চুমু জোৎস্নার খামে পাঠায়। চাঁদ সেটা পৌঁছে দেয় প্রেমিকাদের কাছে। এভাবেই চলে প্রেমের বিনিময়। তবে, এসবই শুধু মনের ক্ষনিকের পাগলামো। দেখেননা, দিনের বেলায় সূর্যের আলোর জন্য চাঁদ তারকার দেখা মেলেনা। সূর্যের প্রখর আলোর কাছে যে চাঁদের আলো নিতান্তই অসহায় যেমনটি অভাবের কাছে প্রেম।
নাতাশা এবার বললো,
-তবে কি মানুষ প্রেমে পড়েনা কারোর?
আমি,
-আমি জানিনা আপনার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা কি। জানিনা আপনি প্রেম বলতে কি বুঝেন। আমি শুধু একটুই জানি, আমাদের জন্য প্রেম-ভালোবাসা নিতান্তই রূপকথার কল্পকাহিনীর মতো অবাস্তব।
নাতাশা,
-আর আমি যদি সেটা বাস্তব দেখিয়ে দিতে পারি তো?
আমি,
-কি বলতে চাইছেন আপনি?
নাতাশা এবার অকপটে বলে উঠলো,
-বিয়ে করবেন আমায়?
আমি,
-মাথা খারাপ আপনার?
নাতাশা,
-নাহ। আমার মাথা ঠিকই আছে। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। বলুন আমাকে বিয়ে করবেন কিনা?
আমি,
-আমি আপনার মায়ের থেকে এক্ষুনি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমার পড়ানোর স্বাদ মিঠে গেছে।
এই বলে আমি চলে আসছি এমন সময় নাতাশা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-কার থেকে বিদায় নিবেন আপনি? আমার মাকে তো ওরা সেই কবেই মেরে ফেলেছে।
থমকে গেলাম আমি। বিস্মিত হয়ে গেলাম। নাতাশা বললো কি এটা! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি কি ঠিকই শুনেছি নাকি ভুল?
--------চলবে--------
-আমি কি আসবো ভেতরে? নাকি, আসলে পড়ার ডিস্টার্ব হবে?
সুমু চুপ করে রইলো। ও অপেক্ষা করছে আমিই কিছু বলি কিনা। কিছু বলছিনা দেখে সুমু বললো,
-স্যার, ওকে ভেতরে আসতে বলবো কি?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-হ্যা, বলো! এতে পারমিশন নেয়ার কি আছে। আসতে বলো।
কথাগুলো বলে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়লাম। মেয়েটি এসে সুমুর বাম পাশে বসলো। দুজনেরই সেইম ড্রেস। বলতে, দুজনের পরনেই থ্রিপিস। গাঢ় নীল রংয়ের। সাদা ওড়না। জুতোজোড়াও এক! আর গলার গলার স্বর, সেটাও এক! এত মিল মানুষের হয় কি করে? কিন্ত, এদের মধ্যে ঠিক কার সাথে আমার ফ্লেক্সিলোডের দোকানে সাক্ষাৎ হয়েছিলো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা।
নাহ, এভাবে হেরে গেলে চলবেনা। গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে হবে আমায়। যেভাবেই হোক আমার জানতেই হবে এদের মধ্যে সেসময় কে ঐ দোকানে ছিলো। তবে, সে রহস্য উদঘাটনের জন্য আমার আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলোনা। একটি কল আসলো ঐ মেয়েটির ফোনে। আমি এখনো ওর নাম জানতে পারিনি। মেয়েটি বললো,
-এক্সকিউজ মি স্যার, ক্যান আই পিকআপ দ্যা কল?
আমি,
-ইয়াহ শিউর।
ফোন রিসিভ করলো ও। ওপাশ থেকে কে কি বললো শুনিনি। শুনতে না পাওয়ারই কথা। কিছুক্ষণ চুপচাপ ও শুধু কথা শুনলো। তারপর বলতে লাগলো,
-শোন জেসিয়া, তুই এসব নিয়ে একদম ভাববিনা। কতজনকে এভাবে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছি তার কোন হিসেব নেই। কাল কলেজে এসব নিয়ে কথা হবে। আর আমার ফোনে টাকা বা মিনিট কিছুই ছিলোনা তাই ঐসময় কল ব্যাক করতে পারিনি। একটু আগে মিনিট কার্ড নিয়েছি। কিছু মন করিসনা। এখন রাখছি। বাই।
ফোনে কথা বলা শেষ করে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
-সরি স্যার। আসলে, আমার এক বান্ধবী একটা প্রবলেমে ফেসে গেছে। এজন্য ফোনটা পিকআপ করতে হলো। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!
আমি,
-নাহ, আমি কিছু মনে করিনি। তা, আপনারা দুজনই কি পড়বেন নাকি শুধু একজন?
মেয়েটি বললো,
-শুধু সুমু পড়বে। আমি বাইরে পড়ি।
আমি,
-ওহ আচ্ছা।
ও চলে গেলো এবার। আমি পড়াতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার আসলো সে। এবার হাতে ট্রে। তাতে বিস্কুট, পানি আর কফি।
মেয়েটি,
-নিন স্যার, আগে গরম গরম কফি নিন আর বলুন কেমন হয়েছে।
আমি একগাল হেসে দিয়ে বললাম,
-শুধু যে আমার জন্যেই আনলেন, আপনাদের জন্যে আনেননি যে।
মেয়েটি,
-আপনি নিন তো।
কফিতে এক চুমুক দেয়ার পর, 'হুমম, বেশ ভালো হয়েছে কফিটা। আপনি বানিয়েছেন নাকি?'
জিজ্ঞেস করলাম নাম না জানা সেই নীল পরীকে। আমার কথা শুনে হেসে দিলো সে। মাথা নাড়িয়ে জানালো, 'জ্বী, আমিই বানিয়েছি।' কফির প্রশংসা করায় বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। মেয়েরা এমনই হয়। ওদের হাতের রান্না করা কিছু খেয়ে যদি কেউ প্রশংসা করে তাহলে পরবর্তীতে যখনই সুযোগ পাবে তখনই তাকে কিছুনা কিছু খাওয়াতে চাইবেই। এটা ওদের জাতিগত স্বভাব। পরীক্ষা করেও দেখতে পারেন নিজের আশেপাশের এমন মেয়েদের উপর।
এমন সময় খালা আসলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন,
-মেডাম এসেছেন। ড্রয়িংরুমে আপনাদের সবাইকে ডেকেছেন।
ভদ্র মহিলার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। দেখিনি এখনো। কথা বলে মনে হয়েছে খুব ভালো মনের মানুষ। এবার আমরা সবাই চলে গেলাম ড্রয়িংরুমে যেখানে তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষায় বসে ছিলেন। সুমু উনার পাশে গিয়ে বসলো। সুমুর বোন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বসতে বলায় আমি তাদের পাশের সোফায় বসলাম। এবার ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,
-নাতাশা, দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো!
এতক্ষণে জানলাম ঐ নীল পরীর নাম নাতাশা। তবে অবাক হলাম, ও একেবারে আমার গাঁ ঘেষে এসে বসে পড়ায়। এমনটি করায় সুমু আর নাতাশার মধ্যে আমি তাৎক্ষণিক চক্ষু লড়াই দেখতে পেলাম। চক্ষু লড়াই আবার কি? হ্যা, আমি ঠিকই বলছি। সুমু চোখে চোখে যেন কি বললো নাতাশাকে। নাতাশাও পাল্টা জবাব দিলো। সুমু আবার কি যেন বললো। নাতাশাও জবাব দিলো। বিষয়টি ভদ্রমহিলার নজর এড়ালো না। তিনি বললেন,
-সুমু! নাতাশা! হচ্ছেটা কি এখানে। আমাকে দেখতে পাচ্ছোনা নাকি?
ব্যাস, এক ধমকেই ওদের লড়াই থেমে গেল। তবে, ওদের চোখের ভাষাগুলো বুঝতে পারিনি আমি। লড়াই করেছে তাই হয়ত বুঝতে পারিনি। তবে, শুনেছি, প্রেমিক-প্রেমিকারাও নাকি চোখে চোখে কথা বলে। শুধু যে কথাই বলে তা নয়। একজনের চোখের দিকে তাকালে নাকি আরেকজন সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে-ওপারে কি আছে না আছে সবই দেখে ফেলতে পারে। যদিও এখনো প্রেম-টেম করিনি তবে, বন্ধুদের মুখে ওসব শুনি।
এবার ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তা, কেমন লাগলো পড়িয়ে?
আমি,
-জ্বী, খুব ভালো লেগেছে।
ভদ্রমহিলা,
-আমার এই দুই মেয়েই। ওরাই আমার সব। ওদের বাবা দুবছর আগে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। বিজনেস যা রেখে গেছেন সেসব আমাকেই এখন দেখাশোনা করতে হয়। আমি ওদেরকে সময় দিতে পারিনা। তবে, আপনার কাছে রেগুলার শুধু সুমু পড়বে। আর নাতাশার যেদিন বাইরে পড়া থাকবেনা সেদিন আপনার কাছে পড়বে। আপনি থাকেন কোথায়?
আমি,
-এই তো পাশেই। জেনারেল হসপিটালের সামনে। বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ারে থাকি।
ভদ্রমহিলা,
-বাইরে গার্ডেনের দক্ষিণ পাশে আমাদের বেশ কয়েকটি ঘর খালি আছে। বলতে, আমরা আগে সেখানেই থাকতাম। তারপর যখন এটি বানানো হলো তখন থেকে শুধু পরিষ্কার করে রাখা হয়। কেউ থাকেনা সেখানে। আপনি চাইলে সেখানে উঠতে পারেন। আর সেখানে উঠলে আমি বেশ খুশিই হবো। মনে করবো, আমাদের পরিবারের আরেকজন সদস্য বাড়লো। কি, উঠতে কি কোন আপত্তি আছে?
আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এমন কিছু হয়ে যাবে। আমি বললাম,
-আমার কোন আপত্তি নেই। বরং এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হবে।
ভদ্রমহিলা,
-তাহলে তো হলোই হয়। তবে হ্যা, আপনি যেন এটা না ভাবেন যে আপনি এখানে আমাদের সাথে থাকবেন আর খাবেন বলে ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে পড়াতে হবে। আপনি বাইরে থেকে এসে যেটুকু সময় আর যেভাবে পড়াতেন এখানে থেকেও ঠিক সেটুকু সময় আর সেভাবেই পড়াবেন। ঠিক আছে?
আমি,
-জ্বী, ঠিক আছে।
ভদ্রমহিলা,
-আপনার কি বিকাশ নম্বর আছে?
আমি,
-জ্বী, আছে।
ভদ্রমহিলা,
-যে নম্বরে কথা বলেছিলাম সেটাই কি?
আমি,
-না। এটি আলাদা নম্বর।
ভদ্রমহিলা,
-নম্বরটি বলুন তো!
আমি এবার আমার দ্বিতীয় সিমের এগারোটি ডিজিট বললাম। নম্বরটি বলে শেষ করার পরই খেলাম একটা চিমটি! বাঁ হাতের কব্জির ঠিক উপরে চিমটিটা দিলো নাতাশা। আর বিড়বিড় করে বললো,
-কি মিস্টার, নম্বর যে ভাইরাল হয়ে গেল। কি করবেন এবার?
অনেক মেয়েরাই শখের বসে বা স্টাইলের জন্য নিজেদের নক বড় করে রাখে। ভাল্লুক, বিড়াল এগুলোর মতো। লম্বা নখ রেখে এরা যে শুধু স্টাইলই করে তা নয়। এরা যখন স্বজাতিদের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন এই নখগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায়। একে অন্যকে এগুলোর দ্বারা রক্তাক্ত করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনা। আর যদি সৌভাগ্যক্রমে কেউ এমন কোন মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পায় যার কিনা স্বীয় নখের দ্বারা যুদ্ধ করার অভ্যেস রয়েছে তাহলে তো কোন কথাই নেই। এই পুরুষকে দেখবেন তার বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই মুখের অবস্থা এমন হবে যে, মনে হবে, এই যেন কোন ট্যাফে ট্রাক্টর দিয়ে কেউ হালচাল করে গেছে। তাই সাবধান!
কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি সন্ধে হয়। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। ভদ্রমহিলা এবার আমার থাকার ঘর দেখিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা নাতাশাকেই দিলেন।
গার্ডেনে এলাম দুজন। আমি একদম চুপচাপ। আমাকে চুপচাপ দেখে নাতাশা বললো,
-কি ব্যাপার মিঃ সাইলেন্ট। একেবারে নিরব যে!
আমি,
-আমার নাম রিয়াদ, সাইলেন্ট নয়।
নাতাশা হেসে দিয়ে বললো,
-ওহ সরি মিঃ রিয়াদ। তা, চিমটিটা কেমন লেগেছিলো?
আমি,
-কিসের চিমটি?
নাতাশা,
-কেন, ব্যথা পাননি আপনি?
আমি,
-আরে আজব তো! কিসের চিমটি আর কিসের ব্যথা পাবো আমি?
নাতাশা এবার নিজের নখগুলো দেখতে দেখতে বললো,
-সত্যিই কি আপনি কিছুই টের পাননি?
আমি,
-কি জানি আপনি কিসব আজগুবি বকছেন। চলুন তো ঘর দেখাবেন আমায়।
নাতাশা এবার হকচকিয়ে গেল। কিছু বুঝতে পারছেনা ও। এমন চিমটি খাইনি কখনো। তবে, এবার ওকে এসব বলে উল্টো অবাক করে দিলাম। এবার আমরা ঘরে ঢুকলাম। এটিও বিল্ডিং। দুতলা। তবে, বিল্ডিংটি পুরনো নকশায় বানানো। এই পঞ্চাশ-ষাট দশকের হবে। বেডরুম, গেস্ট রুম, ওয়াশরুম, কিচেন, ড্রয়িংরুম, সবই দেখিয়ে দিলো ও। নিয়ে আসলো ছাদেও। দ্বিতীয় তলার রুমগুলোতে তালা দেয়া। নিচ তলায় আমাকে থাকতে হবে। ছাদ ব্যবহার করা যাবে।
ততক্ষণে সন্ধা নেমে গেছে। এগুলো পরিচর্যার জন্য লোক রাখা আছে। আধার নামছে দেখে চারদিকের সব লাইট অন করে দেয়া হলো। বেশ নিরিবিলি একটা পরিবেশ। নাতাশাদের ঘর থেকে এর দূরত্ব আনুমানিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ গজের মতো হবে।
আমি বললাম,
-সবই তো দেখালেন। এবার চলুন তাহলে।
নাতাশা,
-কেন, আমার সাথে সময় কাটাতে কি আপনার খারাপ লাগছে?
এধরণের প্রশ্নের জন্য আমি আদৌ প্রস্তত ছিলামনা। বললাম,
-নাহ, আসলে তা নয়। খারাপ লাগার কি আছে। সন্ধা নেমে গেছে। চলুন আমরা যাই!
নাতাশা,
-আপনি কি জোৎস্না ভালোবাসেন?
আমি চলে যাবার কথা বলছি আর ও আমার কাছে জানতে চাইছে আমি জোৎস্না ভালোবাসি কিনা! রীতিমতো অবাক হলাম। বললাম,
-ভেতরে অনুভূতি আছে অথচ জোৎস্না ভালোবাসেনা পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। জোৎস্নার সাথে মানুষের প্রেম তাদের প্রথম দেখা থেকেই।
এমন সময় আমাকে থামিয়ে দিয়ে নাতাশা বলে উঠলো,
-আমি যদি বলি ঠিক এভাবেই প্রথম দেখাতেই আমি কারোর প্রেমে পড়ে গিয়েছি তাহলে!
আমি,
-চাঁদের সাথে মানুষের প্রেম দূর থেকেই হয়। চাঁদের ছড়ানো জোৎস্নায় কবিরা তাঁদের ছন্দ খুঁজে পায়। হাজার বছর ধরে প্রেমিকেরা চাঁদকে পিয়ন হিসেবে ব্যবহার করে বসছে। তারা তাদের ভালোবাসার চুমু জোৎস্নার খামে পাঠায়। চাঁদ সেটা পৌঁছে দেয় প্রেমিকাদের কাছে। এভাবেই চলে প্রেমের বিনিময়। তবে, এসবই শুধু মনের ক্ষনিকের পাগলামো। দেখেননা, দিনের বেলায় সূর্যের আলোর জন্য চাঁদ তারকার দেখা মেলেনা। সূর্যের প্রখর আলোর কাছে যে চাঁদের আলো নিতান্তই অসহায় যেমনটি অভাবের কাছে প্রেম।
নাতাশা এবার বললো,
-তবে কি মানুষ প্রেমে পড়েনা কারোর?
আমি,
-আমি জানিনা আপনার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা কি। জানিনা আপনি প্রেম বলতে কি বুঝেন। আমি শুধু একটুই জানি, আমাদের জন্য প্রেম-ভালোবাসা নিতান্তই রূপকথার কল্পকাহিনীর মতো অবাস্তব।
নাতাশা,
-আর আমি যদি সেটা বাস্তব দেখিয়ে দিতে পারি তো?
আমি,
-কি বলতে চাইছেন আপনি?
নাতাশা এবার অকপটে বলে উঠলো,
-বিয়ে করবেন আমায়?
আমি,
-মাথা খারাপ আপনার?
নাতাশা,
-নাহ। আমার মাথা ঠিকই আছে। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। বলুন আমাকে বিয়ে করবেন কিনা?
আমি,
-আমি আপনার মায়ের থেকে এক্ষুনি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমার পড়ানোর স্বাদ মিঠে গেছে।
এই বলে আমি চলে আসছি এমন সময় নাতাশা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-কার থেকে বিদায় নিবেন আপনি? আমার মাকে তো ওরা সেই কবেই মেরে ফেলেছে।
থমকে গেলাম আমি। বিস্মিত হয়ে গেলাম। নাতাশা বললো কি এটা! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি কি ঠিকই শুনেছি নাকি ভুল?
--------চলবে--------
একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০২
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:50 PM
Rating:

No comments