একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০৪
ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঝাপসা চোখে ফোনের স্কিনের
দিকে তাকালাম এবার। নম্বরটি অপরিচিত। চোখ কচলে আবার ভালো করে তাকালাম।
হ্যা, নম্বরটি অপরিচিতই। সময় রাত বারোটা পনেরো মিনিট। স্কিনের দিকে তাকিয়ে
থেকেই ভাবছি, কি ব্যাপার, এর আগে তো এত রাতে আমাকে কেউ কল দেয়নি! রিসিভ
করলাম এবার।
আমি,
-আসসালামুআলাইকুম।
ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ এলোনা। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল। আমি বললাম,
-কে আপনি? আর এত রাতে কার কাছে ফোন দিয়েছেন?
এবারো কোন উত্তর এলোনা। কিছুটা অবাক হলাম আমি। কেটে দিলাম ফোনটা। বালিশের কাছে ফোন রেখে ঘুমানোর অভ্যাস আমার আগে ছিলো। এখন তা করিনা। কারণ, এর থেকে নির্গত রেডিয়েশন আমাদের মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই অন্তত রাতে ঘুমানোর সময় হলেও ফোনটিকে আড়াই থেকে তিনহাত দূরে রাখা উচিৎ। আমিও রাখি।
আমার বিছানার পাশেই টেবিল। তাতে ফোনটা রেখে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম তখন আবারো কল আসলো। এবার ফোনটা নিয়ে উঠে বেলকনিতে চলে আসলাম। রিসিভ করলাম। নাহ, এবারো কোন সাড়াশব্দ নেই। বিরক্তিকর লাগছে বিষয়টা। কয়েক মুহুর্ত যাবার পর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো কেটে দিলাম। এবার নম্বরটি কপি করে ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকলাম। সার্চ অপশনে গিয়ে নম্বরটি পেস্ট করে সার্চ দিলাম। হ্যা, একটা আইডি এসেছে যার নাম দেখে আমার চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেলো!
আইডির নাম, 'ফারহানা জামান সুমু!' ঢুকলাম টাইমলাইনে। বিড়াল, ফুল, চুড়ি, পুতুল ইত্যাদির ছবি দিয়ে ভরপুর। নাহ, লিখালিখি করেনা। মনের আবেদন-নিবেদন বা আশা আকাঙ্খা, পাওয়া না পাওয়া, বিরহ-বেদনা, চিন্তা-চেতনা এসব নিয়ে কোন পোস্টও নেই। এবাউটে ঢুকলাম। কয়েকটি সাহিত্য রিলেটিভ পেজের ফলোয়ার সে। রিলেশনশিপ স্টেটাস সিঙ্গেল। জেন্ডারও ফিমেল দেয়া। আর ফ্যামিলি মেম্বার? ফ্যামিলি মেম্বারে আছে সাবিহা জামান নামের একটি মেয়ে। ঢুকলাম ঐ আইডিতেও। এবার ঐ আইডির প্রোফাইল আমার সামনে। নিকনিম সহ যেন পুরো নামটাই ঝলমলিয়ে উঠলো! হ্যা, নিকনিম সহ পুরো নাম, 'সাবিহা জামান নাতাশা।'
এবার আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে, কলটি যেই করে থাকুক সেটা ওদের দু'বোনের মধ্যে যেকোন একজন করেছে। ডাটা অফ করে দিয়ে ঐ নম্বরে কল দিলাম এবার। সাথে সাথে রিসিভ করে ফেললো। কিন্ত রিসিভ করে সেই আগের মতোই চুপচাপ রয়ে গেল। আমিও চুপচাপ। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। দুজন থেকে কে হতে পারে এটা? ও লাইনে আছে তবে চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। আমিও আছি। কোন কথা বলছিনা। অমনি শুনতে পেলাম অপরপ্রান্তে পাশে কেউ বলে উঠলো, 'কিরে, ঘুমাস না কেন? হেডফোন খুল এবার! এভাবে গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে যাবি টেরও পাবিনা। এসব ভালো নয়। ঘুমা!'
কণ্ঠটা স্পষ্ট নয় তবে এটা বুঝা যাচ্ছিলো যে, কিছুটা সর্দি সর্দি ভাব। অনেক মানুষই আছে যারা হঠাৎ করে বেশি কান্নাকাটি করলে একটু সর্দি সর্দি ভাব চলে আসে। তবে কি এটা সুমু লাইনে আছে! আর ঐ কণ্ঠটা নাতাশার?
আর দেরি করলামনা। বলেই ফেললাম,
-কি ব্যাপার সুমু, এত রাতে কল দিয়েছ যে?
কিছু একটার শব্দ ভেসে আসলো ওপাশ থেকে। হয়ত ও বিছানা থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেছে। যদিও ও আমার সামনে নয় তবে, সবকিছুই যেন আমি কল্পনা করতে পারছি। অনেকটা ঠিক সেভাবেই, যেভাবে এই গল্পটি পড়ার সময়ে আপনারাও পুরো কাহিনীর দৃশ্যপটগুলো মনের চোখে কল্পনা করতে পারছেন।
জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলো ও। আমি জানি, এবার ও কথা বলতে বাধ্য। কিছুক্ষণ পর ও বললো,
-আপনি আমাকে ধরলেন কি করে? কি করে বুঝতে পারলেন যে আমিই সুমু?
আমি হেসে দিলাম এবার। বললাম,
-তুমি এতটাও চালাক নও যে তোমাকে ধরতে আমার খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। এবার বলো এত রাতে একা একা ছাদে এসেছ কেন?
ও আমার কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,
-ছাদে এসেছি মানে? আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? কি করে জানলেন আমি যে ছাদে এসেছি?
আমি,
-ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে এটা চেক করে লাভ নেই যে তুমি আমার সাথে ভিডিও কলে আছো কিনা। আমি তোমার সাথে অডিও কলেই কথা বলছি। আর হঠাৎ করেই তোমার শ্বাস নেয়ার শব্দ বেড়ে যাওয়ায় বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমার সাথে কথা বলার জন্য নিরব কোন জায়গায় যাচ্ছো। যেটা ছাদ। কারণ, স্বভাবতই মানুষ যখন তাড়াহুড়ো করে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার শ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হয়। আর তুমি তো মেয়ে মানুষ। তোমাকে ধরা আরো সহজ।
এবার ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
-আপনি না! আসলে, কি যে বলবো.....
আমি,
-ওকে, কাম টু দ্যা পয়েন্ট! এবার বলো কেন এই এত রাতে কল দেয়া?
সুমু,
-এতকিছু বুঝলেন। না দেখে বলেও ফেললেন আমি যে সুমু। জোড়ে শ্বাস নিলাম বলে তাতেও ধরে ফেললেন ছাদে এসেছি। আর এত রাতে একটি মেয়ে কেন একটি ছেলেকে কল দিতে পারে এখনো সেটা ধরতে পারেননি? বিষয়টি কি আমাকে বিস্মিত করেনা বলুন!
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। বললাম,
-সেটা আমি ডাইনিংয়ে বসেই টের পেয়েছিলাম। এবং ভয়েও ছিলাম এটা নিয়ে। কিন্ত তুমি ভুল পথে হাটছো সুমু। প্লিজ মাইন্ড থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও!
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে এবার সুমু বললো,
-আপনার কি মনে হয়, আপনি আমাকে রিজেক্ট করে দিলে আমি এই চেহারা নিয়ে কাল আপনার সামনে যাব? হেরে গিয়েও আমি আপনার সামনে গিয়ে হাসবো? যদি সেটাই ভেবে থাকেন তাহলে আপনিও ভুল পথেই হাটছেন।
আমি অনেকটাই অবাক হলাম ওর এমন উদ্ভট সব কথাবার্তায়। বললাম,
-তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এতে তোমাকে কেউ সাপোর্ট করছে। কে সে?
সুমু,
-ইউ আর গ্রেট! কি চিন্তাশক্তি আপনার! সত্যিই প্রশংসা করতে হয়। ঠিকই ধরেছেন। এতে আমার মায়ের সাপোর্ট রয়েছে। আর এরই মধ্যে মা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে, আপনার সাথে আমার বিয়ে দিবেন। এইযে আপনাকে এখানে শিফট করতে বলা, আমাদের সাথে খাওয়াদাওয়া করতে বলা, এসবই শুধুমাত্র কয়েকদিনের জন্য। তারপর আপনার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। মাঝে, আমি শুধু চাইছিলাম যে আপনার সাথে যেন একটু ভাব জমিয়ে নিতে পারি। যাইহোক, আপনি আগেই সব জেনে ফেলেছেন তাতে ভালোই হলো।
এবার ফোনটা কেটে দিয়ে রেগে গিয়ে একেবারে ফ্লাইটমোড চালু করে দিলাম। সুমুর কথাগুলো শোনার পর যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পেছনের দিকে যেতে লাগলাম আমি। কি কি ঘটেছে আজ বিকাল থেকে আমার সাথে। কার কার কার সাথে কি কি কথা হয়েছে আমার। সুমু, নাতাশা, ওদের মা, খালা ওরা কে কে কি কি কথা বলেছে আমার সাথে সবকিছু ভাবতে লাগলাম আমি। এ যেন কোন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম। তবে, এখানে ধাঁধা থেকেও বেশি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি।
প্রথমত, সুমু আর নাতাশা সমবয়সী। একই কলেজে একই ক্লাসে পড়ে। তবে, ভদ্রমহিলা আমাকে শুধুমাত্র সুমুকেই রেগুলার পড়াতে বললেন কেন? কেন নাতাশা বাইরে পড়বে? তবে কি পড়ানোর বাহানায় দুজুনের মধ্যে লাভের রসায়ন তৈরির ফন্দি করেছিলেন তিনি? আপাতত তো সেটাই মনে হচ্ছে আমার।
দ্বিতীয়ত, নাতাশা ওর স্মৃতিচারণের সময় বলেছিলো ও ছোটবেলা থেকেই সুমুর থেকে মেন্টালি অনেক স্ট্রং। তবে কি সুমুর মানসিক কোন সমস্যা রয়েছে যা কিনা নিজের বোন বলে কৌশলে সেটাকে এড়িয়ে গেছে নাতাশা? এটা আরেকটা পয়েন্ট হতে পারে।
তৃতীয়ত, নাতাশা বলেছিলো ওদের নানা তাঁর সকল প্রপার্টি ওদের মায়ের নামে করে দেয়। উনাকে তো মেরে ফেলা হয়েছিলো। আর ওদের বাবাও তো হার্ট এ্যাটাক করে মারা যায়। আর প্রপার্টি? প্রপার্টি তো নাতাশার মা ওদের দু'বোনের নামে লিখে দিয়েছিলেন। তবে কি এই প্রপার্টি হাতিয়ে নিতেই নতুন কোন নীল নকশা তৈরি করা হয়েছে?
সবকিছুর পেছনেই আমি শুধুমাত্র একজনেরই কারসাজির গন্ধ পাচ্ছিলাম আর তিনি হলেন মা নামের ঐ ভদ্রমহিলা। এবার ভাবতে লাগলাম আমি। কি করব এখন? কি করা যেতে পারে আর এমন পরিস্থিতিতে আমার ঠিক করাটাই বা উচিৎ।
সুমুর মানসিক সমস্যা থাকাটা নিয়ে আমি প্রায় অনেকটাই নিশ্চিত। আর একারণেই ভদ্রমহিলা ওকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় ত্রিশ মিনিট কেটে গেল। এবার ঠিক করলাম আবার ঐ নম্বরে কল দিব। যদি এতক্ষণে সুমু ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ফোনটা নাতাশার রিসিভ করার চান্সটাই বেশি। কেননা, যেসকল মানুষ মেন্টালি উইক হয় ওরা একবার ঘুমে ডুবে গেলে দিনদুনিয়ার আর কোন খবর বলতে পারেনা। ঠিক এর উল্টো চিত্র নাতাশার মতো মেয়েদের ক্ষেত্রেও। শুধু মেয়েদেরই নয় ছেলেদের বেলায়ও এটা লক্ষ্য করা যায়।
স্থির করলাম কল দিব। অবশ্য, যদিও নাতাশার কল রিসিভ করার ক্ষেত্রে চান্সটা বেশি। তবে রিক্স নিলামই। দিলাম কল। রিং হচ্ছে। কে জানে ফোন কোন মোডে রাখা। কেটে দিলো ফোনটা। অবাক হলাম। আর কল দিলামনা। পায়চারি করতে লাগলাম বেলকনিতে।
মিনিট দুয়েক পরে কল আসলো সুমুর নম্বর থেকে। রিসিভ করলাম। তবে বেশ ভালো লাগলো নাতাশার কণ্ঠে সালামটা শুনে। অপরপ্রান্ত থেকে ও বলে উঠলো,
-আসসালামুআলাইকুম।
আমি,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম।
নাতাশা,
-কি ব্যাপার, এত রাতে সুমুকে কল দিলেন যে?
আমি,
-ও কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল দিয়েছিলো। কিছু বিষয় সামনে এসেছে যা থেকে আমি অনেক বিচলিত।
নাতাশা,
-কি হয়েছে?
আমি,
-সুমুকে আমার সাথে আপনার মা বিয়ে দিতে চান। এজন্যই এত আয়োজন। সুমুর কথা শুনে আমি যেটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি তা হলো, উনি খুব সুক্ষ্মভাবেই সব প্ল্যান সাজিয়েছেন। অনেককিছুই আপনার অগোচরে, অজান্তে হচ্ছে অথচ আপনি তা টেরও পাচ্ছেননা।
নাতাশা কিছু বলছেনা। চুপ করে আছে ও। আমি বললাম,
-আপনি কোথায় এখন?
নাতাশা এবার মৃদুস্বরে বললো,
-ছাদে।
আমি বললাম,
-ছাদে মানে? আপনি কি জানতেন যে এটা আমার নম্বর?
নাতাশা,
-হ্যা, জানতাম।
-------চলবে-------
আমি,
-আসসালামুআলাইকুম।
ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ এলোনা। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল। আমি বললাম,
-কে আপনি? আর এত রাতে কার কাছে ফোন দিয়েছেন?
এবারো কোন উত্তর এলোনা। কিছুটা অবাক হলাম আমি। কেটে দিলাম ফোনটা। বালিশের কাছে ফোন রেখে ঘুমানোর অভ্যাস আমার আগে ছিলো। এখন তা করিনা। কারণ, এর থেকে নির্গত রেডিয়েশন আমাদের মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই অন্তত রাতে ঘুমানোর সময় হলেও ফোনটিকে আড়াই থেকে তিনহাত দূরে রাখা উচিৎ। আমিও রাখি।
আমার বিছানার পাশেই টেবিল। তাতে ফোনটা রেখে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম তখন আবারো কল আসলো। এবার ফোনটা নিয়ে উঠে বেলকনিতে চলে আসলাম। রিসিভ করলাম। নাহ, এবারো কোন সাড়াশব্দ নেই। বিরক্তিকর লাগছে বিষয়টা। কয়েক মুহুর্ত যাবার পর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো কেটে দিলাম। এবার নম্বরটি কপি করে ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকলাম। সার্চ অপশনে গিয়ে নম্বরটি পেস্ট করে সার্চ দিলাম। হ্যা, একটা আইডি এসেছে যার নাম দেখে আমার চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেলো!
আইডির নাম, 'ফারহানা জামান সুমু!' ঢুকলাম টাইমলাইনে। বিড়াল, ফুল, চুড়ি, পুতুল ইত্যাদির ছবি দিয়ে ভরপুর। নাহ, লিখালিখি করেনা। মনের আবেদন-নিবেদন বা আশা আকাঙ্খা, পাওয়া না পাওয়া, বিরহ-বেদনা, চিন্তা-চেতনা এসব নিয়ে কোন পোস্টও নেই। এবাউটে ঢুকলাম। কয়েকটি সাহিত্য রিলেটিভ পেজের ফলোয়ার সে। রিলেশনশিপ স্টেটাস সিঙ্গেল। জেন্ডারও ফিমেল দেয়া। আর ফ্যামিলি মেম্বার? ফ্যামিলি মেম্বারে আছে সাবিহা জামান নামের একটি মেয়ে। ঢুকলাম ঐ আইডিতেও। এবার ঐ আইডির প্রোফাইল আমার সামনে। নিকনিম সহ যেন পুরো নামটাই ঝলমলিয়ে উঠলো! হ্যা, নিকনিম সহ পুরো নাম, 'সাবিহা জামান নাতাশা।'
এবার আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে, কলটি যেই করে থাকুক সেটা ওদের দু'বোনের মধ্যে যেকোন একজন করেছে। ডাটা অফ করে দিয়ে ঐ নম্বরে কল দিলাম এবার। সাথে সাথে রিসিভ করে ফেললো। কিন্ত রিসিভ করে সেই আগের মতোই চুপচাপ রয়ে গেল। আমিও চুপচাপ। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। দুজন থেকে কে হতে পারে এটা? ও লাইনে আছে তবে চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। আমিও আছি। কোন কথা বলছিনা। অমনি শুনতে পেলাম অপরপ্রান্তে পাশে কেউ বলে উঠলো, 'কিরে, ঘুমাস না কেন? হেডফোন খুল এবার! এভাবে গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে যাবি টেরও পাবিনা। এসব ভালো নয়। ঘুমা!'
কণ্ঠটা স্পষ্ট নয় তবে এটা বুঝা যাচ্ছিলো যে, কিছুটা সর্দি সর্দি ভাব। অনেক মানুষই আছে যারা হঠাৎ করে বেশি কান্নাকাটি করলে একটু সর্দি সর্দি ভাব চলে আসে। তবে কি এটা সুমু লাইনে আছে! আর ঐ কণ্ঠটা নাতাশার?
আর দেরি করলামনা। বলেই ফেললাম,
-কি ব্যাপার সুমু, এত রাতে কল দিয়েছ যে?
কিছু একটার শব্দ ভেসে আসলো ওপাশ থেকে। হয়ত ও বিছানা থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেছে। যদিও ও আমার সামনে নয় তবে, সবকিছুই যেন আমি কল্পনা করতে পারছি। অনেকটা ঠিক সেভাবেই, যেভাবে এই গল্পটি পড়ার সময়ে আপনারাও পুরো কাহিনীর দৃশ্যপটগুলো মনের চোখে কল্পনা করতে পারছেন।
জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলো ও। আমি জানি, এবার ও কথা বলতে বাধ্য। কিছুক্ষণ পর ও বললো,
-আপনি আমাকে ধরলেন কি করে? কি করে বুঝতে পারলেন যে আমিই সুমু?
আমি হেসে দিলাম এবার। বললাম,
-তুমি এতটাও চালাক নও যে তোমাকে ধরতে আমার খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। এবার বলো এত রাতে একা একা ছাদে এসেছ কেন?
ও আমার কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,
-ছাদে এসেছি মানে? আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? কি করে জানলেন আমি যে ছাদে এসেছি?
আমি,
-ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে এটা চেক করে লাভ নেই যে তুমি আমার সাথে ভিডিও কলে আছো কিনা। আমি তোমার সাথে অডিও কলেই কথা বলছি। আর হঠাৎ করেই তোমার শ্বাস নেয়ার শব্দ বেড়ে যাওয়ায় বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমার সাথে কথা বলার জন্য নিরব কোন জায়গায় যাচ্ছো। যেটা ছাদ। কারণ, স্বভাবতই মানুষ যখন তাড়াহুড়ো করে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার শ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হয়। আর তুমি তো মেয়ে মানুষ। তোমাকে ধরা আরো সহজ।
এবার ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
-আপনি না! আসলে, কি যে বলবো.....
আমি,
-ওকে, কাম টু দ্যা পয়েন্ট! এবার বলো কেন এই এত রাতে কল দেয়া?
সুমু,
-এতকিছু বুঝলেন। না দেখে বলেও ফেললেন আমি যে সুমু। জোড়ে শ্বাস নিলাম বলে তাতেও ধরে ফেললেন ছাদে এসেছি। আর এত রাতে একটি মেয়ে কেন একটি ছেলেকে কল দিতে পারে এখনো সেটা ধরতে পারেননি? বিষয়টি কি আমাকে বিস্মিত করেনা বলুন!
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। বললাম,
-সেটা আমি ডাইনিংয়ে বসেই টের পেয়েছিলাম। এবং ভয়েও ছিলাম এটা নিয়ে। কিন্ত তুমি ভুল পথে হাটছো সুমু। প্লিজ মাইন্ড থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও!
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে এবার সুমু বললো,
-আপনার কি মনে হয়, আপনি আমাকে রিজেক্ট করে দিলে আমি এই চেহারা নিয়ে কাল আপনার সামনে যাব? হেরে গিয়েও আমি আপনার সামনে গিয়ে হাসবো? যদি সেটাই ভেবে থাকেন তাহলে আপনিও ভুল পথেই হাটছেন।
আমি অনেকটাই অবাক হলাম ওর এমন উদ্ভট সব কথাবার্তায়। বললাম,
-তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এতে তোমাকে কেউ সাপোর্ট করছে। কে সে?
সুমু,
-ইউ আর গ্রেট! কি চিন্তাশক্তি আপনার! সত্যিই প্রশংসা করতে হয়। ঠিকই ধরেছেন। এতে আমার মায়ের সাপোর্ট রয়েছে। আর এরই মধ্যে মা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে, আপনার সাথে আমার বিয়ে দিবেন। এইযে আপনাকে এখানে শিফট করতে বলা, আমাদের সাথে খাওয়াদাওয়া করতে বলা, এসবই শুধুমাত্র কয়েকদিনের জন্য। তারপর আপনার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। মাঝে, আমি শুধু চাইছিলাম যে আপনার সাথে যেন একটু ভাব জমিয়ে নিতে পারি। যাইহোক, আপনি আগেই সব জেনে ফেলেছেন তাতে ভালোই হলো।
এবার ফোনটা কেটে দিয়ে রেগে গিয়ে একেবারে ফ্লাইটমোড চালু করে দিলাম। সুমুর কথাগুলো শোনার পর যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পেছনের দিকে যেতে লাগলাম আমি। কি কি ঘটেছে আজ বিকাল থেকে আমার সাথে। কার কার কার সাথে কি কি কথা হয়েছে আমার। সুমু, নাতাশা, ওদের মা, খালা ওরা কে কে কি কি কথা বলেছে আমার সাথে সবকিছু ভাবতে লাগলাম আমি। এ যেন কোন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম। তবে, এখানে ধাঁধা থেকেও বেশি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি।
প্রথমত, সুমু আর নাতাশা সমবয়সী। একই কলেজে একই ক্লাসে পড়ে। তবে, ভদ্রমহিলা আমাকে শুধুমাত্র সুমুকেই রেগুলার পড়াতে বললেন কেন? কেন নাতাশা বাইরে পড়বে? তবে কি পড়ানোর বাহানায় দুজুনের মধ্যে লাভের রসায়ন তৈরির ফন্দি করেছিলেন তিনি? আপাতত তো সেটাই মনে হচ্ছে আমার।
দ্বিতীয়ত, নাতাশা ওর স্মৃতিচারণের সময় বলেছিলো ও ছোটবেলা থেকেই সুমুর থেকে মেন্টালি অনেক স্ট্রং। তবে কি সুমুর মানসিক কোন সমস্যা রয়েছে যা কিনা নিজের বোন বলে কৌশলে সেটাকে এড়িয়ে গেছে নাতাশা? এটা আরেকটা পয়েন্ট হতে পারে।
তৃতীয়ত, নাতাশা বলেছিলো ওদের নানা তাঁর সকল প্রপার্টি ওদের মায়ের নামে করে দেয়। উনাকে তো মেরে ফেলা হয়েছিলো। আর ওদের বাবাও তো হার্ট এ্যাটাক করে মারা যায়। আর প্রপার্টি? প্রপার্টি তো নাতাশার মা ওদের দু'বোনের নামে লিখে দিয়েছিলেন। তবে কি এই প্রপার্টি হাতিয়ে নিতেই নতুন কোন নীল নকশা তৈরি করা হয়েছে?
সবকিছুর পেছনেই আমি শুধুমাত্র একজনেরই কারসাজির গন্ধ পাচ্ছিলাম আর তিনি হলেন মা নামের ঐ ভদ্রমহিলা। এবার ভাবতে লাগলাম আমি। কি করব এখন? কি করা যেতে পারে আর এমন পরিস্থিতিতে আমার ঠিক করাটাই বা উচিৎ।
সুমুর মানসিক সমস্যা থাকাটা নিয়ে আমি প্রায় অনেকটাই নিশ্চিত। আর একারণেই ভদ্রমহিলা ওকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় ত্রিশ মিনিট কেটে গেল। এবার ঠিক করলাম আবার ঐ নম্বরে কল দিব। যদি এতক্ষণে সুমু ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ফোনটা নাতাশার রিসিভ করার চান্সটাই বেশি। কেননা, যেসকল মানুষ মেন্টালি উইক হয় ওরা একবার ঘুমে ডুবে গেলে দিনদুনিয়ার আর কোন খবর বলতে পারেনা। ঠিক এর উল্টো চিত্র নাতাশার মতো মেয়েদের ক্ষেত্রেও। শুধু মেয়েদেরই নয় ছেলেদের বেলায়ও এটা লক্ষ্য করা যায়।
স্থির করলাম কল দিব। অবশ্য, যদিও নাতাশার কল রিসিভ করার ক্ষেত্রে চান্সটা বেশি। তবে রিক্স নিলামই। দিলাম কল। রিং হচ্ছে। কে জানে ফোন কোন মোডে রাখা। কেটে দিলো ফোনটা। অবাক হলাম। আর কল দিলামনা। পায়চারি করতে লাগলাম বেলকনিতে।
মিনিট দুয়েক পরে কল আসলো সুমুর নম্বর থেকে। রিসিভ করলাম। তবে বেশ ভালো লাগলো নাতাশার কণ্ঠে সালামটা শুনে। অপরপ্রান্ত থেকে ও বলে উঠলো,
-আসসালামুআলাইকুম।
আমি,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম।
নাতাশা,
-কি ব্যাপার, এত রাতে সুমুকে কল দিলেন যে?
আমি,
-ও কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল দিয়েছিলো। কিছু বিষয় সামনে এসেছে যা থেকে আমি অনেক বিচলিত।
নাতাশা,
-কি হয়েছে?
আমি,
-সুমুকে আমার সাথে আপনার মা বিয়ে দিতে চান। এজন্যই এত আয়োজন। সুমুর কথা শুনে আমি যেটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি তা হলো, উনি খুব সুক্ষ্মভাবেই সব প্ল্যান সাজিয়েছেন। অনেককিছুই আপনার অগোচরে, অজান্তে হচ্ছে অথচ আপনি তা টেরও পাচ্ছেননা।
নাতাশা কিছু বলছেনা। চুপ করে আছে ও। আমি বললাম,
-আপনি কোথায় এখন?
নাতাশা এবার মৃদুস্বরে বললো,
-ছাদে।
আমি বললাম,
-ছাদে মানে? আপনি কি জানতেন যে এটা আমার নম্বর?
নাতাশা,
-হ্যা, জানতাম।
-------চলবে-------
একটি দ্বৈত প্রেমের ইতিকথা পর্ব-০৪
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:54 PM
Rating:

No comments