একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০১
ফ্লেক্সিলোডের দোকানিকে মেয়েটি তার ফোন নম্বর বলছে,
-জিরো, ওয়ান, সেভেন, ফাইভ-টু, নাইন-ওয়ান....
আমার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই মেয়েটি দোকানিকে বলে উঠলো,
-থাক মামা, রিচার্জ করবনা। আমাকে একটি মিনিট কার্ড দিয়ে দিন তো! দিনকাল আজ যা পড়েছে, ফ্লেক্সিলোড করিয়েও শান্তিতে ঘুমানো যায়না।
এসব কথায় আমার কিছু আসতো যেতোনা যদি না সে কথাগুলো বলতে বলতে আমার দিকে আঁড়চোখে বারবার তাকাতো। আমি ঢের বুঝতে পারলাম আমাকে রীতিমতো ইনসাল্ট করেছে সে। শুধু যে আমাকেই করেছে তা নয়, এ অপমান গোটা পুরুষ জাতির অপমান। 'ভাবে কি নিজেকে হু, দীপিকা পাড়ুকোন নাকি ঐশ্বর্যা রাই! আরে, ওরাও তো প্রেম, বিয়ে-শাদি করে বাচ্চাকাচ্চার মা হচ্ছে এবং হবে।'
কথাগুলো জোড়ে বলিনি। তবে, এই অল্প বয়সে মেয়ে মানুষের হাতে মার খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তাই কথাগুলো মনে মনেই নিজেকে নিজে বললাম।
দোকানি একটি মিনিট কার্ড দিলো তাকে। মেয়েটি দিলো একটি হাজার টাকার নোট। বিশ টাকার সদাই নিয়ে হাজার টাকার নোট দিলে যেকোন দোকানদারই আপনাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। তবে সেজন্য অবশ্যই আপনাকে হতভাগা পুরুষজাতির সদস্য হতে হবে। আর যদি মেয়ে মানুষ হন তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। নিজের দোকানে না থাকলে পাশের দোকান থেকে হলেও দোকানি আপনাকে খুচরা এনে দিবে!
হাজার টাকা দেয়ায় ঘটেছে বিপত্তি। দোকানির কাছে খুচরা নেই। পাশের দোকানও বন্ধ। দোকানি আর মেয়েটির মাঝে বিষয়টি নিয়ে কথোপকথন চলছে।
দোকানি,
-দেখুন, আমার কাছে খুচরা নেই। আপনি তো প্রায়সই আসেন। পরেরবার না হয় টাকাটা দিয়ে দিবেন।
মেয়েটি,
-না মামা, আমার খুচরা লাগবে। নয়ত পরে রিকশার ভাড়া দিব কি করে। আপনি দেখুন কোন ব্যবস্থা হয় কিনা।
দোকানি এবার অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালো। বললো,
-আপনার কি লাগবে ভাই!
মেয়েটি যেহেতু দোকানিকে মামা ডেকেছে এখন দোকানি যদি আবার আমাকে ভাই ডাকে তাহলে তো আমিও মেয়েটির মামা হয়ে যাব! তাই একটু রাগান্বিত স্বরেই বললাম,
-আমাকে ভাই নয় ভাগিনা ডাকুন মামা।
আমার মুখে এমন আজব কথা শুনে দোকানি কিছুটা অবাক হলো। বললো,
-হ্যা ভাগিনা, কি লাগবে?
আমি,
-এসেছিলাম ফ্লেক্সিলোড করতে তবে, দিনকাল যা পড়েছে তাতে ফ্লেক্সিলোড করলে নম্বর ভাইরাল হয়ে যায়। মেয়েরা বিরক্ত করে। শুধু মেয়েরা বিরক্ত করলে একটা কথা ছিলো, মেয়েদের অভিভাবকরাও ফোন দিয়ে বিরক্ত করে জানেন মামা!
দোকানি আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। যদিও আমার বা দিকে দুই ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। এ পোড়া আগুনের পোড়া নয়। এ পোড়া টিট ফর ট্যাটের পোড়া।
বিশ টাকার একটি মিনিট কার্ড নিলাম। খুচরা বিশ টাকা দিয়েও আলাদা আরো এক হাজার টাকার খুচরা দিয়ে দোকানিকে বললাম,
-এটা রাখুন মামা, বলা তো যায়না কখন কার কাজে আসে।
আজ মাসের এক তারিখ। টিউশনি করে নতুন আরেকটি টিউশনিতে যাচ্ছি। তাই পকেট গরম এখন। যদিও এটি সাময়িক সময়ের জন্য। থাকি বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ারে। পরিবার তেমন স্বচ্ছল নয়। এতদিন চারটে টিউশনি করতাম। আজ থেকে আরেকটা নতুন যোগ হলো। এছাড়াও পার্ট টাইম একটা ছোটোখাটো জব করি। সবমিলিয়ে মাস শেষে হাজার পনেরো হয়ে যায়। বাড়িতেও কিছু টাকা দিই।
আমাদের মতো শিক্ষিত যুবকদের মতো অসহায় প্রাণী পৃথিবীর বুকে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমি তাতে সন্দিহান। আর যদি সেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাদের দিন কাটাতে হয়। ভাবতে হয় নিজের শিক্ষাজীবন পরবর্তী চাকরী জীবনের কথা। চাকরী হবে কি হবেনা তা নিয়ে থাকতে হয় সংশয়ে। পরিবার আমাকে নিয়ে যে আশায় বুক বেঁধে আছে তার চিন্তা থাকে। আমি পারবো তো আমার পরিবারের আশা পূরণ করতে? আমি পারবো তো ছোট ভাইটার পড়াশোনা করাতে? বোনটার বিয়ে দিতে? বয়স্ক বাবা-মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলোর বেঁচে থাকার অবলম্বন হতে? এমন হাজারো চিন্তা সারাক্ষণ আমাদের খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। যা সৌন্দর্য আর চাকচিক্য তা শুধু দেহের বাইরেই। ভেতরে শুধু মরুভূমির মতো হাহাকার।
ফোনে বলা ঠিকানা অনুযায়ী বাসাটি খুঁজে পেলাম। দারোয়ানকে বাড়িওয়ালার নাম বলায় ভেতরে ঢুকতে দিলো। সদর দরজায় কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুলে দিলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। পরনে তাঁর পুরনো কাপড় তবে পরিস্কার। হাতে ওয়েট মপ। ফ্লোর মপ দিচ্ছিলেন হয়ত। আমাকে দেখে বললেন,
-আসুন স্যার!
আমি এর আগে এত বড়লোকের বাড়িতে টিউশনি করাইনি। মহিলাকে কিছু বললামনা। তাঁর দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি একটা হাসি দিলাম। মহিলা দরজা আটকে দিয়ে আমার পিছু পিছু আসলেন এবং গেস্ট রুম অবদি পৌঁছে দিলেন। বলে গেলেন যেন অপেক্ষা করি।
ঘড়ির কাটা তখন বিকাল সাড়ে চারটা। ফোনে যিনি আমার সাথে টিউশনির বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি একজন মহিলা। তার মেয়েকে পড়াতে হবে। একাদশ শ্রেণীতে নাকি পড়ে। বসে আছি আর ভাবছি, 'যাইহোক ভালোই হলো। এখানে টিউশনিটা ঠিকঠাক করতে পারলে হয়ত ভালো টাকা পাওয়া যাবে।' আসলে, আমরা সবাই টাকার কাঙ্গাল। আর হবোই বা না কেন? এই টাকা না থাকলে যে কারোর কাছেই কোন দাম পাওয়া যায়না। যার টাকা আছে তার সব আছে। এটাই রিয়েলিটি।
চারটা পঁয়তাল্লিশের দিকে ঐ মহিলা কল দিয়েছেন। টিউশনির বিষয়ে যার সাথে কথা হয়েছিলো আমার। রিসিভ করলাম।
আমি,
-আসসালামুআলাইকুম।
ওপাশ থেকে,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম। মিঃ রিয়াদ, আপনি কি এসেছেন বাসায়?
আমি,
-জ্বী, সাড়ে চারটায় এসেছি।
ভদ্রমহিলা,
-ওহ ভেরি গুড! আমার মেয়ে বাইরে গিয়েছে একটু। কথা হয়েছে আমার সাথে। ও পাঁচটার আগেই বাসায় ফিরবে। ফিরলে আপনি পড়ানো শুরু করে দিতে পারেন। আমি একটু বাইরে আছি। ছয়টার আগেই চলে আসবো।
আমি,
-আচ্ছা ঠিক আছে।
উনি রেখে দিলেন ফোনটা। ঘড়ির কাটা ততক্ষণে চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট। কলিং বেল বাজতে শুনলাম। একবার, দু'বার, পরপর তিনবার বাজার পরও কেউ দরজা খুলে দেয়নি। কলিং বেল অনবরত বেজেই চলেছে। এবার উঠে এগিয়ে গেলাম আমি। দরজা খুললাম।
কিন্ত একি! এ-তো দেখছি সেই মেয়ে! মেয়েটিও আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো! বললো,
-আপনি এখানে?
আমি,
-আমাকে টিউশনির জন্য ডাকা হয়েছে, এজন্যই। আপনি?
মেয়েটি,
-ওহ আচ্ছা, ভালো।
এই বলে মেয়েটি ভেতরের দিকে চলে গেল। আর কিছু বললোনা। আমিও কিছু বুঝতে না পেরে দরজা আটকে দিয়ে গেস্ট রুমে এসে বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর ঐ মহিলাটি আসলেন যার সাথে এসে প্রথম দেখা হয়েছিলো। আমাকে এসে বললেন,
-স্যার, আপামনি রিডিংরুমে অপেক্ষা করছেন। আপনি আসতে পারেন।
আমি বললাম,
-কোনদিকে সেটা?
মহিলা,
-আসুন আমার সাথে।
যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনি কি কাজ করেন এখানে?
মহিলা,
-জ্বী।
আমি,
- তা, আমি কি বলে ডাকবো আপনাকে?
মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে এবার হেসে দিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন তিনি এখানে কাজ করেন জেনেও আমি তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছি এবং তাঁর সাথে নম্র ভাবে কথা বলছি। তিনি হেসে বললেন,
-ডাকবেন যা খুশি।
আমি,
-ঠিক আছে। আজ থেকে আপনাকে আমি খালা বলেই ডাকবো।
আমার কথা শুনে বেশ খুশি হলেন মনে হলো। রুমের সামনে চলে এসেছি। উনি থেমে গেলেন।
বললেন,
-এটা রিডিংরুম।
উনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। কথার শব্দ শুনে চেয়ারে বসা মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেলো। তাকালো আমার দিকে।
বললো,
-গুড আফটারনুন স্যার!
আমিও বললাম,
-গুড আফটারনুন। সিট ডাউন প্লিজ।
ততক্ষণে আমার গলার স্বর অনেকটাই নেমে এসেছে। এতো সেই মেয়ে! এটা কি করে সম্ভব হতে পারে?
এটা কি রিডিংরুম নাকি কোন গবেষণাগার সে দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। একপাশে শুধু বই আর বই। একদিকে কম্পিউটার। আরেক দিকে কি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফ্লেক্সিলোডের দোকানে দেখা মেয়েটি আর এখানে দেখা মেয়েটির বাচনভঙ্গিতে আমি আকাশপাতাল ব্যবধান পেলাম। সেখানে তুলনামূলক চঞ্চল ছিলো। ছিলো কিছুটা ছটফটে। এখানে দেখছি শান্তশিষ্ট। অনেকটাই নিরব।
মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এবার আমি নিরবতা ভেঙে দিয়ে বললাম,
-আমি রিয়াদ আহম্মদ ভূঁঞা। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছি। তোমাকে পড়ানোর জন্য আমাকে আসতে বলা হয়েছে।
এখন আর আপনি করে বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। সেটা উচিতও নয়। দায়িত্ব দায়িত্বই হয়। তখন আর বাইরের কিছু বাচবিচার করা যায়না।
এবার মেয়েটি বলতে লাগলো,
-আমি ফারহানা জামান সুমু। কেবি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি।
আমি বললাম,
-আমি এতবড় নাম ধরে ডাকতে পারবোনা। আমি তোমাকে সুমু বলেই ডাকবো।
সুমু বললো,
-যেমনটা আপনার খুশি।
ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। লজ্জিতই করেছে আমায়। তবে, সেটা নিয়ে সুমুর মধ্যে ঐরকম কোন প্রতিক্রিয়া এখানে না দেখতে পাওয়ায় আরো বেশি ইতস্তত বোধ করছিলাম আমি। নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হচ্ছিলো।
টেবিলের উপরে রাখা সুমুর একটা বই হাতে নিলাম। ইংরেজি বই। পাশেই গাইড বই রাখা। সেগুলো না নিয়ে মেইন বইটাই হাতে নিই। পাতা উল্টাতে উল্টাতে ওকে জিজ্ঞেস করি,
-তা, কিছু কি পড়েছ নাকি একেবারে শুরু থেকে পড়াবো?
সুমু বললো,
-ক্লাস করেছি কয়েকদিন। এটুকুই।
এমন সময় দরজায় কেউ নক করলো। যদিও দরজাটি খোলাই ছিলো। আমি সেদিকে ফিরে তাকাবো এমন সময় কেউ বলে উঠলো,
-ম্যায় আই কাম ইন!
আমি তাকে দেখে এবার আর কোন কথা বলতে পারিনি। ভূতের রাজ্যে আসলাম নাকি! দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর আমার সামনে বসা মেয়েটি দুজনের চেহারাই যে এক ও অভিন্ন!
চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। মনের অজান্তেই বলে উঠলাম,
-হাউ ইজ দ্যাট পসিবল?
--------চলবে--------
-জিরো, ওয়ান, সেভেন, ফাইভ-টু, নাইন-ওয়ান....
আমার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই মেয়েটি দোকানিকে বলে উঠলো,
-থাক মামা, রিচার্জ করবনা। আমাকে একটি মিনিট কার্ড দিয়ে দিন তো! দিনকাল আজ যা পড়েছে, ফ্লেক্সিলোড করিয়েও শান্তিতে ঘুমানো যায়না।
এসব কথায় আমার কিছু আসতো যেতোনা যদি না সে কথাগুলো বলতে বলতে আমার দিকে আঁড়চোখে বারবার তাকাতো। আমি ঢের বুঝতে পারলাম আমাকে রীতিমতো ইনসাল্ট করেছে সে। শুধু যে আমাকেই করেছে তা নয়, এ অপমান গোটা পুরুষ জাতির অপমান। 'ভাবে কি নিজেকে হু, দীপিকা পাড়ুকোন নাকি ঐশ্বর্যা রাই! আরে, ওরাও তো প্রেম, বিয়ে-শাদি করে বাচ্চাকাচ্চার মা হচ্ছে এবং হবে।'
কথাগুলো জোড়ে বলিনি। তবে, এই অল্প বয়সে মেয়ে মানুষের হাতে মার খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তাই কথাগুলো মনে মনেই নিজেকে নিজে বললাম।
দোকানি একটি মিনিট কার্ড দিলো তাকে। মেয়েটি দিলো একটি হাজার টাকার নোট। বিশ টাকার সদাই নিয়ে হাজার টাকার নোট দিলে যেকোন দোকানদারই আপনাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। তবে সেজন্য অবশ্যই আপনাকে হতভাগা পুরুষজাতির সদস্য হতে হবে। আর যদি মেয়ে মানুষ হন তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। নিজের দোকানে না থাকলে পাশের দোকান থেকে হলেও দোকানি আপনাকে খুচরা এনে দিবে!
হাজার টাকা দেয়ায় ঘটেছে বিপত্তি। দোকানির কাছে খুচরা নেই। পাশের দোকানও বন্ধ। দোকানি আর মেয়েটির মাঝে বিষয়টি নিয়ে কথোপকথন চলছে।
দোকানি,
-দেখুন, আমার কাছে খুচরা নেই। আপনি তো প্রায়সই আসেন। পরেরবার না হয় টাকাটা দিয়ে দিবেন।
মেয়েটি,
-না মামা, আমার খুচরা লাগবে। নয়ত পরে রিকশার ভাড়া দিব কি করে। আপনি দেখুন কোন ব্যবস্থা হয় কিনা।
দোকানি এবার অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালো। বললো,
-আপনার কি লাগবে ভাই!
মেয়েটি যেহেতু দোকানিকে মামা ডেকেছে এখন দোকানি যদি আবার আমাকে ভাই ডাকে তাহলে তো আমিও মেয়েটির মামা হয়ে যাব! তাই একটু রাগান্বিত স্বরেই বললাম,
-আমাকে ভাই নয় ভাগিনা ডাকুন মামা।
আমার মুখে এমন আজব কথা শুনে দোকানি কিছুটা অবাক হলো। বললো,
-হ্যা ভাগিনা, কি লাগবে?
আমি,
-এসেছিলাম ফ্লেক্সিলোড করতে তবে, দিনকাল যা পড়েছে তাতে ফ্লেক্সিলোড করলে নম্বর ভাইরাল হয়ে যায়। মেয়েরা বিরক্ত করে। শুধু মেয়েরা বিরক্ত করলে একটা কথা ছিলো, মেয়েদের অভিভাবকরাও ফোন দিয়ে বিরক্ত করে জানেন মামা!
দোকানি আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। যদিও আমার বা দিকে দুই ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। এ পোড়া আগুনের পোড়া নয়। এ পোড়া টিট ফর ট্যাটের পোড়া।
বিশ টাকার একটি মিনিট কার্ড নিলাম। খুচরা বিশ টাকা দিয়েও আলাদা আরো এক হাজার টাকার খুচরা দিয়ে দোকানিকে বললাম,
-এটা রাখুন মামা, বলা তো যায়না কখন কার কাজে আসে।
আজ মাসের এক তারিখ। টিউশনি করে নতুন আরেকটি টিউশনিতে যাচ্ছি। তাই পকেট গরম এখন। যদিও এটি সাময়িক সময়ের জন্য। থাকি বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ারে। পরিবার তেমন স্বচ্ছল নয়। এতদিন চারটে টিউশনি করতাম। আজ থেকে আরেকটা নতুন যোগ হলো। এছাড়াও পার্ট টাইম একটা ছোটোখাটো জব করি। সবমিলিয়ে মাস শেষে হাজার পনেরো হয়ে যায়। বাড়িতেও কিছু টাকা দিই।
আমাদের মতো শিক্ষিত যুবকদের মতো অসহায় প্রাণী পৃথিবীর বুকে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমি তাতে সন্দিহান। আর যদি সেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাদের দিন কাটাতে হয়। ভাবতে হয় নিজের শিক্ষাজীবন পরবর্তী চাকরী জীবনের কথা। চাকরী হবে কি হবেনা তা নিয়ে থাকতে হয় সংশয়ে। পরিবার আমাকে নিয়ে যে আশায় বুক বেঁধে আছে তার চিন্তা থাকে। আমি পারবো তো আমার পরিবারের আশা পূরণ করতে? আমি পারবো তো ছোট ভাইটার পড়াশোনা করাতে? বোনটার বিয়ে দিতে? বয়স্ক বাবা-মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলোর বেঁচে থাকার অবলম্বন হতে? এমন হাজারো চিন্তা সারাক্ষণ আমাদের খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। যা সৌন্দর্য আর চাকচিক্য তা শুধু দেহের বাইরেই। ভেতরে শুধু মরুভূমির মতো হাহাকার।
ফোনে বলা ঠিকানা অনুযায়ী বাসাটি খুঁজে পেলাম। দারোয়ানকে বাড়িওয়ালার নাম বলায় ভেতরে ঢুকতে দিলো। সদর দরজায় কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুলে দিলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। পরনে তাঁর পুরনো কাপড় তবে পরিস্কার। হাতে ওয়েট মপ। ফ্লোর মপ দিচ্ছিলেন হয়ত। আমাকে দেখে বললেন,
-আসুন স্যার!
আমি এর আগে এত বড়লোকের বাড়িতে টিউশনি করাইনি। মহিলাকে কিছু বললামনা। তাঁর দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি একটা হাসি দিলাম। মহিলা দরজা আটকে দিয়ে আমার পিছু পিছু আসলেন এবং গেস্ট রুম অবদি পৌঁছে দিলেন। বলে গেলেন যেন অপেক্ষা করি।
ঘড়ির কাটা তখন বিকাল সাড়ে চারটা। ফোনে যিনি আমার সাথে টিউশনির বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি একজন মহিলা। তার মেয়েকে পড়াতে হবে। একাদশ শ্রেণীতে নাকি পড়ে। বসে আছি আর ভাবছি, 'যাইহোক ভালোই হলো। এখানে টিউশনিটা ঠিকঠাক করতে পারলে হয়ত ভালো টাকা পাওয়া যাবে।' আসলে, আমরা সবাই টাকার কাঙ্গাল। আর হবোই বা না কেন? এই টাকা না থাকলে যে কারোর কাছেই কোন দাম পাওয়া যায়না। যার টাকা আছে তার সব আছে। এটাই রিয়েলিটি।
চারটা পঁয়তাল্লিশের দিকে ঐ মহিলা কল দিয়েছেন। টিউশনির বিষয়ে যার সাথে কথা হয়েছিলো আমার। রিসিভ করলাম।
আমি,
-আসসালামুআলাইকুম।
ওপাশ থেকে,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম। মিঃ রিয়াদ, আপনি কি এসেছেন বাসায়?
আমি,
-জ্বী, সাড়ে চারটায় এসেছি।
ভদ্রমহিলা,
-ওহ ভেরি গুড! আমার মেয়ে বাইরে গিয়েছে একটু। কথা হয়েছে আমার সাথে। ও পাঁচটার আগেই বাসায় ফিরবে। ফিরলে আপনি পড়ানো শুরু করে দিতে পারেন। আমি একটু বাইরে আছি। ছয়টার আগেই চলে আসবো।
আমি,
-আচ্ছা ঠিক আছে।
উনি রেখে দিলেন ফোনটা। ঘড়ির কাটা ততক্ষণে চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট। কলিং বেল বাজতে শুনলাম। একবার, দু'বার, পরপর তিনবার বাজার পরও কেউ দরজা খুলে দেয়নি। কলিং বেল অনবরত বেজেই চলেছে। এবার উঠে এগিয়ে গেলাম আমি। দরজা খুললাম।
কিন্ত একি! এ-তো দেখছি সেই মেয়ে! মেয়েটিও আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো! বললো,
-আপনি এখানে?
আমি,
-আমাকে টিউশনির জন্য ডাকা হয়েছে, এজন্যই। আপনি?
মেয়েটি,
-ওহ আচ্ছা, ভালো।
এই বলে মেয়েটি ভেতরের দিকে চলে গেল। আর কিছু বললোনা। আমিও কিছু বুঝতে না পেরে দরজা আটকে দিয়ে গেস্ট রুমে এসে বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর ঐ মহিলাটি আসলেন যার সাথে এসে প্রথম দেখা হয়েছিলো। আমাকে এসে বললেন,
-স্যার, আপামনি রিডিংরুমে অপেক্ষা করছেন। আপনি আসতে পারেন।
আমি বললাম,
-কোনদিকে সেটা?
মহিলা,
-আসুন আমার সাথে।
যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনি কি কাজ করেন এখানে?
মহিলা,
-জ্বী।
আমি,
- তা, আমি কি বলে ডাকবো আপনাকে?
মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে এবার হেসে দিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন তিনি এখানে কাজ করেন জেনেও আমি তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছি এবং তাঁর সাথে নম্র ভাবে কথা বলছি। তিনি হেসে বললেন,
-ডাকবেন যা খুশি।
আমি,
-ঠিক আছে। আজ থেকে আপনাকে আমি খালা বলেই ডাকবো।
আমার কথা শুনে বেশ খুশি হলেন মনে হলো। রুমের সামনে চলে এসেছি। উনি থেমে গেলেন।
বললেন,
-এটা রিডিংরুম।
উনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। কথার শব্দ শুনে চেয়ারে বসা মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেলো। তাকালো আমার দিকে।
বললো,
-গুড আফটারনুন স্যার!
আমিও বললাম,
-গুড আফটারনুন। সিট ডাউন প্লিজ।
ততক্ষণে আমার গলার স্বর অনেকটাই নেমে এসেছে। এতো সেই মেয়ে! এটা কি করে সম্ভব হতে পারে?
এটা কি রিডিংরুম নাকি কোন গবেষণাগার সে দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। একপাশে শুধু বই আর বই। একদিকে কম্পিউটার। আরেক দিকে কি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফ্লেক্সিলোডের দোকানে দেখা মেয়েটি আর এখানে দেখা মেয়েটির বাচনভঙ্গিতে আমি আকাশপাতাল ব্যবধান পেলাম। সেখানে তুলনামূলক চঞ্চল ছিলো। ছিলো কিছুটা ছটফটে। এখানে দেখছি শান্তশিষ্ট। অনেকটাই নিরব।
মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এবার আমি নিরবতা ভেঙে দিয়ে বললাম,
-আমি রিয়াদ আহম্মদ ভূঁঞা। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছি। তোমাকে পড়ানোর জন্য আমাকে আসতে বলা হয়েছে।
এখন আর আপনি করে বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। সেটা উচিতও নয়। দায়িত্ব দায়িত্বই হয়। তখন আর বাইরের কিছু বাচবিচার করা যায়না।
এবার মেয়েটি বলতে লাগলো,
-আমি ফারহানা জামান সুমু। কেবি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি।
আমি বললাম,
-আমি এতবড় নাম ধরে ডাকতে পারবোনা। আমি তোমাকে সুমু বলেই ডাকবো।
সুমু বললো,
-যেমনটা আপনার খুশি।
ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। লজ্জিতই করেছে আমায়। তবে, সেটা নিয়ে সুমুর মধ্যে ঐরকম কোন প্রতিক্রিয়া এখানে না দেখতে পাওয়ায় আরো বেশি ইতস্তত বোধ করছিলাম আমি। নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হচ্ছিলো।
টেবিলের উপরে রাখা সুমুর একটা বই হাতে নিলাম। ইংরেজি বই। পাশেই গাইড বই রাখা। সেগুলো না নিয়ে মেইন বইটাই হাতে নিই। পাতা উল্টাতে উল্টাতে ওকে জিজ্ঞেস করি,
-তা, কিছু কি পড়েছ নাকি একেবারে শুরু থেকে পড়াবো?
সুমু বললো,
-ক্লাস করেছি কয়েকদিন। এটুকুই।
এমন সময় দরজায় কেউ নক করলো। যদিও দরজাটি খোলাই ছিলো। আমি সেদিকে ফিরে তাকাবো এমন সময় কেউ বলে উঠলো,
-ম্যায় আই কাম ইন!
আমি তাকে দেখে এবার আর কোন কথা বলতে পারিনি। ভূতের রাজ্যে আসলাম নাকি! দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর আমার সামনে বসা মেয়েটি দুজনের চেহারাই যে এক ও অভিন্ন!
চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। মনের অজান্তেই বলে উঠলাম,
-হাউ ইজ দ্যাট পসিবল?
--------চলবে--------
একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০১
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:45 PM
Rating:

No comments