তবুও শেষ পর্ব।
তবুও- শেষ পর্ব
সাব্বিরের চোখে এখন সত্যি সত্যি পানি এসে গেছে। এই অশ্রু আনন্দের। সাব্বির চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, থ্যাংক ইউ স্যার।
-ভাল করে পড়বে। তোমার ভাল রেজাল্ট শুধু তোমার নয়, আমাদের সব শিক্ষকের, কলেজের স্বপ্ন। ঠিক আছে?
-জ্বি, স্যার।
-যাও।
আমগাছের নিচে সাব্বির বসে আছে। বাদামওয়ালা ছেলেটাকে দেখে ডাকল সে। পকেটে দুই টাকা আছে। ওটা দিয়ে একমুঠ বাদাম নিয়ে একাএকা চিবোতে লাগল। জেরিনকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। সাব্বিরের ইচ্ছে করছে আগেই কথা বলতে কিন্তু তা সে করবে না। সাব্বির আগবাড়িয়ে কথা বললে জেরিন লায় পেয়ে যাবে। আর এখন এই ব্যাপারটাকে পুরোপুরিভাবে বাদ দিতে হবে।
জেরিন কোন কথা না বলে তার পাশে এসে বসে পড়ল। সাব্বির একবার তাকালো তার দিকে। সাব্বিরও কোন কথা বলল না। অনায়াসে বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সাব্বিরের বাদাম খাওয়া শেষ হলে জেরিন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কতক্ষণ আগে এখানে এসেছি।
-বলতে পারি না। আমার কোন ঘড়ি নেই।
-কেন বসে আছি?
-তাও জানি না।
-সাব্বির!
-হুম, বল। তোমার কাছে পানি আছে?
জেরিনের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিল। সাব্বির বলল, আমি মুখ না লাগিয়ে খেতে পারি না।
-খাও। আমি কি নিষেধ করছি?
-না, ঠিক তা নয়।
সাব্বির পানির অর্ধেক খেয়ে বোতল ফেরত দিল জেরিনের হাতে। জেরিন বোতলটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। এভাবে ধরে রাখার অর্থ সাব্বির বুঝতে পারছে না। সে জেরিনকে বলল, কিছু বলতে চাচ্ছ মনে হয়।
-যাক, তাহলে অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছ যে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি।
-হুম, বল।
-গত কয়েকমাস ধরে তুমি খুব ভাল ছিলে, না?
-ছিলাম সবসময় যেরকম থাকি।
-আমি তোমার সাথে কোন কথা বলিনি, তোমার একটুও খারাপ লাগেনি?
অন্যদিকে তাকিয়ে সাব্বির বলল, নাহ। খারাপ লাগবে কেন?
-অন্যদিকে তাকালে হয়তো চোখের ভাষা দেখতে পাব না কিন্তু তোমার কণ্ঠ তো বলে দিচ্ছে তোমার খারাপ লেগেছে।
সাব্বির নিশ্চুপ। জেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি পিকনিকে যাবে না বলে আমি টাকা দিলাম। মাসুমকে মিথ্যা বলতে বলেছিলাম যাতে তুমি যেতে পার, তোমার ভাল লাগে। কিন্তু তুমি যাওনি।
-কেন?
-এমনি। আমার ভাল লাগে না।
-নাহ। তুমি যাওনি কারণ বুঝে গেছিলে যে টাকাটা আমি দিয়েছি। আমিও যাইনি। সারাটা দিন দরজা বন্ধ করে কেঁদেছি। তাতে বা তোমার কী? আমি বেহায়ার মত তোমাকে ভালবেসে যাই, আর তুমি আমাকে অবহেলা করে যাও। একটা ব্যাপার কি জানো সাব্বির, ভালবাসাটা সবসময় এমনই হয়। আমি তোমার জন্য আর তুমি অন্যকিছুর জন্য। তুমি কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছিলে, তাই না?
সাব্বির বুঝতে পারছে এটা কিভাবে জানল সে। স্যারের রুমে থাকতেই সে চোখ মুখে ফেলেছে। বাইরেও তখন কেউ ছিল না। তাহলে জেরিন তার কান্নার কথা জানল কিভাবে?
-তুমি কিভাবে জানলে?
-আমার তোমার মত আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই। তোমার চোখের নিচে অশ্রুর দাগ লেগে আছে।
সাব্বির জেরিনের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল। জারিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, জেরিনও বেশ ভিজে গেছে। ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। সাব্বির কেন জানি শব্দ করে হেসে উঠল। জেরিন সাব্বিরের হাসি দেখে না হেসে পারল না।
হাসি থামিয়ে জেরিন বলল, সম্ভবত আজ প্রথম তোমার হাসি দেখলাম।
-আসলে আমি হাসতেই ভুলে গেছি। আজ তোমার কারণে হাসলাম।
কথাটা জেরিন খুব গুরুত্বের সাথে নিল।
সাব্বির বলল, জেরিন, একজন ভোজনপটু মানুষের সামনে সুস্বাদু খাবার এলে না খেয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু কোন কারণে সেই ভোজনপটু লোকের যদি ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার বা অন্য কোন সমস্যা থাকে, তখন তার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। তোমাকে ভাল লাগে। তুমি আমার চেয়েও অনেক ভাল ছেলের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে ভালবাসা সম্ভব না। আমি আজ কেন কেঁদেছিলাম জানো?
-শুনেছি তুমি এলাউ হওনি।
-হুম। আমাকে নিয়ে সবাই অনেক স্বপ্ন দেখে। ফার্স্ট ইয়ারে অনেক ভাল রেজাল্ট করার পর আজ টেস্ট পরীক্ষায় আমি ফেইল। আমার মানসিক অবস্থাটা ভাবো।
-তুমি কি পরীক্ষা দিতে পারবে না?
-তোমার জন্য হলেও আমার যেকোনভাবে পরীক্ষা দেওয়া উচিৎ।
-মানে?
-পিকনিকে যাইনি বলে তুমিও যাওনি। পরে পরীক্ষা না দিলে দেখা যাবে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যাবে আর পরীক্ষা দিবে না।
-সাব্বির!
হাসিমাখা মুখে সাব্বির তাকালো জেরিনের দিকে।
সাব্বিরের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আই লাভ ইউ।
-হুম।
-হুম কী?
-আই লাভ ইউ টু।
জেরিন নিজের কান, চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে একসময় কল্পনা করত যে সাব্বির কোন একদিন তাকে 'ভালবাসি' বলবে। কিন্তু কল্পনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যখন কল্পনা করা বাদ দিল, তখন সাব্বির 'ভালবাসি' বলল। জেরিনের আনন্দে কান্না আসছে। লাল হয়ে আছে তার গালদুটো। সাব্বির তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইচ্ছে করছে জেরিনের লাল গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে বাদামওয়ালা ছেলেটাকে জোরে ডাকল সাব্বির।
শীত শুরু হয়েছে। সকালবেলা কলেজে আসার সময় কুয়াশা জমে সাব্বিরের চুলে। আর তার আসার অপেক্ষায় ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে জেরিন। জেরিনের এই অপেক্ষা করতে ভাল লাগে। আসার পর ইয়ার্কির ছলে সাব্বিরের চুলে জমে থাকা শিশির জলে নিজেকে ভিজিয়ে নেয় সে। এতটুকুতেই জেরিন শান্তি পায়। কোন এক শীতের সকালে সাব্বির আগেভাগে চলে আসে। জেরিন দেরী করায় রুটিনবাঁধা প্রেমে ব্যাঘাত ঘটল। আর সেদিন স্যারের একটা ব্যক্তিগত কাজ থাকায় পড়ালো না। বাপ্পি, মাসুমসহ ওরা ইদানীং একটা নতুন বদভ্যাসের চর্চা করছে। সাব্বিরের সে ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। অবশ্য তারাও সাব্বিরকে ওটার জন্য জোরজবরদস্তি করে না। সাব্বিরকে রেখে ওরা চলে গেল পুকুরের ওই পাড়ে। তনু, মলি, রুমকি ওরা দোতলার বারান্দায় গল্পে মশগুল। সাব্বিরের কেন জানি একা একা লাগছে। জেরিনের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছে সাব্বির। খুবই বেদনাবিধুর অবস্থা!
সাব্বিরকে দেখে তনু বলল, কেমন আছ?
-ভাল, তোমরা?
-ভাল। একটা কথা বলব সাব্বির?
-হ্যাঁ, বল।
-তুমি অনেক চেঞ্জড হয়ে গেছ।
-আমরা সবাই চেঞ্জড হই। তুমিও হয়েছ, মলি, রুমকি, সুমি- সবাই হয়েছে।
-জেরিনও হয়েছে।
খোঁচাটা বুঝতে পেরে স্মিত হেসে সাব্বির বলল, ও আজ আসেনি কেন, বলতে পার?
-না। তুমি খোঁজ নাও।
-কিভাবে?
-ওকে ফোন কর।
-আমার তো ফোন নেই।
-আচ্ছা, আমার ফোন দিয়েই ফোন কর।
সাব্বির ইতস্তত বোধ করছে। মন সায় দিচ্ছে তবুও সাহস হচ্ছে না ফোনে কথা বলার। তনু একপ্রকার জোর করেই জেরিনের ফোনে কল দিয়ে ফোনটা সাব্বিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও, কথা বল।
সাব্বির ফোন কানের কাছে ধরে আছে। হার্টবিট পড়ছে খুব দ্রুত। চোখেমুখে কেমনযেন শঙ্কা। কী কী বলবে তা মনেমনে আওড়াতে লাগল সে।
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে জেরিন বলল, হ্যাঁ, তনু বল।
-হ্যালো..
-কে?
-আমি তনু, সাব্বিরের ফোন নিয়ে কল দিলাম। সরি, আমি সাব্বির, তনুর ফোন দিয়ে কল দিলাম।
সাব্বিরের কথা শুনে ওরা হাসছে। এই যুগে কেউ ফোনে কথা বলতে গিয়ে এমন বিব্রত হতে পারে তা এদের ধারণার বাইরে। ওপাশ থেকে জেরিনেরও হাসি আসছে। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, কেমন আছ?
-ভা...ভা... ভাল।
-তুমি এভাবে তোতলাচ্ছ কেন?
-আসলে তোমার সাথে আগে কখনো ক...ক...কথা বলিনি তো, তাই।
এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারল না জেরিন। শব্দ করে হেসে উঠে বলল, আচ্ছা, তুমি থাকো, আমি আসছি।
-আর একটু কথা বলি? তোমার ফোনে কথা বলতে ভালই লাগছে।
জেরিন কতটা খুশি হল কথাটা শুনে তা ধারণা করতে পারছে না সাব্বির। হালকা শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া ফোনে আর কোন শব্দ নেই। দুজনে চুপ করে আছে। জেরিন চোখ বন্ধ করে ওপাশ থেকে সাব্বিরের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। প্রায় দুই মিনিট ধরে চুপ করে থাকার পর জেরিন বলল, আমি রেডি হয়ে এক্ষণি আসছি।
-আচ্ছা, আসো।
সাব্বির ফোনটা ধরে দিল তনুর হাতে।
তনু, মলি, রুমকি সবাই হাসছে। সাব্বির বুঝতে পারল, তার এমনভাবে কথা বলাটা ওদের কাছে হাসির উপাদান ছিল। তবুও ভাল লাগছে সাব্বিরের। ফোনে জেরিনের কণ্ঠটা অনেক বেশি মিষ্টি লাগছিল। এখনো কানের মধ্যে কথাগুলো বাজছে।
লজ্জায় লাল হয়ে ওখান থেকে ফিরে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো সাব্বির। জেরিন ভ্যানে এলে এখানেই নামবে। ওর সাথে হেঁটে ক্লাসরুম পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সাব্বিরের স্বপ্নগুলো খুবই ছোট কিন্তু তা অমূল্য।
যে ভ্যানে কোন মেয়ে থাকে, সাব্বির ভাবে এই বুঝি জেরিন। এভাবে সাত-আটটা ভ্যান চলে গেল কিন্তু জেরিনের খবর নেই। ইচ্ছে করছে আরেকবার ফোন করতে। কিন্তু লজ্জায় আর তনুর কাছে যাওয়া যাবে না। তাই ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
একটা ভ্যান সাব্বিরের গা ঘেষে ব্রেক কষল। সে তখন তাকিয়ে ছিল পাশের কসমেটিক্স এর দোকানের দিকে। চমকে উঠে দেখে জেরিন নামছে। তার গা থেকে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাকিয়ে রইল জেরিনের চোখের দিকে।
-কী হল? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? চল...
-তোমাকে দেখছি। আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
-অন্যদিন সুন্দর লাগে না?
-না, তা নয়। আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
-সকালে খেয়েছ?
-হুম।
-মিথ্যা বল কেন? তুমি খাওনি।
-কিভাবে বুঝলে?
-কারণ তুমি কখনোই সকালে নাস্তা কর না।
-আসলে সময় পাই না তো। ভোরে উঠে টিউশনি করে আমার কলেজে আসা লাগে।
-চল।
ত্রিশ থেকে চল্লিশ কদম দূরত্ব। কয়েক সেকেন্ডে শেষ। সাব্বিরের ইচ্ছা করছে আজ সারা কলেজ মাঠ জেরিনের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে। কথাটা কিভাবে বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। জেরিন কিছু ভাববে কি না... ইশ! জেরিন যদি মনের কথা বুঝতে পারত।
ক্লাসে না এসে জেরিন বলল, চল, পুকুরপাড়ে বসি।
সাব্বিরের মনের চাওয়াটা পূর্ণ হচ্ছে। মাঠের ওপাশেই পুকুরপাড়। অনেকখানি পথ হাঁটা যাবে। সাব্বির ফিসফিস করে গান গাইছে,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
জেরিনের কথায় সাব্বিরের গান গাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটল, কী হল? গুনগুন করছ কেন? জোরে গাও। ভালই তো গাইছিলে।
সাব্বির বলল, আমি গাইতে পারি না তো।
-শোন, ন্যাকামি করবে না। গাইতে বলছি গাও।
সাব্বির মনেমনে বলছে, প্রেমিকা হয়েই এই অবস্থা, বউ হইলে কী করবে আল্লাহ জানে।
-কী হল? গাও না, প্লিজ।
সাব্বির গান ধরল,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
এটুকু গেয়েই সাব্বির বলল, আর পারি না।
-তুমি যে এত সুন্দর গাইতে পার, জানতাম না তো।
-অনেক বলেছ, এখন ক্ষান্ত দাও।
-হাহাহা।
পুকুরপাড়ে শানবাঁধানো ঘাটে বসল দুজন। জেরিন তার ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করল। সাব্বিরের হাতে দিয়ে বলল, খাও। তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
সাব্বির নির্বাক হয়ে গেল। সে কল্পনাও করেনি এমন মধুর একটা মুহূর্ত আসবে। সে কী বলবে, কী করবে বুঝতে উঠতে পারছে না।
সাব্বিরের নিথর বসে থাকা দেখে জেরিন নিজেই টিফিন বক্সটা খুলে পরোটা ছিঁড়ে এবং ডিমভাজি নিয়ে সাব্বিরের মুখের সামনে ধরল। পুরাই সিনেমাটিক ব্যাপার। অজান্তেই সাব্বিরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তার কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে জেরিনের মায়া হচ্ছিল খুব।
-কাঁদছ কেন?
-এতটা ভালবাসা কখনো পাইনি আমি।
-এভাবে বলে না। নাও খাও।
জেরিন সাব্বিরের মুখে তুলে দিল খাবার। তারপর টিফিন বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন নিজে খাও। কেউ এসে পড়লে লজ্জায় মারা যাব।
সাব্বির খাচ্ছে। তার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে জেরিন। এই চোখে আছে শুধু ভালবাসা, যে ভালবাসা অন্যের চোখে আনন্দাশ্রু আনতে পারে।
পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। সাব্বিরের প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তিনটা টিউশনি, নিজের প্রাইভেট পড়া এবং রাত জেগে হারিকেনের আলোয় পড়া আর তার মধ্যে সামান্য সময় জেরিনকে দেওয়া। আর জেরিন তাতেই খুশি।
আজ কলেজে ফেয়ারওয়েল পার্টি। ছাত্রছাত্রীসহ সকল শিক্ষকমণ্ডলী উপস্থিত। বিদায়ী বেলাটা আসলেই খুবই কষ্টের। আজ এখান থেকে বিদায় নিয়ে সব ছাত্রছাত্রী অন্যত্র চলে যাবে। তবে সাব্বিরের মতে, বিদায় অনুষ্ঠান বা ফেয়ারওয়েল হওয়া উচিৎ রেজাল্টের পর। যারা পাশ করবে, তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে। আজ এখন ফেয়ারওয়েল হলে, যারা ফেল করবে তারা আবার এই কলেজে পড়বে। ব্যাপারটা তাদের জন্য বিদায়ের চেয়ে বেশি কষ্টের। সাব্বিরের একার চিন্তাভাবনায় শতবর্ষের নিয়মনীতি পরিবর্তন হবে না। মাইকের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল সাব্বিরের। সঞ্চালক বলছেন, উপস্থিত অত্র কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এবং প্রভাষকবৃন্দ, সকল ছাত্রছাত্রী এবং কলেজের অন্যান্য কর্মচারী, আসসালামু আলাইকুম এবং শুভসকাল। আজ এই বিদায়ী অনুষ্ঠান শুরু হবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এর মাধ্যমে। পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করবে অত্র কলেজের ছাত্র মোঃ তাওহীদুল ইসলাম।
কোরআন তেলাওয়াত শেষে অধ্যক্ষ, তিন বিভাগ থেকে একজন করে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলকামনা করে বক্তৃতা দিলেন। এরপর প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের থেকে সিনিয়র ব্যাচদের শুভকামনা করে কয়েকজন বক্তৃতা দিল। এবার পরীক্ষার্থীদের পালা। মানবিক এবং বানিজ্য বিভাগ থেকে কয়েকজন ছেলেমেয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বক্তব্য দেওয়া শুরু করল। সবারই বক্তৃতা গৎবাঁধা ভাষায় পূর্ণ। শেষে সাব্বিরের নাম ডাকা হল। সাব্বির নিজেও জানত না যে তার নাম দেওয়া হয়েছে। ধীর পায়ে উঠে গেল স্টেজে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধুরা, জুনিয়র। পাশে চেয়ারে বসা অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকমণ্ডলী। কী দিয়ে শুরু করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না সাব্বির। সাব্বিরের জ্ঞান ছাপাকৃত বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। সে কখনো বক্তৃতা দেয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগে বিদায়ের দিন সে যায়ইনি বরং সেই সময়টায় সে পড়েছিল। আজও আসতে চেয়েছিল না। জেরিনকে বলেছিল যে ফেয়ারওয়েলে সে আসবে না। জেরিন বলল, তুমি না এলে আমিও আসব না। সেইজন্য সাব্বিরের আসা। আর এসেই ফেঁসে গেছে।
প্রায় মিনিট খানিক চুপ থাকার পর, সাব্বির কাঁপাকাঁপা গলায় ভণিতা ছাড়া বলতে শুরু করল, আমি বিদায়ী কথা বলতে পারি না। শিক্ষকদের সালাম দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করা উচিৎ ছিল। সেটা করিনি। কারণ আমি শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাবামায়ের মত সম্মান করি। আমি আমার মায়ের সাথে কখনো সালাম দিয়ে কথা বলিনি। বাবামাকে হারানোর পর মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দ্বারা সেই অভাবটা কিছুটা হলেও কমেছে। তারপর এই কলেজে আসার পর এখানের শিক্ষকদের থেকে সেই ভালবাসাটা পেয়েছি। কলেজ ছেড়ে চলে যাব, তার জন্য খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগছে এখানের অভিভাবকদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাবামাকে হারানোর পর আমার তিনকুলে কেউ নেই...
সাব্বিরের গলা ধরে আসছে। সে আর কথা বলতে পারল না। মাইক্রোফোন রেখে দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে গেল স্টেজ থেকে। সাব্বিরের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। পরিবেশটা কেমন গুমটভাব ধরে আছে। এরপর অধ্যক্ষ সমাপনী বক্তব্য দিয়ে বিদায়ী অনুষ্ঠান শেষ করলেন।
সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে জানালা ধরে। সবাই ব্যস্ত আছে শিক্ষকদের আশীর্বাদ সংগ্রহে আর সাব্বিরের মাথায় চিন্তা অন্যকিছু। কলেজের পক্ষ থেকে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে একটা করে দামী কলম দেওয়া হয়েছে। সাব্বিরেরটা জেরিন সংগ্রহ করে এনে তাকে দিয়ে বলল, নাও, তোমার কলম।
কলমটার দিকে কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে সাব্বির বলল, তোমাকে তো কখনো কিছু দিতে পারিনি, নাও। কলমটা নাও। এটাই তোমাকে দিলাম।
জেরিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোর কাটতেই বলল, সে কী? আমি কি তোমার কাছে কখনো কিছু চেয়েছি?
-নাহ, তা চাওনি। তবে দিতে ইচ্ছে করে।
-বুঝলাম। তো, আমি যা চাই, তাই দিতে পারবে?
-কী চাও?
-চাওয়ার কথাটা শেষ করার আগেই সব ছেলেমেয়েরা ওদের দিকেই চলে এলো। জেরিন বলতে পারল না তার অব্যক্ত চাওয়াগুলো। তবে সে সাব্বিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সাব্বির হয়তো বুঝতে পেরেছে। বাপ্পি এসে বলল, চল, আড্ডা দিব।
-আমার ভাল লাগছে নারে।
-ক্যান? কী হইছে?
-আরে, তেমন কিছু না। এমনিতেই ভাল লাগছে না।
-ধুর। চল তো।
সাব্বিরের ভাল না লাগাটা বুঝতে পেরেছিল জেরিন। কারণ তারও একই কারণে ভাল লাগছে না। কী অদ্ভুত! ভালবাসার মানুষগুলোর ভাল লাগার সাথে ভাল না লাগারও অদ্ভুত মিল থাকে।
মাসুম, প্রলয়, মৃদুল, শাওন ওরা সবাই আগে হাঁটছে। একটু পিছনে আসছে বাপ্পি আর সাব্বির। সাব্বিরের মুখটা শুকনা হয়ে আছে। বাপ্পি বেশ জোর দিয়েই বলল, সত্যি করে বল তো, তোর হয়েছে কী?
-বাপ্পি, আমি একটা মায়ামোহহীন জীবন যাপন করি। কিন্তু কেন যে একটা মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম।
-জেরিনের ব্যাপারটা?
-হ্যাঁ।
-কেন? সমস্যা কী?
-একটা সময় মনে হত, ও আমাকে শুধুমাত্র ভালবাসে, কিন্তু এখন বুঝছি ও আসলে আমাকেই চায়। আর সত্যি বলতে, আমিও ওকে চাই।
-তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ক্লিয়ার কর তো।
-তোকে আমি বোঝাতে পারব না। আমি আসলে ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছিরে, ফিরতে পারছি না।
-বাদ দে। যা হওয়ার তাই হবে।
ততক্ষণে শাওনদের বাসায় চলে এলো সবাই। আজ একটা মুভি দেখা হবে। হিন্দি 'থ্রি ইডিয়টস' মুভিটা সবাই মিলে দেখবে। হয়তো এমন মুহূর্ত জীবনে আর আসবে না।
মুভির একটা দৃশ্য দেখে সাব্বির ইমোশনাল হয়ে গেল। র্যানচো ছিল এতিম। তাকে একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে তার পালক পিতা তখন দত্তক নিয়ে নেয়। পালক বাবার আসল ছেলের পরিচয় নিয়ে সে লেখাপড়া করে।
বাপ্পি সিগারেট ধরালো। কয়েকজন নিয়মিত ধূমপায়ী হলেও সাব্বির কখনো সিগারেট ছোঁয়নি। আজ ইমোশনাল হওয়ার পর তার কেমন যেন লাগছে। বাপ্পির কাছ থেকে আধখাওয়া সিগারেট নিয়ে নিল। একটা টান মেরে ফিরিয়ে দিল বাপ্পির হাতে। এরপর প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে টানতে লাগল। সাব্বির বুঝতে পারল না সে কী ভুল করছে।
পরীক্ষা শুরু আজ। মেয়েদের সিট পড়েছে পাশের রুমে। ঘণ্টা পড়ার আগমুহূর্তে জেরিন আর সাব্বির দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলার জন্য মুখোমুখি দাঁড়ালো। সাব্বির কথা বলতেই জেরিন বলল, আমার খুব মাথা ধরেছে। পরীক্ষা শেষে ওয়েট কর।
সাব্বির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে পরীক্ষার কক্ষে চলে গেল।
প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির আর জেরিন। কেউ কিছু বলছে না। জেরিনের চোখে জল আসার উপক্রম। সাব্বির বুঝে উঠতে পারছে না কিছুই। বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখের জল মুছতে মুছতে জেরিন বলল, তুমি শেষপর্যন্ত এই পথ বেছে নিলে?
-কোন পথ?
-কোন পথ মানে? তুমি ন্যাকামি করছ আমার সাথে?
-আরে, বলবে তো।
-তুমি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছ?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল সাব্বির। জেরিন ধমক দিয়ে বলল, কী হল চুপ করে আছ কেন?
-আসলে ওদের সাথে সেদিন আড্ডার সময় শখ করে খেয়েছিলাম, তারপর মাঝেমাঝে একটু....
-চুপ। সকালে তোমার সাথে কথা বলার সময় সিগারেটের গন্ধে মাথা ধরে গেছে।
-সরি।
-সরি কিসের জন্য? আর যদি কখনো সিগারেট খাও, তাইলে কিন্তু ব্রেক আপ!
-আচ্ছা।
-মনে থাকবে?
-থাকবে।
-প্রমিজ?
-প্রমিজ।
-এইটা নাও।
-কী?
-কিছু টাকা আছে, রাখো।
-টাকা দিচ্ছ কেন?
-সিগারেট খাওয়ার জন্য।
-আমি টাকা নিব না।
-আরেরে বাবা, ধার হিসেবে নাও। দেখ, পরীক্ষার মধ্যে তুমি টিউশনিটা বন্ধ রাখো। ভাল করে পড়ে পরীক্ষা দাও। আর এটা দিয়ে চলো। পরে আমাকে ফেরত দিয়ে দেবে। তোমার আত্মসম্মানবোধকে আমি সম্মান করি সাব্বির। আর এইজন্য তোমাকে এতটা ভালবাসি।
নির্বাক একটা হাসি দিয়ে মাঠের মধ্য থেকে বেরিয়ে গেল দুজন।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন আর মফস্বলের দিকে সাব্বিরের যাওয়া হয় না। আর ওদের ব্যাচের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে শহরে এডমিশনের জন্য কোচিং করতে গেছে। আর সাব্বির সে একটা কোচিং সেন্টারে যোগদান করেছে শিক্ষক হিসেবে। জেরিনের সাথে যোগাযোগ নেই। একদিন জেরিনের ফোনে ফোন করল সাব্বির।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-জেরিন, আমি।
-সাব্বির, কেমন আছ?
-ভাল। তুমি?
-খুব একটা ভাল না। তোমার সাথে দেখা হয় না কতদিন!
-তুমি তো শহরে কোচিং করছ………
-হুম, আর তুমি?
-আমি? বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য কোচিং খুলেছি। বাড়ি আসবে কবে?
-ঈদের এক সপ্তাহ আগে। তোমার কোন ফোন আছে?
-না। তবে কোচিংয়ের ডিরেক্টরের নাম্বার আছে। তার নাম্বারে সকালে এবং বিকালে কল করলে আমাকে পাবে।
-আচ্ছা। নাম্বারটা দিও। আমি বাড়ি এসে ফোন করব।
ঈদের তিনদিন আগে ডিরেক্টর জাহিদ সাহেব সাব্বিরকে ডেকে বলল, তোমার কল এসেছে।
-কে ফোন করেছে ভাইয়া?
-জেরিন নামের কেউ।
জেরিনের নাম শুনে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে সাব্বিরের মধ্যে।
-হ্যালো জেরিন, কেমন আছ?
-তুমি কি আজ এখনি দেখা করতে পারবে?
সাব্বির একটু শঙ্কিতবোধ করল। জেরিনের কণ্ঠস্বরে কেমন যেন বিষাদের ছাপ। সাব্বির বলল, এখন? আমার আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। আর তোমার কী হয়েছে?
-সমস্যা নেই। তুমি আসো, আমি অপেক্ষা করছি।
-কোথায় আসব?
-কলেজে, আমগাছের নিচে।
জেরিন গাছের চারপাশে আস্তেআস্তে চক্কর দিচ্ছে। সাব্বির এখনো পৌঁছায়নি। অবশ্য জেরিন এমনিতেই অনেক আগে চলে এসেছে। বাসায় অস্থির লাগছিল তার। কলেজের পুকুরপাড়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখল সাব্বির জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে।
সাইকেলটা রেখে সাব্বির বলল, দেরী করে ফেললাম?
-নাহ। তুমি বরং তোমার টাইমের আগেই এসেছে। আমি আগে চলে এলাম। কেমন আছ সাব্বির।
ডান হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ভাল। তুমি?
-ভাল.... আছি।
জেরিনের 'ভাল আছি' বলার মধে জড়তা ছিল। সাব্বির এগিয়ে আসতেই ওড়না দিয়ে সাব্বিরের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতেই জেরিন কান্না শুরু করে দিল। সাব্বির হতভম্ব। জেরিনের দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে জেরিন? আমাকে তো বলবা, নাকি?
হেচকি ওঠা শুরু হয়েছিল জেরিনের। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে সে। সবুজ ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ভাইজান বাদাম লাগবো?
সাব্বির আর জেরিন দুজনেই নীরব। সবুজ দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না। সাব্বিরকে তার কেন জানি খুব ভাল লাগে। সাব্বিরের মনের মধ্যে কোন অশনিসংকেত বাজছে। সে অনেক কিছু বুঝতে পারে। এবং এটাও বুঝতে পারছে যে আজ জীবনের অন্যতম একটা কালোদিন।
সাব্বির স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে। সবুজকে বলল, পাঁচটাকার বাদাম দে।
বাদাম দিয়ে সবুজ দূরে সরে গেল। কিন্তু তার কেমনযেন লাগছে। সাব্বির ভাইজানের গলাটা আজ কেমনযেন ছিল। সামনে একটা ভিড় থেকে সবুজকে ডাকতেই সাব্বিরের কথা মাথা উড়ে গেল।
-সাব্বির, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
-ভাল তো। বিয়ে করে ফেলো।
-প্লিজ, তুমি কি বুঝতে পারছ না যে আমি কী বলছি?
-বুঝছি। আর আমি এটা ছাড়া তোমাকে আর কী বলতে পারি?
-আমি বাবাকে তোমার কথা বলব।
-তাতে কোন লাভ হবে না জেরিন। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা কর। তোমার বাবা একজন বুঝদার মানুষ এবং সর্বোপরি তোমার গার্জিয়ান। সে কখনোই তার মেয়েকে মেয়ের সমবয়সী কোন চালচুলোহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না। তার কাছে এটা করা মানে মেয়েকে মেরে ফেলা। আর কোন বাবাই তার সন্তানকে এমনভাবে মারতে পারে না।
-তোমার জ্ঞানের কথা বন্ধ কর। আমি অতকিছু বুঝি না। দরকার হয় আমরা পালিয়ে যাব।
-জেরিন, এসব ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা করা বাদ দাও। তুমি ভাল করে জান, এটা সম্ভব না।
-কেন সম্ভব না?
-আজ তুমি আবেগ নিয়ে আমার সাথে পালাবে। দুইদিন পর, যখন না খেয়ে থাকতে হবে, তখন ভালবাসাটার জায়গায় অভাব এসে দাঁড়াবে। কথায় আছে, অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর আমি জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত সব অভাবের মুখোমুখি। জন্মের কিছুদিন পর বাবার অভাব, মা মরে গেল তার পর। মায়ের অভাব কেটে ওঠার আগেই খাবারের অভাব, টাকার অভাব। ভালবাসার অভাব ছিল। সত্যি বলতে কী, তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো মিথ্যা হলেও খুব মধুর ছিল। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, ভাল লেগেছিল। শুধু ওই ভালোলাগাটুকুই। কিন্তু তুমি যখন বারবার আমাকে তোমার পবিত্র ভালবাসায় জড়াতে চাচ্ছিলে, আমি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, আমি তোমাকে ভাল না বেসে থাকতে পারিনি। ওটা আমার ভুল ছিল?
জেরিন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ভুল?
-হ্যাঁ, ভুল। ভুল বলছি এই কারণে যে, তখন যদি আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ তোমার এতটা খারাপ লাগত না। এক কাজ কর জেরিন, তুমি তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো।
কাঁদতে কাঁদতে জেরিন বলল, আমি পারব না সাব্বির।
-জেরিন, ভালবাসা মানে পাওয়া- তা কিন্তু নয়। ধরে নাও, তোমার জীবনে সাব্বির নামে কোন অধ্যায় ছিল না।
-এটা কি সম্ভব? তুমি কি তোমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে?
-পারব। আমাকে পারতে হবে জেরিন। এবং তোমাকেও পারতে হবে। পাগলামি কর না প্লিজ।
-তোমার কাছ থেকে আজ একটু আদর নিব, দিবে?
সাব্বির জেরিনের কথার কিছুই বুঝল না। জেরিন বলল, আমার চোখের জল মুছে দিবে?
সাব্বির বিনা দ্বিধায় জেরিনের মুখের দিকে হাত বাড়ালো। কিন্তু এ কী? সাব্বিরের হাত কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সাব্বির। তার হাতদুটো জোরে চেপে ধরে জেরিন বলল, সত্যি করে বল তো, তোমার কী খারাপ লাগছে না।
ভিতরটায় ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবুও স্বাভাবিকভাবে সাব্বির বলল, নাহ। কষ্ট হচ্ছে না। সামান্য খারাপ লাগছে। আর কষ্ট হবেও না।
কথাটা শেষ করে সাব্বির জেরিনের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ভাল থেকো জেরিন, সুখী হও।
-আমাকে কি তুমি আজ এগিয়ে দিবে আমার বাড়ি পর্যন্ত?
সাব্বির কথাটা শুনে খুব খুশি হল। তবুও হাসিটা আড়াল করে বলল, নাহ! তাতে মায়ার স্থায়িত্বকাল দীর্ঘ হবে। আর কী দরকার বল? যাও, তুমি নিজেই চলে যাও। ভ্যানে উঠে বাসায় চলে যাও।
সাব্বির হাঁটা শুরু করে হঠাৎ থেমে বলল, তুমি তো আমাকে অনেক ভালবাসো, তাই না?
জেরিন কথা বলল না। তার ঠোঁটদুটো কাঁপছে। সাব্বির বলল, সেই ভালবাসার দিব্যি দিয়ে অনুরোধ করছি, কখনো এই চালচুলোহীন ছেলেটার জন্য তোমার চোখের অমূল্য জলটুকু ফেলো না।
জেরিন কাঁদতে শুরু করছে। তার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে সাব্বির বলল, না জেরিন। তুমি কাঁদবে না। কখনোই না। তোমাকে কান্না করলে মানায় না। তুমি কখনোই কাঁদবে না।
সাব্বির হেঁটে চলে যাচ্ছে। ডানহাতে সাইকেল ধরে হাঁটছে। সে একবারও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। কিন্তু সে জানে, জেরিন তার দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না যে সাব্বিরের চোখের জলে শুষ্ক বুকটা ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই জেরিন ঠাই তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। মানুষ কতটা শক্ত হলে পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে এমনভাবে চলে যেতে পারে? চোখ বন্ধ করে আবার তাকালো জেরিন। নীলচে ধোঁয়ার মধ্যে কেমনযেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এইতো, এখন আর মোটেও দেখা যাচ্ছে না সাব্বিরকে। আকাশে ঝকঝকে সূর্য। মধ্য দুপুরে তৃষ্ণার্ত কাকের কর্কশ গলায় কাঁ কাঁ শোনা যাচ্ছে। তবুও চারদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, তবুও।
সাব্বিরের চোখে এখন সত্যি সত্যি পানি এসে গেছে। এই অশ্রু আনন্দের। সাব্বির চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, থ্যাংক ইউ স্যার।
-ভাল করে পড়বে। তোমার ভাল রেজাল্ট শুধু তোমার নয়, আমাদের সব শিক্ষকের, কলেজের স্বপ্ন। ঠিক আছে?
-জ্বি, স্যার।
-যাও।
আমগাছের নিচে সাব্বির বসে আছে। বাদামওয়ালা ছেলেটাকে দেখে ডাকল সে। পকেটে দুই টাকা আছে। ওটা দিয়ে একমুঠ বাদাম নিয়ে একাএকা চিবোতে লাগল। জেরিনকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। সাব্বিরের ইচ্ছে করছে আগেই কথা বলতে কিন্তু তা সে করবে না। সাব্বির আগবাড়িয়ে কথা বললে জেরিন লায় পেয়ে যাবে। আর এখন এই ব্যাপারটাকে পুরোপুরিভাবে বাদ দিতে হবে।
জেরিন কোন কথা না বলে তার পাশে এসে বসে পড়ল। সাব্বির একবার তাকালো তার দিকে। সাব্বিরও কোন কথা বলল না। অনায়াসে বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সাব্বিরের বাদাম খাওয়া শেষ হলে জেরিন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কতক্ষণ আগে এখানে এসেছি।
-বলতে পারি না। আমার কোন ঘড়ি নেই।
-কেন বসে আছি?
-তাও জানি না।
-সাব্বির!
-হুম, বল। তোমার কাছে পানি আছে?
জেরিনের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিল। সাব্বির বলল, আমি মুখ না লাগিয়ে খেতে পারি না।
-খাও। আমি কি নিষেধ করছি?
-না, ঠিক তা নয়।
সাব্বির পানির অর্ধেক খেয়ে বোতল ফেরত দিল জেরিনের হাতে। জেরিন বোতলটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। এভাবে ধরে রাখার অর্থ সাব্বির বুঝতে পারছে না। সে জেরিনকে বলল, কিছু বলতে চাচ্ছ মনে হয়।
-যাক, তাহলে অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছ যে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি।
-হুম, বল।
-গত কয়েকমাস ধরে তুমি খুব ভাল ছিলে, না?
-ছিলাম সবসময় যেরকম থাকি।
-আমি তোমার সাথে কোন কথা বলিনি, তোমার একটুও খারাপ লাগেনি?
অন্যদিকে তাকিয়ে সাব্বির বলল, নাহ। খারাপ লাগবে কেন?
-অন্যদিকে তাকালে হয়তো চোখের ভাষা দেখতে পাব না কিন্তু তোমার কণ্ঠ তো বলে দিচ্ছে তোমার খারাপ লেগেছে।
সাব্বির নিশ্চুপ। জেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি পিকনিকে যাবে না বলে আমি টাকা দিলাম। মাসুমকে মিথ্যা বলতে বলেছিলাম যাতে তুমি যেতে পার, তোমার ভাল লাগে। কিন্তু তুমি যাওনি।
-কেন?
-এমনি। আমার ভাল লাগে না।
-নাহ। তুমি যাওনি কারণ বুঝে গেছিলে যে টাকাটা আমি দিয়েছি। আমিও যাইনি। সারাটা দিন দরজা বন্ধ করে কেঁদেছি। তাতে বা তোমার কী? আমি বেহায়ার মত তোমাকে ভালবেসে যাই, আর তুমি আমাকে অবহেলা করে যাও। একটা ব্যাপার কি জানো সাব্বির, ভালবাসাটা সবসময় এমনই হয়। আমি তোমার জন্য আর তুমি অন্যকিছুর জন্য। তুমি কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছিলে, তাই না?
সাব্বির বুঝতে পারছে এটা কিভাবে জানল সে। স্যারের রুমে থাকতেই সে চোখ মুখে ফেলেছে। বাইরেও তখন কেউ ছিল না। তাহলে জেরিন তার কান্নার কথা জানল কিভাবে?
-তুমি কিভাবে জানলে?
-আমার তোমার মত আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই। তোমার চোখের নিচে অশ্রুর দাগ লেগে আছে।
সাব্বির জেরিনের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল। জারিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, জেরিনও বেশ ভিজে গেছে। ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। সাব্বির কেন জানি শব্দ করে হেসে উঠল। জেরিন সাব্বিরের হাসি দেখে না হেসে পারল না।
হাসি থামিয়ে জেরিন বলল, সম্ভবত আজ প্রথম তোমার হাসি দেখলাম।
-আসলে আমি হাসতেই ভুলে গেছি। আজ তোমার কারণে হাসলাম।
কথাটা জেরিন খুব গুরুত্বের সাথে নিল।
সাব্বির বলল, জেরিন, একজন ভোজনপটু মানুষের সামনে সুস্বাদু খাবার এলে না খেয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু কোন কারণে সেই ভোজনপটু লোকের যদি ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার বা অন্য কোন সমস্যা থাকে, তখন তার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। তোমাকে ভাল লাগে। তুমি আমার চেয়েও অনেক ভাল ছেলের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে ভালবাসা সম্ভব না। আমি আজ কেন কেঁদেছিলাম জানো?
-শুনেছি তুমি এলাউ হওনি।
-হুম। আমাকে নিয়ে সবাই অনেক স্বপ্ন দেখে। ফার্স্ট ইয়ারে অনেক ভাল রেজাল্ট করার পর আজ টেস্ট পরীক্ষায় আমি ফেইল। আমার মানসিক অবস্থাটা ভাবো।
-তুমি কি পরীক্ষা দিতে পারবে না?
-তোমার জন্য হলেও আমার যেকোনভাবে পরীক্ষা দেওয়া উচিৎ।
-মানে?
-পিকনিকে যাইনি বলে তুমিও যাওনি। পরে পরীক্ষা না দিলে দেখা যাবে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যাবে আর পরীক্ষা দিবে না।
-সাব্বির!
হাসিমাখা মুখে সাব্বির তাকালো জেরিনের দিকে।
সাব্বিরের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আই লাভ ইউ।
-হুম।
-হুম কী?
-আই লাভ ইউ টু।
জেরিন নিজের কান, চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে একসময় কল্পনা করত যে সাব্বির কোন একদিন তাকে 'ভালবাসি' বলবে। কিন্তু কল্পনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যখন কল্পনা করা বাদ দিল, তখন সাব্বির 'ভালবাসি' বলল। জেরিনের আনন্দে কান্না আসছে। লাল হয়ে আছে তার গালদুটো। সাব্বির তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইচ্ছে করছে জেরিনের লাল গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে বাদামওয়ালা ছেলেটাকে জোরে ডাকল সাব্বির।
শীত শুরু হয়েছে। সকালবেলা কলেজে আসার সময় কুয়াশা জমে সাব্বিরের চুলে। আর তার আসার অপেক্ষায় ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে জেরিন। জেরিনের এই অপেক্ষা করতে ভাল লাগে। আসার পর ইয়ার্কির ছলে সাব্বিরের চুলে জমে থাকা শিশির জলে নিজেকে ভিজিয়ে নেয় সে। এতটুকুতেই জেরিন শান্তি পায়। কোন এক শীতের সকালে সাব্বির আগেভাগে চলে আসে। জেরিন দেরী করায় রুটিনবাঁধা প্রেমে ব্যাঘাত ঘটল। আর সেদিন স্যারের একটা ব্যক্তিগত কাজ থাকায় পড়ালো না। বাপ্পি, মাসুমসহ ওরা ইদানীং একটা নতুন বদভ্যাসের চর্চা করছে। সাব্বিরের সে ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। অবশ্য তারাও সাব্বিরকে ওটার জন্য জোরজবরদস্তি করে না। সাব্বিরকে রেখে ওরা চলে গেল পুকুরের ওই পাড়ে। তনু, মলি, রুমকি ওরা দোতলার বারান্দায় গল্পে মশগুল। সাব্বিরের কেন জানি একা একা লাগছে। জেরিনের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছে সাব্বির। খুবই বেদনাবিধুর অবস্থা!
সাব্বিরকে দেখে তনু বলল, কেমন আছ?
-ভাল, তোমরা?
-ভাল। একটা কথা বলব সাব্বির?
-হ্যাঁ, বল।
-তুমি অনেক চেঞ্জড হয়ে গেছ।
-আমরা সবাই চেঞ্জড হই। তুমিও হয়েছ, মলি, রুমকি, সুমি- সবাই হয়েছে।
-জেরিনও হয়েছে।
খোঁচাটা বুঝতে পেরে স্মিত হেসে সাব্বির বলল, ও আজ আসেনি কেন, বলতে পার?
-না। তুমি খোঁজ নাও।
-কিভাবে?
-ওকে ফোন কর।
-আমার তো ফোন নেই।
-আচ্ছা, আমার ফোন দিয়েই ফোন কর।
সাব্বির ইতস্তত বোধ করছে। মন সায় দিচ্ছে তবুও সাহস হচ্ছে না ফোনে কথা বলার। তনু একপ্রকার জোর করেই জেরিনের ফোনে কল দিয়ে ফোনটা সাব্বিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও, কথা বল।
সাব্বির ফোন কানের কাছে ধরে আছে। হার্টবিট পড়ছে খুব দ্রুত। চোখেমুখে কেমনযেন শঙ্কা। কী কী বলবে তা মনেমনে আওড়াতে লাগল সে।
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে জেরিন বলল, হ্যাঁ, তনু বল।
-হ্যালো..
-কে?
-আমি তনু, সাব্বিরের ফোন নিয়ে কল দিলাম। সরি, আমি সাব্বির, তনুর ফোন দিয়ে কল দিলাম।
সাব্বিরের কথা শুনে ওরা হাসছে। এই যুগে কেউ ফোনে কথা বলতে গিয়ে এমন বিব্রত হতে পারে তা এদের ধারণার বাইরে। ওপাশ থেকে জেরিনেরও হাসি আসছে। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, কেমন আছ?
-ভা...ভা... ভাল।
-তুমি এভাবে তোতলাচ্ছ কেন?
-আসলে তোমার সাথে আগে কখনো ক...ক...কথা বলিনি তো, তাই।
এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারল না জেরিন। শব্দ করে হেসে উঠে বলল, আচ্ছা, তুমি থাকো, আমি আসছি।
-আর একটু কথা বলি? তোমার ফোনে কথা বলতে ভালই লাগছে।
জেরিন কতটা খুশি হল কথাটা শুনে তা ধারণা করতে পারছে না সাব্বির। হালকা শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া ফোনে আর কোন শব্দ নেই। দুজনে চুপ করে আছে। জেরিন চোখ বন্ধ করে ওপাশ থেকে সাব্বিরের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। প্রায় দুই মিনিট ধরে চুপ করে থাকার পর জেরিন বলল, আমি রেডি হয়ে এক্ষণি আসছি।
-আচ্ছা, আসো।
সাব্বির ফোনটা ধরে দিল তনুর হাতে।
তনু, মলি, রুমকি সবাই হাসছে। সাব্বির বুঝতে পারল, তার এমনভাবে কথা বলাটা ওদের কাছে হাসির উপাদান ছিল। তবুও ভাল লাগছে সাব্বিরের। ফোনে জেরিনের কণ্ঠটা অনেক বেশি মিষ্টি লাগছিল। এখনো কানের মধ্যে কথাগুলো বাজছে।
লজ্জায় লাল হয়ে ওখান থেকে ফিরে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো সাব্বির। জেরিন ভ্যানে এলে এখানেই নামবে। ওর সাথে হেঁটে ক্লাসরুম পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সাব্বিরের স্বপ্নগুলো খুবই ছোট কিন্তু তা অমূল্য।
যে ভ্যানে কোন মেয়ে থাকে, সাব্বির ভাবে এই বুঝি জেরিন। এভাবে সাত-আটটা ভ্যান চলে গেল কিন্তু জেরিনের খবর নেই। ইচ্ছে করছে আরেকবার ফোন করতে। কিন্তু লজ্জায় আর তনুর কাছে যাওয়া যাবে না। তাই ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
একটা ভ্যান সাব্বিরের গা ঘেষে ব্রেক কষল। সে তখন তাকিয়ে ছিল পাশের কসমেটিক্স এর দোকানের দিকে। চমকে উঠে দেখে জেরিন নামছে। তার গা থেকে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাকিয়ে রইল জেরিনের চোখের দিকে।
-কী হল? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? চল...
-তোমাকে দেখছি। আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
-অন্যদিন সুন্দর লাগে না?
-না, তা নয়। আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
-সকালে খেয়েছ?
-হুম।
-মিথ্যা বল কেন? তুমি খাওনি।
-কিভাবে বুঝলে?
-কারণ তুমি কখনোই সকালে নাস্তা কর না।
-আসলে সময় পাই না তো। ভোরে উঠে টিউশনি করে আমার কলেজে আসা লাগে।
-চল।
ত্রিশ থেকে চল্লিশ কদম দূরত্ব। কয়েক সেকেন্ডে শেষ। সাব্বিরের ইচ্ছা করছে আজ সারা কলেজ মাঠ জেরিনের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে। কথাটা কিভাবে বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। জেরিন কিছু ভাববে কি না... ইশ! জেরিন যদি মনের কথা বুঝতে পারত।
ক্লাসে না এসে জেরিন বলল, চল, পুকুরপাড়ে বসি।
সাব্বিরের মনের চাওয়াটা পূর্ণ হচ্ছে। মাঠের ওপাশেই পুকুরপাড়। অনেকখানি পথ হাঁটা যাবে। সাব্বির ফিসফিস করে গান গাইছে,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
জেরিনের কথায় সাব্বিরের গান গাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটল, কী হল? গুনগুন করছ কেন? জোরে গাও। ভালই তো গাইছিলে।
সাব্বির বলল, আমি গাইতে পারি না তো।
-শোন, ন্যাকামি করবে না। গাইতে বলছি গাও।
সাব্বির মনেমনে বলছে, প্রেমিকা হয়েই এই অবস্থা, বউ হইলে কী করবে আল্লাহ জানে।
-কী হল? গাও না, প্লিজ।
সাব্বির গান ধরল,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হত তুমি বল তো?
এটুকু গেয়েই সাব্বির বলল, আর পারি না।
-তুমি যে এত সুন্দর গাইতে পার, জানতাম না তো।
-অনেক বলেছ, এখন ক্ষান্ত দাও।
-হাহাহা।
পুকুরপাড়ে শানবাঁধানো ঘাটে বসল দুজন। জেরিন তার ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করল। সাব্বিরের হাতে দিয়ে বলল, খাও। তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
সাব্বির নির্বাক হয়ে গেল। সে কল্পনাও করেনি এমন মধুর একটা মুহূর্ত আসবে। সে কী বলবে, কী করবে বুঝতে উঠতে পারছে না।
সাব্বিরের নিথর বসে থাকা দেখে জেরিন নিজেই টিফিন বক্সটা খুলে পরোটা ছিঁড়ে এবং ডিমভাজি নিয়ে সাব্বিরের মুখের সামনে ধরল। পুরাই সিনেমাটিক ব্যাপার। অজান্তেই সাব্বিরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তার কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে জেরিনের মায়া হচ্ছিল খুব।
-কাঁদছ কেন?
-এতটা ভালবাসা কখনো পাইনি আমি।
-এভাবে বলে না। নাও খাও।
জেরিন সাব্বিরের মুখে তুলে দিল খাবার। তারপর টিফিন বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন নিজে খাও। কেউ এসে পড়লে লজ্জায় মারা যাব।
সাব্বির খাচ্ছে। তার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে জেরিন। এই চোখে আছে শুধু ভালবাসা, যে ভালবাসা অন্যের চোখে আনন্দাশ্রু আনতে পারে।
পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। সাব্বিরের প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তিনটা টিউশনি, নিজের প্রাইভেট পড়া এবং রাত জেগে হারিকেনের আলোয় পড়া আর তার মধ্যে সামান্য সময় জেরিনকে দেওয়া। আর জেরিন তাতেই খুশি।
আজ কলেজে ফেয়ারওয়েল পার্টি। ছাত্রছাত্রীসহ সকল শিক্ষকমণ্ডলী উপস্থিত। বিদায়ী বেলাটা আসলেই খুবই কষ্টের। আজ এখান থেকে বিদায় নিয়ে সব ছাত্রছাত্রী অন্যত্র চলে যাবে। তবে সাব্বিরের মতে, বিদায় অনুষ্ঠান বা ফেয়ারওয়েল হওয়া উচিৎ রেজাল্টের পর। যারা পাশ করবে, তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে। আজ এখন ফেয়ারওয়েল হলে, যারা ফেল করবে তারা আবার এই কলেজে পড়বে। ব্যাপারটা তাদের জন্য বিদায়ের চেয়ে বেশি কষ্টের। সাব্বিরের একার চিন্তাভাবনায় শতবর্ষের নিয়মনীতি পরিবর্তন হবে না। মাইকের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল সাব্বিরের। সঞ্চালক বলছেন, উপস্থিত অত্র কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এবং প্রভাষকবৃন্দ, সকল ছাত্রছাত্রী এবং কলেজের অন্যান্য কর্মচারী, আসসালামু আলাইকুম এবং শুভসকাল। আজ এই বিদায়ী অনুষ্ঠান শুরু হবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এর মাধ্যমে। পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করবে অত্র কলেজের ছাত্র মোঃ তাওহীদুল ইসলাম।
কোরআন তেলাওয়াত শেষে অধ্যক্ষ, তিন বিভাগ থেকে একজন করে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলকামনা করে বক্তৃতা দিলেন। এরপর প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের থেকে সিনিয়র ব্যাচদের শুভকামনা করে কয়েকজন বক্তৃতা দিল। এবার পরীক্ষার্থীদের পালা। মানবিক এবং বানিজ্য বিভাগ থেকে কয়েকজন ছেলেমেয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বক্তব্য দেওয়া শুরু করল। সবারই বক্তৃতা গৎবাঁধা ভাষায় পূর্ণ। শেষে সাব্বিরের নাম ডাকা হল। সাব্বির নিজেও জানত না যে তার নাম দেওয়া হয়েছে। ধীর পায়ে উঠে গেল স্টেজে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধুরা, জুনিয়র। পাশে চেয়ারে বসা অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকমণ্ডলী। কী দিয়ে শুরু করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না সাব্বির। সাব্বিরের জ্ঞান ছাপাকৃত বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। সে কখনো বক্তৃতা দেয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগে বিদায়ের দিন সে যায়ইনি বরং সেই সময়টায় সে পড়েছিল। আজও আসতে চেয়েছিল না। জেরিনকে বলেছিল যে ফেয়ারওয়েলে সে আসবে না। জেরিন বলল, তুমি না এলে আমিও আসব না। সেইজন্য সাব্বিরের আসা। আর এসেই ফেঁসে গেছে।
প্রায় মিনিট খানিক চুপ থাকার পর, সাব্বির কাঁপাকাঁপা গলায় ভণিতা ছাড়া বলতে শুরু করল, আমি বিদায়ী কথা বলতে পারি না। শিক্ষকদের সালাম দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করা উচিৎ ছিল। সেটা করিনি। কারণ আমি শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাবামায়ের মত সম্মান করি। আমি আমার মায়ের সাথে কখনো সালাম দিয়ে কথা বলিনি। বাবামাকে হারানোর পর মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দ্বারা সেই অভাবটা কিছুটা হলেও কমেছে। তারপর এই কলেজে আসার পর এখানের শিক্ষকদের থেকে সেই ভালবাসাটা পেয়েছি। কলেজ ছেড়ে চলে যাব, তার জন্য খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগছে এখানের অভিভাবকদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাবামাকে হারানোর পর আমার তিনকুলে কেউ নেই...
সাব্বিরের গলা ধরে আসছে। সে আর কথা বলতে পারল না। মাইক্রোফোন রেখে দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে গেল স্টেজ থেকে। সাব্বিরের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। পরিবেশটা কেমন গুমটভাব ধরে আছে। এরপর অধ্যক্ষ সমাপনী বক্তব্য দিয়ে বিদায়ী অনুষ্ঠান শেষ করলেন।
সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে জানালা ধরে। সবাই ব্যস্ত আছে শিক্ষকদের আশীর্বাদ সংগ্রহে আর সাব্বিরের মাথায় চিন্তা অন্যকিছু। কলেজের পক্ষ থেকে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে একটা করে দামী কলম দেওয়া হয়েছে। সাব্বিরেরটা জেরিন সংগ্রহ করে এনে তাকে দিয়ে বলল, নাও, তোমার কলম।
কলমটার দিকে কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে সাব্বির বলল, তোমাকে তো কখনো কিছু দিতে পারিনি, নাও। কলমটা নাও। এটাই তোমাকে দিলাম।
জেরিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোর কাটতেই বলল, সে কী? আমি কি তোমার কাছে কখনো কিছু চেয়েছি?
-নাহ, তা চাওনি। তবে দিতে ইচ্ছে করে।
-বুঝলাম। তো, আমি যা চাই, তাই দিতে পারবে?
-কী চাও?
-চাওয়ার কথাটা শেষ করার আগেই সব ছেলেমেয়েরা ওদের দিকেই চলে এলো। জেরিন বলতে পারল না তার অব্যক্ত চাওয়াগুলো। তবে সে সাব্বিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সাব্বির হয়তো বুঝতে পেরেছে। বাপ্পি এসে বলল, চল, আড্ডা দিব।
-আমার ভাল লাগছে নারে।
-ক্যান? কী হইছে?
-আরে, তেমন কিছু না। এমনিতেই ভাল লাগছে না।
-ধুর। চল তো।
সাব্বিরের ভাল না লাগাটা বুঝতে পেরেছিল জেরিন। কারণ তারও একই কারণে ভাল লাগছে না। কী অদ্ভুত! ভালবাসার মানুষগুলোর ভাল লাগার সাথে ভাল না লাগারও অদ্ভুত মিল থাকে।
মাসুম, প্রলয়, মৃদুল, শাওন ওরা সবাই আগে হাঁটছে। একটু পিছনে আসছে বাপ্পি আর সাব্বির। সাব্বিরের মুখটা শুকনা হয়ে আছে। বাপ্পি বেশ জোর দিয়েই বলল, সত্যি করে বল তো, তোর হয়েছে কী?
-বাপ্পি, আমি একটা মায়ামোহহীন জীবন যাপন করি। কিন্তু কেন যে একটা মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম।
-জেরিনের ব্যাপারটা?
-হ্যাঁ।
-কেন? সমস্যা কী?
-একটা সময় মনে হত, ও আমাকে শুধুমাত্র ভালবাসে, কিন্তু এখন বুঝছি ও আসলে আমাকেই চায়। আর সত্যি বলতে, আমিও ওকে চাই।
-তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ক্লিয়ার কর তো।
-তোকে আমি বোঝাতে পারব না। আমি আসলে ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছিরে, ফিরতে পারছি না।
-বাদ দে। যা হওয়ার তাই হবে।
ততক্ষণে শাওনদের বাসায় চলে এলো সবাই। আজ একটা মুভি দেখা হবে। হিন্দি 'থ্রি ইডিয়টস' মুভিটা সবাই মিলে দেখবে। হয়তো এমন মুহূর্ত জীবনে আর আসবে না।
মুভির একটা দৃশ্য দেখে সাব্বির ইমোশনাল হয়ে গেল। র্যানচো ছিল এতিম। তাকে একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে তার পালক পিতা তখন দত্তক নিয়ে নেয়। পালক বাবার আসল ছেলের পরিচয় নিয়ে সে লেখাপড়া করে।
বাপ্পি সিগারেট ধরালো। কয়েকজন নিয়মিত ধূমপায়ী হলেও সাব্বির কখনো সিগারেট ছোঁয়নি। আজ ইমোশনাল হওয়ার পর তার কেমন যেন লাগছে। বাপ্পির কাছ থেকে আধখাওয়া সিগারেট নিয়ে নিল। একটা টান মেরে ফিরিয়ে দিল বাপ্পির হাতে। এরপর প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে টানতে লাগল। সাব্বির বুঝতে পারল না সে কী ভুল করছে।
পরীক্ষা শুরু আজ। মেয়েদের সিট পড়েছে পাশের রুমে। ঘণ্টা পড়ার আগমুহূর্তে জেরিন আর সাব্বির দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলার জন্য মুখোমুখি দাঁড়ালো। সাব্বির কথা বলতেই জেরিন বলল, আমার খুব মাথা ধরেছে। পরীক্ষা শেষে ওয়েট কর।
সাব্বির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে পরীক্ষার কক্ষে চলে গেল।
প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির আর জেরিন। কেউ কিছু বলছে না। জেরিনের চোখে জল আসার উপক্রম। সাব্বির বুঝে উঠতে পারছে না কিছুই। বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখের জল মুছতে মুছতে জেরিন বলল, তুমি শেষপর্যন্ত এই পথ বেছে নিলে?
-কোন পথ?
-কোন পথ মানে? তুমি ন্যাকামি করছ আমার সাথে?
-আরে, বলবে তো।
-তুমি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছ?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল সাব্বির। জেরিন ধমক দিয়ে বলল, কী হল চুপ করে আছ কেন?
-আসলে ওদের সাথে সেদিন আড্ডার সময় শখ করে খেয়েছিলাম, তারপর মাঝেমাঝে একটু....
-চুপ। সকালে তোমার সাথে কথা বলার সময় সিগারেটের গন্ধে মাথা ধরে গেছে।
-সরি।
-সরি কিসের জন্য? আর যদি কখনো সিগারেট খাও, তাইলে কিন্তু ব্রেক আপ!
-আচ্ছা।
-মনে থাকবে?
-থাকবে।
-প্রমিজ?
-প্রমিজ।
-এইটা নাও।
-কী?
-কিছু টাকা আছে, রাখো।
-টাকা দিচ্ছ কেন?
-সিগারেট খাওয়ার জন্য।
-আমি টাকা নিব না।
-আরেরে বাবা, ধার হিসেবে নাও। দেখ, পরীক্ষার মধ্যে তুমি টিউশনিটা বন্ধ রাখো। ভাল করে পড়ে পরীক্ষা দাও। আর এটা দিয়ে চলো। পরে আমাকে ফেরত দিয়ে দেবে। তোমার আত্মসম্মানবোধকে আমি সম্মান করি সাব্বির। আর এইজন্য তোমাকে এতটা ভালবাসি।
নির্বাক একটা হাসি দিয়ে মাঠের মধ্য থেকে বেরিয়ে গেল দুজন।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন আর মফস্বলের দিকে সাব্বিরের যাওয়া হয় না। আর ওদের ব্যাচের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে শহরে এডমিশনের জন্য কোচিং করতে গেছে। আর সাব্বির সে একটা কোচিং সেন্টারে যোগদান করেছে শিক্ষক হিসেবে। জেরিনের সাথে যোগাযোগ নেই। একদিন জেরিনের ফোনে ফোন করল সাব্বির।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-জেরিন, আমি।
-সাব্বির, কেমন আছ?
-ভাল। তুমি?
-খুব একটা ভাল না। তোমার সাথে দেখা হয় না কতদিন!
-তুমি তো শহরে কোচিং করছ………
-হুম, আর তুমি?
-আমি? বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য কোচিং খুলেছি। বাড়ি আসবে কবে?
-ঈদের এক সপ্তাহ আগে। তোমার কোন ফোন আছে?
-না। তবে কোচিংয়ের ডিরেক্টরের নাম্বার আছে। তার নাম্বারে সকালে এবং বিকালে কল করলে আমাকে পাবে।
-আচ্ছা। নাম্বারটা দিও। আমি বাড়ি এসে ফোন করব।
ঈদের তিনদিন আগে ডিরেক্টর জাহিদ সাহেব সাব্বিরকে ডেকে বলল, তোমার কল এসেছে।
-কে ফোন করেছে ভাইয়া?
-জেরিন নামের কেউ।
জেরিনের নাম শুনে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে সাব্বিরের মধ্যে।
-হ্যালো জেরিন, কেমন আছ?
-তুমি কি আজ এখনি দেখা করতে পারবে?
সাব্বির একটু শঙ্কিতবোধ করল। জেরিনের কণ্ঠস্বরে কেমন যেন বিষাদের ছাপ। সাব্বির বলল, এখন? আমার আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। আর তোমার কী হয়েছে?
-সমস্যা নেই। তুমি আসো, আমি অপেক্ষা করছি।
-কোথায় আসব?
-কলেজে, আমগাছের নিচে।
জেরিন গাছের চারপাশে আস্তেআস্তে চক্কর দিচ্ছে। সাব্বির এখনো পৌঁছায়নি। অবশ্য জেরিন এমনিতেই অনেক আগে চলে এসেছে। বাসায় অস্থির লাগছিল তার। কলেজের পুকুরপাড়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখল সাব্বির জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে।
সাইকেলটা রেখে সাব্বির বলল, দেরী করে ফেললাম?
-নাহ। তুমি বরং তোমার টাইমের আগেই এসেছে। আমি আগে চলে এলাম। কেমন আছ সাব্বির।
ডান হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ভাল। তুমি?
-ভাল.... আছি।
জেরিনের 'ভাল আছি' বলার মধে জড়তা ছিল। সাব্বির এগিয়ে আসতেই ওড়না দিয়ে সাব্বিরের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতেই জেরিন কান্না শুরু করে দিল। সাব্বির হতভম্ব। জেরিনের দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে জেরিন? আমাকে তো বলবা, নাকি?
হেচকি ওঠা শুরু হয়েছিল জেরিনের। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে সে। সবুজ ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ভাইজান বাদাম লাগবো?
সাব্বির আর জেরিন দুজনেই নীরব। সবুজ দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না। সাব্বিরকে তার কেন জানি খুব ভাল লাগে। সাব্বিরের মনের মধ্যে কোন অশনিসংকেত বাজছে। সে অনেক কিছু বুঝতে পারে। এবং এটাও বুঝতে পারছে যে আজ জীবনের অন্যতম একটা কালোদিন।
সাব্বির স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে। সবুজকে বলল, পাঁচটাকার বাদাম দে।
বাদাম দিয়ে সবুজ দূরে সরে গেল। কিন্তু তার কেমনযেন লাগছে। সাব্বির ভাইজানের গলাটা আজ কেমনযেন ছিল। সামনে একটা ভিড় থেকে সবুজকে ডাকতেই সাব্বিরের কথা মাথা উড়ে গেল।
-সাব্বির, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
-ভাল তো। বিয়ে করে ফেলো।
-প্লিজ, তুমি কি বুঝতে পারছ না যে আমি কী বলছি?
-বুঝছি। আর আমি এটা ছাড়া তোমাকে আর কী বলতে পারি?
-আমি বাবাকে তোমার কথা বলব।
-তাতে কোন লাভ হবে না জেরিন। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা কর। তোমার বাবা একজন বুঝদার মানুষ এবং সর্বোপরি তোমার গার্জিয়ান। সে কখনোই তার মেয়েকে মেয়ের সমবয়সী কোন চালচুলোহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না। তার কাছে এটা করা মানে মেয়েকে মেরে ফেলা। আর কোন বাবাই তার সন্তানকে এমনভাবে মারতে পারে না।
-তোমার জ্ঞানের কথা বন্ধ কর। আমি অতকিছু বুঝি না। দরকার হয় আমরা পালিয়ে যাব।
-জেরিন, এসব ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা করা বাদ দাও। তুমি ভাল করে জান, এটা সম্ভব না।
-কেন সম্ভব না?
-আজ তুমি আবেগ নিয়ে আমার সাথে পালাবে। দুইদিন পর, যখন না খেয়ে থাকতে হবে, তখন ভালবাসাটার জায়গায় অভাব এসে দাঁড়াবে। কথায় আছে, অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর আমি জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত সব অভাবের মুখোমুখি। জন্মের কিছুদিন পর বাবার অভাব, মা মরে গেল তার পর। মায়ের অভাব কেটে ওঠার আগেই খাবারের অভাব, টাকার অভাব। ভালবাসার অভাব ছিল। সত্যি বলতে কী, তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো মিথ্যা হলেও খুব মধুর ছিল। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, ভাল লেগেছিল। শুধু ওই ভালোলাগাটুকুই। কিন্তু তুমি যখন বারবার আমাকে তোমার পবিত্র ভালবাসায় জড়াতে চাচ্ছিলে, আমি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, আমি তোমাকে ভাল না বেসে থাকতে পারিনি। ওটা আমার ভুল ছিল?
জেরিন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ভুল?
-হ্যাঁ, ভুল। ভুল বলছি এই কারণে যে, তখন যদি আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ তোমার এতটা খারাপ লাগত না। এক কাজ কর জেরিন, তুমি তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো।
কাঁদতে কাঁদতে জেরিন বলল, আমি পারব না সাব্বির।
-জেরিন, ভালবাসা মানে পাওয়া- তা কিন্তু নয়। ধরে নাও, তোমার জীবনে সাব্বির নামে কোন অধ্যায় ছিল না।
-এটা কি সম্ভব? তুমি কি তোমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে?
-পারব। আমাকে পারতে হবে জেরিন। এবং তোমাকেও পারতে হবে। পাগলামি কর না প্লিজ।
-তোমার কাছ থেকে আজ একটু আদর নিব, দিবে?
সাব্বির জেরিনের কথার কিছুই বুঝল না। জেরিন বলল, আমার চোখের জল মুছে দিবে?
সাব্বির বিনা দ্বিধায় জেরিনের মুখের দিকে হাত বাড়ালো। কিন্তু এ কী? সাব্বিরের হাত কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সাব্বির। তার হাতদুটো জোরে চেপে ধরে জেরিন বলল, সত্যি করে বল তো, তোমার কী খারাপ লাগছে না।
ভিতরটায় ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবুও স্বাভাবিকভাবে সাব্বির বলল, নাহ। কষ্ট হচ্ছে না। সামান্য খারাপ লাগছে। আর কষ্ট হবেও না।
কথাটা শেষ করে সাব্বির জেরিনের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ভাল থেকো জেরিন, সুখী হও।
-আমাকে কি তুমি আজ এগিয়ে দিবে আমার বাড়ি পর্যন্ত?
সাব্বির কথাটা শুনে খুব খুশি হল। তবুও হাসিটা আড়াল করে বলল, নাহ! তাতে মায়ার স্থায়িত্বকাল দীর্ঘ হবে। আর কী দরকার বল? যাও, তুমি নিজেই চলে যাও। ভ্যানে উঠে বাসায় চলে যাও।
সাব্বির হাঁটা শুরু করে হঠাৎ থেমে বলল, তুমি তো আমাকে অনেক ভালবাসো, তাই না?
জেরিন কথা বলল না। তার ঠোঁটদুটো কাঁপছে। সাব্বির বলল, সেই ভালবাসার দিব্যি দিয়ে অনুরোধ করছি, কখনো এই চালচুলোহীন ছেলেটার জন্য তোমার চোখের অমূল্য জলটুকু ফেলো না।
জেরিন কাঁদতে শুরু করছে। তার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে সাব্বির বলল, না জেরিন। তুমি কাঁদবে না। কখনোই না। তোমাকে কান্না করলে মানায় না। তুমি কখনোই কাঁদবে না।
সাব্বির হেঁটে চলে যাচ্ছে। ডানহাতে সাইকেল ধরে হাঁটছে। সে একবারও পিছন ফিরে তাকাচ্ছে না। কিন্তু সে জানে, জেরিন তার দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না যে সাব্বিরের চোখের জলে শুষ্ক বুকটা ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই জেরিন ঠাই তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। মানুষ কতটা শক্ত হলে পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে এমনভাবে চলে যেতে পারে? চোখ বন্ধ করে আবার তাকালো জেরিন। নীলচে ধোঁয়ার মধ্যে কেমনযেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এইতো, এখন আর মোটেও দেখা যাচ্ছে না সাব্বিরকে। আকাশে ঝকঝকে সূর্য। মধ্য দুপুরে তৃষ্ণার্ত কাকের কর্কশ গলায় কাঁ কাঁ শোনা যাচ্ছে। তবুও চারদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, তবুও।
তবুও শেষ পর্ব।
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:41 PM
Rating:

No comments