একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০৩

গল্প : একটি দ্বৈত প্রেমের ইতি কথা
পর্ব : ৩
নাতাশা কি বললো এটা? ওর মাকে ওরা অনেক আগেই মেরে ফেলেছে মানে! আমি এবার ফিরে গেলাম ওর কাছে। ততক্ষণে ওর কপল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। হ্যা, আবছা আলোয় আমি তো তাই দেখতে পাচ্ছি। স্বভাবতই মেয়েরা কাঁদলে তাঁদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। তবে, সেটাও ক্ষেত্র বিশেষ। বাঙ্গালি মেয়েরা যখন কাঁদে তখন সে অবিবাহিত হলে বিছানায় পড়ে বালিশকে আঁকড়ে ধরে। বালিশ যেন তখন আর বালিশ থাকেনা তাদের প্রানের সই হয়ে যায়! আর বিবাহিত হলে স্বামীর বুকে মাথা রাখতে চায়। স্বামী যদি স্ত্রীকে তখন ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে তাতে ওদের কান্না আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারণ, একটি মেয়ের কাছে তার বাবার পরে সবচেয়ে প্রশান্তির জায়গা হলো স্বামীর বক্ষ।
আমি ওর প্রতি সহানুভূতি দেখাবো নাকি ওকে জিজ্ঞেস করবো এর পেছনে থাকা রহস্যটি আসলে ঠিক কি তা বুঝে উঠতে পারছিলামনা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমি ওর থেকে প্রায় আড়াই ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি। ও আমার সামনে। দুজন মুখোমুখি। আর কিছু বলছেনা নাতাশা। এবার আমি নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনি কি বললেন এটা? আপনার মাকে ওরা মেরে ফেলেছে মানে? তাহলে ঐ ভদ্রমহিলা কে?
নাতাশা এবার ওড়না দিয়ে ওর চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
-সে অনেক কথা। বাদ দিন তো। চলুন যাওয়া যাক!
আমি,
-আপনি আমাকে কথাগুলো বলতে চান বলেই এটি বলেছেন। নয়ত, এই একদিনের পরিচয়ে কেউ এতবড় একটা বিষয় এভাবে বলে দিবেনা। ঠিক কি হয়েছিলো আপনার মায়ের সাথে সেটা বলুন আমায়। আমি জানতে চাই।
এমন সময় নাতাশার ফোনে কল আসলো একটি। ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে ও বললো,
-জাস্ট ওয়ান মিনিট....
এই বলে ও ফোনটা রিসিভ করলো। আমি চুপচাপ ওর সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কথা শুনে বুঝতে পারলাম ঐ ভদ্রমহিলা কল দিয়েছিলেন। কথা শেষ করে ও বললো,
-মা কল দিয়েছিলেন। বলেছেন, আপনি যেন আমাদের সাথে ডিনার করে যান।
আমি কিছুটা অবাক হলাম। বললাম,
-আপনি কি বলবেন ঠিক কি হয়েছিলো আপনার মায়ের সাথে?
নাতাশা,
-শুনবেন?
আমি,
-হ্যা বলুন!
ও বলতে লাগলো,
-'তখন সুমু আর আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। বাবা বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাই আমাদেরকে তেমন সময় দিতে পারতেননা। মা'ই ছিলেন আমাদের পৃথিবী। তিনিই আমাদেরকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। কাজের লোকের সাথে যেতে দিতেননা। একদিন স্কুল শেষে আমাদের দুবোনকে নিয়ে মা বাসায় ফিরলেন। সেদিন বাসায় ফিরে আমি আর মা যা দেখি তা মনে হলে আজো সেই বাবা নামের মানুষটির প্রতি আমার মনে শুধু ঘৃণাই জন্মে। কারণ, উনি সেদিন তার অফিসের একজন মহিলাকে নিয়ে আমাদের বাসায় ফুর্তি করছিলেন যাকে কিনা আজ আমাদের মা ডাকতে হয়! আমার বাবা ছিলেন ঘরজামাই। বলতে, আমার মা ছিলেন নানার একমাত্র আদরের মেয়ে। তাঁর আর কোন সন্তান ছিলোনা। নানা তাঁর মেয়ের নামে সকল প্রপার্টি লিখে দেন। আর আমাদের দু'বোনের জন্মের পর তার পুরোটাই মা আমাদের নামে লিখে দেন। বোধশক্তি হবার পর থেকেই দেখে আসছিলাম এই প্রপার্টির জন্য বাবা গভীর রাতেও মাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে তাঁর গায়ে হাত তুলতেন। জবরদস্তি করতেন যেন সবকিছু উনাকে মা লিখে দিয়ে দেন।
যদিও আমরা দুজন সমান তবুও সুমু সবসময় এসব দেখে ভয় পেত। মাকে বাবা যখন মারতো তখন আমরা বিছানার এক কোণে কাচুমাচু খেয়ে বসে থাকতাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতো সুমু। আমরা শুধু কাঁদতাম। এভাবেই চলছিলো আমাদের শৈশব। অর্থবিত্তের কোন অভাব না থাকলেও আমরা দুবোন ছিলাম বাবার ভালোবাসা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত আর মা তাঁর স্বামীর আদর আর ভালোবাসা থেকে।'
আমি এবার নাতাশাকে থামিয়ে দিলাম। বললাম,
-আপনার মাকে ওরা কিভাবে মারলো?
আমার প্রশ্নটি শুনে এবার কেঁদে উঠলো ও। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
-আমাদের ভাগ্যে একদিন ক্ষণিকের জন্য বাবার আদর, স্নেহ আর ভালোবাসা জুটেছিলো। মায়ের কপালেও জুটেছিলো তাঁর স্বামীর ভালোবাসা। তবে, সেদিনের সেই মিথ্যে ভালোবাসাই আমাদের থেকে চিরদিনের জন্য আমাদের মাকে কেঁড়ে নেয়। বাবা সেদিন আমাদের সাথে স্কুলে আসেন। আমাকে আর সুমুকে স্কুলে দিয়ে মাকে নিয়ে শপিং করতে যাবেন বলে চলে যান। তখনি শেষবার মায়ের সোনামুখখানি দেখি। এরপর মা আর ফিরেননি আমাদের মাঝে। সুমুর থেকে মেন্টালি স্ট্রং ছিলাম আমি। সমান হয়েও ওর উপর বড় বোনের মতো দায়িত্ব পালন করতে থাকি। সেদিনের পর কিছুদিন যাবৎ বাবাকে যতবার মায়ের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম ততবারই মাকে নিয়ে বাবা বাজে কথা বলেছেন আমাদের। বলেছেন, 'তোদের মা চলে গেছে কারোর সাথে। সে আসবেনা আর।'
আমি আবারো থামিয়ে দিলাম নাতাশাকে। বললাম,
-এপর্যন্ত তো আপনার মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি। তো উনাকে যে মেরে ফেলা হয়েছে সেটা জানলেন কখন?
নাতাশা,
-সেটা নিশ্চিত হয়েছি বাবার একটি ফোনালাপ শুনে। মায়ের নিখোঁজের পর আমি সবসময়ই সুমুকে গোসল করিয়ে দিতাম, খাইয়ে দিতাম, ঘুম পারিয়ে দিতাম। একদিন রাতে ও খুব কান্নাকাটি করছিলো মায়ের জন্য। ওকে সামলাতে পারছিলামনা আমি। আমিও তো মানুষ। আর এত অল্পবয়সে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সামর্থ্য যদিও আমার ছিলোনা তথাপি, জানিনা আমার মাঝে এত দায়িত্ববোধ কিভাবে চলে এসেছিলো। সেদিন রাতে আমরা দুবোন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। আমার আজো সেই রাতের কথা ভাবলে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। সুমুকে ঘুম পারিয়ে আমি ওয়াশরুমে যাই। ফেরার সময় দেখি বাবাও ফোনে কথা বলতে বলতে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছেন। তখন আমরা দু'বোন বাবার পাশের রুমে থাকতাম। বাবাকে ওয়াশরুমের দিকে যেতে দেখে আমি কিনা কি যেন মনে করে উনার পিছুপিছু যাই। আর তখনি শুনি অপরপ্রান্তে থাকা কাউকে উনি বলছেন, 'আরে বোকা, আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো। ওদের বয়স কম। কদিন আর মা ছাড়া থাকবে বলো। ঐটাকে তো আমরা মেরেই ফেলেছি। মরা মানুষ কি আর উঠে আসবে নাকি? কদিন যাক তারপর তোমাকে বউ করে নিয়ে আসবো।'
সেদিনের ছোট্ট সেই আমি যখন নিজের জন্মদাতা বাবার মুখে এসব কথা শুনি তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো। তখন চুপিসারে কোনরকম আমি নিজেকে সামলে রুমে ফিরে আসি। বিছানায় পড়ে কাঁদতে থাকি। আমাদের দুটি বোনের জন্মই যেন হয়েছিলো কাঁদার জন্য। এর কিছুদিন পর বাবা এই মহিলাকে নিয়ে এসে বলেন উনাকেই মা ডাকতে হবে। বাবা আর উনি মিলেই যে মাকে মেরেছেন সেটা কেবল এতদিন আমিই জানতাম। আর আজ আপনাকে বললাম।
এবার আমি বললাম,
-সুমু এখনো জানেনা এবিষয়ে?.
নাতাশা,
-না। ও সহ্য করতে পারবেনা বলে ওকে আমি আর কিছু জানাইনি। যখন এই মহিলা আসলেন তখন থেকে ধীরেধীরে ও উনাকে মায়ের মতো ভাবতে লাগলো। ওর মুখে হাসিখুশি ফিরে আসলো। মায়ের বিয়োগ ব্যথা অনেকটাই কেটে গেল ওর। আর এসব দেখে আমি ওকে আর কিছুই জানাইনি।
এবার আমি বললাম,
-আপনার বাবার কেন হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো?
নাতাশা,
-এটা উনার পাপের সাজা ছিলো। সুস্থই ছিলেন। হঠাৎ করেই একদিন সকালে হার্ট অ্যাটাক হয় উনার। স্পটেই মারা যান।
নাতাশার মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে কখন যে আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো নিজেও টের পাইনি। আমাকে কাঁদতে দেখে ও বললো,
-একটা কথা বলবো!
আমি,
-হ্যা বলুন!
নাতাশা,
-আমি সবকিছু ভেবেচিন্তেই আপনাকে বিয়ের কথা বলেছি। আমি অনেক লড়াই করে এপর্যন্ত এসেছি। যদিও নিজেদের দৌলতের কোন অভাব নেই তবে, আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি পারি দিয়েছি। একজন মানুষকে চিনতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়না। আমারো হয়নি। আমি ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে হ্যা, এতে রাজি হওয়া না হওয়াটা সম্পূর্ণ আপনার বিষয়। যদি হন, তাহলে হয়ত আমার থেকে সুখী পৃথিবীর আর কেউ হবেনা। আর যদি না হন, তবে ভাববো আমি কোন অমূল্য জিনিস হাতের কাছে পেয়েও সেটা নিজের করে নিতে পারিনি। নিজেকে শুধু হতভাগীই মনে হবে। চলুন এবার যাওয়া যাক!
এই বলে নাতাশা ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। ও টের পেলো আমি যাচ্ছিনা। দাঁড়িয়ে গেল ও। পেছন ফিরে তাকালো এবার। বললো,
-কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে রইলেন যে?
আমি বললাম,
-তাইলে কি এটাই ছিলো আমার রাজকুমারী?
আমার মুখে এমন কথা শুনে নাতাশা নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো ওর। পৃথিবীর সকল লজ্জা যেন ওকে আবৃত করে ফেলেছে এবার। এগিয়ে গেলাম আমি। কাছাকাছি গিয়ে বললাম,
-চোখের পানি মুছে ফেলুন! আর কাঁদবেননা। চলুন এবার যাওয়া যাক!
নাতাশা ওর মুখ থেকে ওড়ানাটি সরিয়ে নিলো এবার। কাঁদতে কাঁদতে ওর চেহারাটা রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে ও হেসে দেয়। সেদিন যদি সেই মুহুর্তে আমি নাতাশার চেহারায় ঐ হাসিটা দেখতে না পেতাম তাহলে হয়ত পৃথিবীর অন্যতম একটি সৌন্দর্যের মুখোমুখি হওয়া থেকে আমি বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। যা কিনা সত্যিই বিরল।
দুজনে ফিরলাম এবার বাসায়। ডাইনিংয়ে অলরেডি খাবার দেয়া হয়ে গেছে। খালা দিয়েছেন। আমাদেরকে দেখে বললেন,
-আপনারা গিয়ে বসুন আমি উনাদেরকে ডেকে দিচ্ছি।
হাত ধুয়ে আমরা দুজনই বসলাম। নাতাশা কিছুটা লজ্জাবোধ করছে লক্ষ্য করলাম। এটা মেয়েদের স্বভাবজাত অভ্যেস। কিছুক্ষণ পরই সুমু আর ভদ্রমহিলা আসলেন। তারাও বসলেন। খেতে শুরু করলাম আমরা।
খাবার শেষে ভদ্রমহিলা বলে দিলেন আমি চাইলে যেকোন দিন যেকোন সময় উনাদের এখানে শিফট করতে পারি। উনার সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ শেষে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই আমি। ঘড়ির কাটা তখন রাত নয়টা। ব্যস্ত শহরের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত লাখো যুবকের নিরব আর্তনাদের সাক্ষী ঐ ল্যাম্পোস্টগুলোর আবছা আলোয় আমি হারিয়ে গেলাম নাতাশার সেই ভয়ঙ্কর শৈশবে। ভাবতে লাগলাম, 'মেয়েটি কি করে এমন একটি পরিস্থিতি থেকে ওভার কাম করলো?'
------চলবে------
একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০৩ একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০৩ Reviewed by গল্প প্রেমিক on 3:52 PM Rating: 5

No comments

হৃদয়স্পর্শী গল্প

হৃদয়স্পর্শী গল্প