একটি দ্বৈত প্রেমের ইতি কথা পর্ব-০৫ (অন্তিম পর্ব)
গল্প : একটি দ্বৈত প্রেমের ইতি কথা
পর্ব : ৫ (শেষ পর্ব)
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-জানতেন মানে? আমার নম্বর কোত্থেকে পেলেন আপনি?
নাতাশা,
-মা বিকাশের নম্বর চাওয়াতে তখন না বলেছিলেন মনে নেই আপনার?
ওর কথা শুনে ফোনের স্কিনের দিকে তাকালাম আমি। হ্যা, সিম টু থেকে কল দিয়ে দিয়েছি। এতে আমার বিকাশ একাউন্ট খোলা। বুঝতে পারলাম তখন নাতাশা আমার নম্বর শুনে শুনেই মুখস্থ করে ফেলেছিলো। এমন প্রখর মেধা সবার হয়না। মাত্র একবার শুনে এগারোটি ডিজিট মনে রাখাটাও কোন চাট্টিখানি কথা নয়। তবে, খেয়াল করলাম নাতাশার গলার স্বরটা যেন আগের চাইতে অনেকটা নিচে নেমে গেছে।
এবার আমি বললাম,
-ওহ আচ্ছা। আসলে, আজকাল কিছুই ঐভাবে মনে রাখতে পারিনা আমি। তা আপনার কি মন খারাপ?
ও অনেকটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-আমি একটি অনুরোধ করব আপনাকে রাখবেন?
আমি,
-হ্যা অবশ্যই। বলুন কি বলবেন!
নাতাশা,
-সুমুর বিষয়ে যা যা বলেছেন আপনি তা যদি সত্যি হয় তাহলে ওকে বিয়ে করে নিন আপনি!
আমি এবার রেগে গেলাম ওর কথা শুনে। ধমকের স্বরে বললাম,
-মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি আপনার? কি থেকে কি বলছেন কোন ধারণা আছে কি?
নাতাশা,
-আপনি কি আমার অনুরোধটি রাখতে পারবেন?
আমি,
-আপনি রাখুন তো ফোনটা! যান, ঘুমোন গিয়ে। পরে এসব নিয়ে কথা হবে।
নাতাশা,
-না, আর কখনো এসব নিয়ে কথা হবেনা। আপনি আগে বলুন আমার অনুরোধ রাখবেন কিনা?
আমি,
-আচ্ছা, আপনি ঠিক কি ভেবে আমাকে এমন অনুরোধ করছেন বলুন তো!
নাতাশা,
-বলব?
আমি,
-হ্যা বলুন!
নাতাশা,
-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি সুমুকে নিয়ে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলাম। এবং সেটাও দীর্ঘদিনের জন্য। তখনি ঐ মহিলা আমাকে শেকলে বেঁধে ফেলে।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে ওকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনাকে শেকলে বেঁধে ফেলে মানে?
নাতাশা,
-আমাদের দু'বোনের ক্ষতি করিয়ে দিবেন বলে উনি আমাকে হুমকি দেন। আমি জানতে পেরেছি এক লোকের সাথে উনার সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আমাদের জন্য বিয়ে করতে পারছেনা। আমাদের দুজনকে কোনরকম বিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় করে তারপর সবকিছু দখল করে বসতে চাইছে। মহিলাটি আসলেই খুব চতুর ও ভয়ঙ্কর।
আমি বললাম,
-তা সুমুর সাথে আমাকে বিয়ের জন্য কি করে বললেন আপনি?
নাতাশা,
-উনি যদি জানতে পারেন যে আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন আর উনার হাতের পুতুল সুমু এটার জন্য মনে আঘাত পেয়েছে তাতে উনি আপনারও কোন ক্ষতি করে দিতে পারেন। এমনকি আমারো।
আমি বললাম,
-কিন্ত আমি যদি সুমুকে বিয়ে করি তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হবে?
নাতাশা,
-জানিনা হবে কি হবেনা। তবে আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা। সুমু মনে আঘাত পাক সেটা আমি সহ্য করতে পারবোনা।
আমি বুঝতে পারলাম নাতাশার মাথা ঠিক নেই এখন। মানুষের এমনটি হয়ে থাকে। যখন কেউ খুব বেশি চাপে পড়ে যায় তখন সে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতে থাকে। ফলে, ক্রমশই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার বিপরীতে আরো কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যায় সে। চারদিক থেকে বিপর্যয় নেমে আসে তখন।
ওকে শান্তনা দিয়ে মাথা ঠান্ডা করতে বললাম। বললাম,
-শুনুনু, আপনি প্লিজ এভাবে ভেঙ্গে পড়বেননা। ঐ মহিলা যদি চাল চেলে থাকে তাহলে আমরাও আমাদের মতো চাল চলবো। উনার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে আপনাদের মুখে আমি হাসি ফুটাবো কথা দিলাম। ভরসা করুন আমায়।
নাতাশা কিছু বলছেনা। চুপ করে আছে ও। অনেকটা অধিকার কাটিয়েই এবার ওকে বললাম,
-এখন যান, চুপচাপ গিয়ে ঘুমান! কাল আসলে তখন সরাসরি কথা বলবো এটা নিয়ে।
পরদিন বিকাল পৌনে চারটার দিকে ওদের বাসায় গিয়ে পৌঁছুলাম। চারটা থেকে পড়ানোর কথা। ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি এমন সময় ভদ্রমহিলা আসলেন। কুশল বিনিময় শেষে উনি আমার পাশের সোফায় বসলেন। চেহারা দেখে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিলো উনাকে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনার সাথে কয়েকটি জরুরী কথা বলবো। আপনি কি মানসিকভাবে প্রস্তুত?
যদিও আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো তথাপি সেটা মুচকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে বললাম,
-হ্যা অবশ্যই, বলুন কি বলবেন!
ভদ্রমহিলা,
-সুমুর ফোনে আমি অটো কল রেকর্ড সেট করে রেখেছিলাম। কথাটি প্রথমেই বলে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো আপনি বুদ্ধিমান মানুষ সব যেন বুঝে ফেলতে পারেন কেন এটা প্রথমে বললাম।
বুকটা কেমন যেন আমার কেঁপে উঠলো! নিজেকে সামলে নিলাম। এখানে শুধু উনি আর আমিই বসা। আর কেউ নেই। উনি বলতে লাগলেন,
-আমি এ বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই টের পেয়েছিলাম যদি কোনদিন কেউ আমার লক্ষ্যে পৌঁছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে সেটা হবে নাতাশা। কারণ, নাতাশার বাবাকে আমি প্রপার্টির জন্যই বিয়ে করেছিলাম। আর সুমুর তো মাথায় সমস্যা। ওকে আমি যেভাবে নাচাই সেভাবেই নাচে। দেখুন, আমি চাইলে আরো আগেই ওদের দুজনকে মেরে ফেলতে পারতাম। পারতাম জোড় করে ওদের থেকে সবকিছু আমার নামে লিখিয়ে নিতে। তবে আমি তা করিনি। কিছুটা মায়া দয়া ওদের প্রতি আমার কেন জানিনা জন্মেছিলো। তবে এখন বুঝতে পারছি ওদের বাঁচিয়ে রেখে আমি ভুল করেছিলাম।
উনার কথা যতই শুনছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম আমি। সেইসাথে মেজাজও বিগড়ে যাচ্ছিলো আমার।
উনি বলেই যাচ্ছেন,
-ভেবেছিলাম আপনার সাথে সুমুর বিয়ে দিয়ে ওর অংশের প্রপার্টি আমি লিখিয়ে নিব।
আমি উনাকে থামিয়ে দিয়ে এবার বললাম,
-আর নাতাশার কি করতেন?
ভদ্রমহিলা আমার কথা শুনে অট্টহাসি দিলেন এবার। আমার জিজ্ঞাসাকে যেন উনি তাচ্ছিল্যই করলেন এই হাসি দিয়ে। তারপর বললেন,
-আপনার কি মনে হয় কল রেকড়র্ডিং শোনার পরও ওকে আমি এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি? এতটা বোকা আমি? ওকে তো আজ দুপুরেই আমার লোক দিয়ে শেষ করে দিয়েছি হা হা হা হা হা.....
আমি বসা থেকে এবার এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাথায় রক্ত চড়ে গেল কথাগুলো শুনে। উনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাজপাখির মতো এবার উনার শাড়ীর আঁচল ঝাপটে ধরে মুহুর্তেই উনার মুখ পেঁচিয়ে ফেললাম। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে। প্রাণের মায়া কার না থাকে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমার সাথে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ঐ মহিলা। কিন্ত শেষ রক্ষা পায়নি। নিজ শাড়ীর আঁচলেই গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে উনাকে মেরে ফেলি আমি। সেই সাথে শেষ করে দিই সকল চক্রান্ত। বদলা নিই নাতাশাকে মেরে ফেলার!
মেরে ফেলার পর হুঁশ ফিরলো কি করলাম আমি এটা! এখন কি হবে? থানা-পুলিশ এসব কে সামলাবে? আর এই লাশটাকে কি করবো? ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে এবার গোটা বাড়িতে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম ওদেরকে। এত ধস্তাধস্তি হলো অথচ কারোর কোন সাড়াশব্দই পেলামনা! বিষয়টা অবাক করলো আমায়। তবে, ভদ্রমহিলা যখন বলেছিলো নাতাশাকে উনি আর বাঁচিয়ে রাখেননি তখন আমার মাথায় খুন চেপে বসে। তাৎক্ষণিক আমার কি হয়ে যায় নিজেও টের পাইনি। তবে এখন ভাবতে লাগলাম, নাতাশাকে মেরে ফেলে থাকলে ওর লাশ কোথায়? সুমু আর ঐ খালাই বা কোথায়?
বাড়ির প্রত্যেকটি রুম তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম আমি। কোথাও কাউকে পেলামনা। ভাবতে লাগলাম, কোথায় থাকতে পারে ওরা? হ্যা, ছাদে থাকতে পারে। দৌড়ে এবার ছাদে গেলাম। ছাদের এককোণে কাচুমাচু খেয়ে বসে আছে সুমু। ওর গায়ে ওড়না নেই। চুলগুলো এলোমেলো। ওর উপরও কি অত্যাচার হয়েছে তাহলে? কাছে গেলাম আমি। আমার উপস্থিতি টের পেয়েই ও লাফিয়ে উঠলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
-ঐ দাঁড়া ঐখানে! একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবিনা। আমার বোনকে তোরা মেরে ফেলেছিস। ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস। এবার যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করিস আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিব। একদম কাছে আসবিনা!
সুমুর এই অবস্থা দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, নাতাশাকে না হয় ওরা মেরেই ফেলেছে আর ওকে, ওকে তো বাঁচিয়ে রেখেও মেরে ফেলে রেখে গেছে। সুমুকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কে জানে, হয়ত নাতাশাকে ওরা ওর সামনেই মেরেছে। তাই ও এভাবে শক খেয়েছে আর এখন আবোলতাবোল বকছে।
লক্ষ্য করলাম ও বারবার পানির ট্যাংকিগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলো। ওদের ছাদে দুটো পানির ট্যাংক। ও ঐদিকে তাকাচ্ছিলো আর প্রচন্ডরকম ভয় পাচ্ছিলো। মনে ধাক্কা লাগলো আমার। তবে কি ওরা নাতাশাকে!
দৌড়ে গেলাম ঐ ট্যাংকিগুলোর কাছে। একটির ঢাকনা সরিয়ে ভেতরে দেখলাম। নাহ, নেই কিছু এতে। পাশেরটা খুললাম। খুলতেই চোখে ভেসে উঠলো নাতাশার ক্ষতবিক্ষত দেহটা! খুব নির্মমভাবে ওকে মেরেছে ওরা। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম এবার।
বসে বসে কাঁদছি আমি এমন সময় পেছন থেকে কে যেন এসে ঝাপটে ধরলো। আঁতকে উঠলাম আমি। নাহ, আর কেউ নয়। সুমু এটা। আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ও এবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। কিছুতেই কান্না থামছেনা ওর। নিজেকে এবার কিছুটা সামলে নিলাম। ওকে বললাম,
-সুমু, তাকাও আমার দিকে। কথা বলো আমার সাথে। বলো ঠিক কি হয়েছিলো?
সুমু এবার কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
-'আমি জানিনা কিছু। আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম দুপুরে। হঠাৎ করেই একটা বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। রুম থেকে বেরিয়ে দেখি দুজন লোক নাতাশাকে জোর করে ছাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চিৎকার দিই তখন। মাকে ডাকি। আর তখনি মা আমাকে এসে মারধর করতে শুরু করেন। আটকে রাখেন নিচে। আমি আমার বোনটাকে বাঁচাতে পারিনি। ওরা মেরে ফেলেছে আমার বোনটাকে। ওদের কি ক্ষতি করেছিলো আমার বোন। আমি ঐ মহিলাকে ছাড়বোনা। মেরে ফেলবো তাকে। আমি ওদের সবাইকে মেরে ফেলবো।'
কথাগুলো বলে ও আরো জোরে কাঁদতে লাগলো এবার। আমাকে জড়িয়ে ধরে সুমুকে এভাবে কাঁদতে দেখে শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুমুকে নিয়ে আমাকে বলা নাতাশার সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সমবয়সী হওয়া সত্বেও সুমুকে নাতাশা গোসল করিয়ে দিতো, খাইয়ে দিতো, ঘুম পারিয়ে দিতো। আজ সে পৃথিবীতে বেঁচে নেই।
বোনের বিয়োগ ব্যথায় আহত সুমু আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মনে হচ্ছিলো, এটাই যেন ওর শেষ আর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। ক্ষণিকের ভালো লাগায় আমাকে নিয়ে নাতাশার বুনে ফেলা স্বপ্নগুলো যেন অদৃশ্য থেকে আকুতি জানাচ্ছে, 'সুমুকে আপনার বুকে জায়গা দিন! আমার আদরের অবুঝ বোনটা যদি আপনার বুকে সুখে থাকে তবে যে আমি এপারে থেকেও ভালো থাকবো।'
------সমাপ্ত-------
একটি দ্বৈত প্রেমের ইতি কথা পর্ব-০৫ (অন্তিম পর্ব)
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:55 PM
Rating:

No comments