বউনামা! পর্ব-০১
(১)
বিয়ের প্রথম দিনেই বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বসে আছি। ঝগড়া হয়েছে খুবই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। মাঝরাতে ফুলের গন্ধে বমি করে দিয়েছি বিছানায়। পরে রাতে দৌড়াদৌড়ি করে বিছানা পরিষ্কার করে রুমের মধ্যেই শুকোতে দিয়েছি পাছে সবার হাসির পাত্র হতে হয়। -এত যদি সমস্যা হয়, ফুল না লাগাতে বলতে পারতে।
-এই কথাটা আমি তোমাকে এ নিয়ে পঞ্চাশ বার বলেছি। আমি ওদের কে নিষেধ করেছিলাম ফুল দিয়ে সাজাতে।
-ফুল দিয়ে না সাজালে বাসর ঘর হয়?
এই হচ্ছে মেয়েদের স্বভাব। একই মুখে দুই কথা বলবে।
-আরে, তুমি মানুষ না কয়েন? মূহুর্তেই উলটে গেলে। একটু আগেই বলছিলে ফুল না লাগাতে বলতে পারলে না, আর এখন বলছ ফুল না লাগালে বাসর ঘর হয়! যেকোন একটা বল।
-ফাইন! কিছুই বলবনা আমি। বাই।
বলেই আমাকে মেসেজ ব্লক দিয়ে বউ চলে গেল। মেসেজ ব্লক অর্থাৎ কথা বন্ধ। আমিও আনব্লক করার জন্য হাউমাউ করে কাঁদার মত ছেলে না। এদিকে আজ বৌভাত অর্থাৎ মেয়েপক্ষ আসবে আজ। বাইরে খুব আয়োজন চলছে, সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে আদৌ কি কাজ করছে বুঝতে পারছি না। আমি বের হতেই মা আমাকে এসে চেপে ধরলেন, “বউয়ের সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি?”
-সে আমাকে মেসেজ ব্লক দিয়েছে। আই মিন, কথা বলছে না।
-এ কেমন ধরণের কথা! বিয়ের দিনে এই অবস্থা?
-জ্বি।
-কেন? কি ব্যাপার? কি হয়েছে?
-আমি কাল রাতে বিছানায় বমি করে দিয়েছি ফুলের গন্ধে।
শুনেই মা মুখ টা বিশ্রি একটা ভঙ্গি করলেন, সেই ভঙ্গি স্পষ্ট বলছে, “ইয়াক!”
-দেখ, এ ধরণের কাজকর্ম করলে যে কেউই একটু রাগ হবে, তাও আবার নতুন বউ।
-আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। আমি আগেই বলেছি ফুলের গন্ধে বমি আসে।
-ঠিকাছে যা হওয়ার হয়েছে। এখন গিয়ে মান ভাঙিয়ে নিবি। আজ তোর শ্বশুর পক্ষের লোকজন আসবে, এসব শুনলে কি হবে ভেবেছিস?
-কোনটা শুনলে? আমরা কথা বলছি না এটা নাকি আমি বমি করেছি এটা?
মা আমার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। এরপর চলে গেলেন অন্য রুমে, অনেক মেহমান আছে ঘরে, আমার প্যাঁচাল শোনার থেকেও তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এমন একটা ভাব নিলেন। আমিও হাতে ব্রাশ নিয়ে বেসিনে চলে গেলাম।
(২)
ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে আছি। একটু পর রেডি হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাবে বেরুব, খাওয়াদাওয়ার ওখানে অনেক দায়িত্ব আছে। সবসময় দেখেছি জামাইকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হয়। আমি বসে আছি বউয়ের জন্য। এদিকে সে যে গেছে আর ফিরে আসছে না। বোধহয় পণ করেছে আর রুমে ফিরবে না। অনেকক্ষণ রুমে অপেক্ষা করার পর আমি রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরুলাম।
সবাই আমার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকাতে লাগলো। আমিও তাদের কে ফিডব্যাক দিতে লাগলাম। এদিকে আত্মীয়স্বজন আর এলাকার লোকদের খাওয়ানো চলছে। আমি গিয়ে সেখানে দাঁড়ালাম, কি করতে হবে বুঝে উঠতে না পেরে প্যান্ডেলের দরজায় গার্ডের মত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা তখন পরম আদরে এক মুরুব্বী কে গরুর মাংস উঠিয়ে দিচ্ছেন। আমার ইচ্ছে করছিল বাবাকে বলি এই লোকের এত গরুর মাংস খেলে যে কি দশা হবে সে দায় নিবেন নাকি আপনি? কোলেস্টেরল, হার্ট ব্লক, হাই প্রেশার আরো কত কি। মা বেশ ভাল জানেন। আমাদের পরিবারের তাৎক্ষণিক চিকিৎসক। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান একজন ডাক্তারের চেয়ে কম নয়। পরিবারে কারো অসুখ হলে শুধুমাত্র বলার অপেক্ষা, বিদ্যুৎগতিতে মা ঔষধ নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন। এ নিয়ে ঘরে প্রচুর হাসাহাসি হয়। মাঝখানে আমরা এ সিদ্ধান্তেও চলে গিয়েছিলাম যে মা কে পুনরায় পড়াশুনা করিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দেব, কিন্তু মা খুব রেগে গেছিলেন, তাই সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
যাহোক, বাবার খাতিরযত্ন দেখে আমিও এগিয়ে গেলাম। আমি গিয়ে এক জোয়ান কে গরুর মাংস একেবারে একটা বড় চামুচে নিয়ে তার প্লেটে ঢেলে দিলাম, ভাবলাম এ জোয়ান মানুষ, গরুর মাংস খেতে পারবে। পরে জানলাম সে হার্টের রোগী, শুনেই আস্তে করে কেটে পড়লাম। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে প্রায়, কনেপক্ষের লোকজন অনেকেই এসে পড়েছে। এই বৈঠকেই তাদের খাওয়ানো হবে। কিছুক্ষণ পর শ্বশুর তার দুই জামাই কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছালেন। তাদের দেখেই আমি সানন্দে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর বেশ হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগুচ্ছেন, আমিও এগিয়ে গিয়ে কোলাকুলি করলাম। গতবারের কোলাকুলির স্মৃতি স্মরণ করে এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দুবার কোলাকুলি করেই সরে এলাম। শ্বশুর কিছুটা বিভ্রান্ত হলেন। আমি তাড়াতাড়ি ভায়রা দের সাথে কোলাকুলি তে লেগে গেলাম। সবাইকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। এর মধ্যে বাবাও এগিয়ে এলেন, আর আমি বাবার উপস্থিতিতে কেটে পড়লাম। ওদিকে কি চলছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই এবার বাইরের জগতকে ইস্তফা দিয়ে ভেতরের দিকে গেলাম।
নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে প্রচুর লোকজনের আভাস পেলাম, ভেতরে ভীষণ রকম হিহি হিহি চলছে। অর্থাৎ প্রচুর মেয়ে একত্রিত হয়েছে। আমি ভীত হয়ে পড়লাম, বিছানাটা ওভাবেই মশারির স্ট্যান্ডের উপর রাখা, মানুষ দেখে কি বলছে কে জানে, নাকি ওসব নিয়েই হাসাহাসি করছে। মানুষের মনস্তাত্বিক একটা সমস্যা হচ্ছে মানুষ সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়। স্কুলে কয়েকটা মেয়ে একসাথ হয়ে হাসাহাসি করতে থাকলে মনে হত এরা আমাকে নিয়েই হাসছে, এটা মানুষের কমন সাইকোলজি। আমাকে উঁকিঝুকি মারতে বউ ধরে ফেলল।
-কি করছ তুমি?
-তুমি এখানে? ভেতরে নেই? তোমাকে খুঁজছিলাম।
এই কথা শুনে নীরার মুখে কেমন একটা এক্সপ্রেশন এল, ওটার নাম জানিনা। বোধহয় কিছুটা স্বস্তি বোধ করার এক্সপ্রেশন।
-ওখানে কারা তাহলে?
-আমার বোনেরা।
-ওরাও এসেছে?
-আসবেনা? আজ বৌভাত না?
-বিছানা টা যে ওভাবেই পড়ে আছে!
-আমি কেঁচে দিয়েছি।
-তুমি? আজ বিয়ের প্রথম দিন? প্রথম দিনেই বিছানা কেঁচেছো? তাও বমি করা বিছানা।
বলতে আমার নিজেরই কেমন বমি বমি ভাব হল।
-খবরদার! একদম মনে করাবে না, অনেক কষ্টে কেঁচেছি।
হঠাৎ বউয়ের উপর কেমন মায়া হল। ভাবাবেগে চুমু দিয়ে বসলাম কপালে। সাথে সাথে হাত থেকে কিছু পড়ার শব্দে তাকিয়ে দেখি ফুপি দৌড়ে অন্যরুমের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। বউ আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল, এরপর চুপি চুপি রুমে ঢুকে গেল। আর এদিকে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে থেকে আমার ডাক পড়ল। আবারো বোধহয় কাউকে এক চামচ মাংস ঢেলে দিয়ে আসতে হবে।
(৩)
বৌভাতে কনে পক্ষের স্পেশাল মানুষজনের জন্য স্পেশাল টেবিল থাকে। সেই স্পেশাল টেবিলের দায়িত্বে আমি রইলাম। যদিও তাঁরা আমাকে জোরাজুড়ি করে বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসতে পারলাম না। অবশেষে ঐ টেবিলের মেহমানদারীর দায়িত্ব নিলাম। কিন্তু মেহমানদারীর আগামাথা কিছুই না জানা আমি টেবিল বয়দের মত আচরণে লেগে গেলাম। সবাই ভাত নিয়ে বসে আছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু লাগবে?” বাবা বোধহয় আবারো মাথা ঘুরে পড়ে যেতেন, কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মাথা ঘুরে পড়লে পরিস্থিতি যে আরো ঘোলাটে হবে তা ভেবেই বোধহয় পড়লেন না। যাহোক, মেহমানদারীতে ব্যর্থ হয়ে আমি ওদিক থেকে সরে পড়লাম, বাকিটা বাবা আর চাচারাই সামলালো।
আর এদিকে আমি ভেবে কূল পাচ্ছিনা ফুপি যেটা দেখেছে সেটা তিনগ্রাম অবধি পৌঁছেছে কিনা। সবার খাওয়া শেষ হলে আমাদের ঘরে বসলেন সবাই। বিশেষ নাস্তা দেয়া হল, নানান রকমের পিঠা, চা-বিস্কিট, ফল আরো কি কি জানি। আমি একটা জিনিস ভেবে পাইনা। সদ্য ভাত খাওয়া মানুষগুলো কি করে এই নাস্তা গুলো খাবে? কিন্তু একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার নাকি এটা, মায়ের মতামত। আমি চুপচাপ সোফায় বসে রইলাম। সবাই বিভিন্ন ধরণের কথা বলছে। এর মধ্যে নীরাকে ডাকা হল। নীরা এসে সবাইকে সালাম করল, আর এসে বসল তার বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুরের পাশে। তিনি বোধহয় চাইছিলেন আমার পাশে এসে বসুক। আমাদের কে কেমন মানিয়েছে সেটা বোধহয় মিলিয়ে দেখতে চাইছিলেন। কারণ আমার স্বাস্থ্য নিয়ে যে কারো একটু আধটু সন্দেহ থাকেই, সেদিন শেরওয়ানী তে পুষ্ট দেখানোয় তুলনা টা ভাল জমে নি। নীরা কে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কথা চলছিল, আমি মনে মনে বলছিলাম, নিয়ে যান না, আজ রাতটা ফ্যানের নিচে ঘুমাই।
ভেবেছিলাম আমাদের পক্ষ থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা হবে, না আজ না কাল যাবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি হল খুবই হাল্কা ধরণের বাবার পক্ষ থেকে, আর নীরার ও প্রচণ্ড ইচ্ছা দেখে সিদ্ধান্ত হল ও বাড়িতে যাওয়ার। হঠাৎ মাকে আমার ব্যাগ গুছাতে দেখে মনে পড়ল, “এইরে! আমাকেও তো যেতে হবে ও বাড়ি!” তাড়াহুড়ো করে রুমে গেলাম, নীরাকে দেখলাম ওর জামাকাপড় গুছাচ্ছে।
-নীরা!
-কাল আরেকটা বিছানা ধুতে পারবে?
-কেন?
-তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি, সেটাও তো ফুল দিয়ে সাজাবে বোধহয়।
নীরা আমার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শেষে আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার আমার মা থেকে প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করে একটা অমিডন ট্যাবলেট খেয়ে শ্বশুর বাড়ি ভ্রমনে চললাম।
(চলবে….)
মুল লিখক আসিফ মাহমুদ ভাই
বিয়ের প্রথম দিনেই বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বসে আছি। ঝগড়া হয়েছে খুবই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। মাঝরাতে ফুলের গন্ধে বমি করে দিয়েছি বিছানায়। পরে রাতে দৌড়াদৌড়ি করে বিছানা পরিষ্কার করে রুমের মধ্যেই শুকোতে দিয়েছি পাছে সবার হাসির পাত্র হতে হয়। -এত যদি সমস্যা হয়, ফুল না লাগাতে বলতে পারতে।
-এই কথাটা আমি তোমাকে এ নিয়ে পঞ্চাশ বার বলেছি। আমি ওদের কে নিষেধ করেছিলাম ফুল দিয়ে সাজাতে।
-ফুল দিয়ে না সাজালে বাসর ঘর হয়?
এই হচ্ছে মেয়েদের স্বভাব। একই মুখে দুই কথা বলবে।
-আরে, তুমি মানুষ না কয়েন? মূহুর্তেই উলটে গেলে। একটু আগেই বলছিলে ফুল না লাগাতে বলতে পারলে না, আর এখন বলছ ফুল না লাগালে বাসর ঘর হয়! যেকোন একটা বল।
-ফাইন! কিছুই বলবনা আমি। বাই।
বলেই আমাকে মেসেজ ব্লক দিয়ে বউ চলে গেল। মেসেজ ব্লক অর্থাৎ কথা বন্ধ। আমিও আনব্লক করার জন্য হাউমাউ করে কাঁদার মত ছেলে না। এদিকে আজ বৌভাত অর্থাৎ মেয়েপক্ষ আসবে আজ। বাইরে খুব আয়োজন চলছে, সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে আদৌ কি কাজ করছে বুঝতে পারছি না। আমি বের হতেই মা আমাকে এসে চেপে ধরলেন, “বউয়ের সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি?”
-সে আমাকে মেসেজ ব্লক দিয়েছে। আই মিন, কথা বলছে না।
-এ কেমন ধরণের কথা! বিয়ের দিনে এই অবস্থা?
-জ্বি।
-কেন? কি ব্যাপার? কি হয়েছে?
-আমি কাল রাতে বিছানায় বমি করে দিয়েছি ফুলের গন্ধে।
শুনেই মা মুখ টা বিশ্রি একটা ভঙ্গি করলেন, সেই ভঙ্গি স্পষ্ট বলছে, “ইয়াক!”
-দেখ, এ ধরণের কাজকর্ম করলে যে কেউই একটু রাগ হবে, তাও আবার নতুন বউ।
-আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। আমি আগেই বলেছি ফুলের গন্ধে বমি আসে।
-ঠিকাছে যা হওয়ার হয়েছে। এখন গিয়ে মান ভাঙিয়ে নিবি। আজ তোর শ্বশুর পক্ষের লোকজন আসবে, এসব শুনলে কি হবে ভেবেছিস?
-কোনটা শুনলে? আমরা কথা বলছি না এটা নাকি আমি বমি করেছি এটা?
মা আমার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। এরপর চলে গেলেন অন্য রুমে, অনেক মেহমান আছে ঘরে, আমার প্যাঁচাল শোনার থেকেও তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এমন একটা ভাব নিলেন। আমিও হাতে ব্রাশ নিয়ে বেসিনে চলে গেলাম।
(২)
ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে আছি। একটু পর রেডি হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাবে বেরুব, খাওয়াদাওয়ার ওখানে অনেক দায়িত্ব আছে। সবসময় দেখেছি জামাইকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হয়। আমি বসে আছি বউয়ের জন্য। এদিকে সে যে গেছে আর ফিরে আসছে না। বোধহয় পণ করেছে আর রুমে ফিরবে না। অনেকক্ষণ রুমে অপেক্ষা করার পর আমি রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরুলাম।
সবাই আমার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকাতে লাগলো। আমিও তাদের কে ফিডব্যাক দিতে লাগলাম। এদিকে আত্মীয়স্বজন আর এলাকার লোকদের খাওয়ানো চলছে। আমি গিয়ে সেখানে দাঁড়ালাম, কি করতে হবে বুঝে উঠতে না পেরে প্যান্ডেলের দরজায় গার্ডের মত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা তখন পরম আদরে এক মুরুব্বী কে গরুর মাংস উঠিয়ে দিচ্ছেন। আমার ইচ্ছে করছিল বাবাকে বলি এই লোকের এত গরুর মাংস খেলে যে কি দশা হবে সে দায় নিবেন নাকি আপনি? কোলেস্টেরল, হার্ট ব্লক, হাই প্রেশার আরো কত কি। মা বেশ ভাল জানেন। আমাদের পরিবারের তাৎক্ষণিক চিকিৎসক। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান একজন ডাক্তারের চেয়ে কম নয়। পরিবারে কারো অসুখ হলে শুধুমাত্র বলার অপেক্ষা, বিদ্যুৎগতিতে মা ঔষধ নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন। এ নিয়ে ঘরে প্রচুর হাসাহাসি হয়। মাঝখানে আমরা এ সিদ্ধান্তেও চলে গিয়েছিলাম যে মা কে পুনরায় পড়াশুনা করিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দেব, কিন্তু মা খুব রেগে গেছিলেন, তাই সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
যাহোক, বাবার খাতিরযত্ন দেখে আমিও এগিয়ে গেলাম। আমি গিয়ে এক জোয়ান কে গরুর মাংস একেবারে একটা বড় চামুচে নিয়ে তার প্লেটে ঢেলে দিলাম, ভাবলাম এ জোয়ান মানুষ, গরুর মাংস খেতে পারবে। পরে জানলাম সে হার্টের রোগী, শুনেই আস্তে করে কেটে পড়লাম। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে প্রায়, কনেপক্ষের লোকজন অনেকেই এসে পড়েছে। এই বৈঠকেই তাদের খাওয়ানো হবে। কিছুক্ষণ পর শ্বশুর তার দুই জামাই কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছালেন। তাদের দেখেই আমি সানন্দে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর বেশ হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগুচ্ছেন, আমিও এগিয়ে গিয়ে কোলাকুলি করলাম। গতবারের কোলাকুলির স্মৃতি স্মরণ করে এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দুবার কোলাকুলি করেই সরে এলাম। শ্বশুর কিছুটা বিভ্রান্ত হলেন। আমি তাড়াতাড়ি ভায়রা দের সাথে কোলাকুলি তে লেগে গেলাম। সবাইকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। এর মধ্যে বাবাও এগিয়ে এলেন, আর আমি বাবার উপস্থিতিতে কেটে পড়লাম। ওদিকে কি চলছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই এবার বাইরের জগতকে ইস্তফা দিয়ে ভেতরের দিকে গেলাম।
নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে প্রচুর লোকজনের আভাস পেলাম, ভেতরে ভীষণ রকম হিহি হিহি চলছে। অর্থাৎ প্রচুর মেয়ে একত্রিত হয়েছে। আমি ভীত হয়ে পড়লাম, বিছানাটা ওভাবেই মশারির স্ট্যান্ডের উপর রাখা, মানুষ দেখে কি বলছে কে জানে, নাকি ওসব নিয়েই হাসাহাসি করছে। মানুষের মনস্তাত্বিক একটা সমস্যা হচ্ছে মানুষ সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়। স্কুলে কয়েকটা মেয়ে একসাথ হয়ে হাসাহাসি করতে থাকলে মনে হত এরা আমাকে নিয়েই হাসছে, এটা মানুষের কমন সাইকোলজি। আমাকে উঁকিঝুকি মারতে বউ ধরে ফেলল।
-কি করছ তুমি?
-তুমি এখানে? ভেতরে নেই? তোমাকে খুঁজছিলাম।
এই কথা শুনে নীরার মুখে কেমন একটা এক্সপ্রেশন এল, ওটার নাম জানিনা। বোধহয় কিছুটা স্বস্তি বোধ করার এক্সপ্রেশন।
-ওখানে কারা তাহলে?
-আমার বোনেরা।
-ওরাও এসেছে?
-আসবেনা? আজ বৌভাত না?
-বিছানা টা যে ওভাবেই পড়ে আছে!
-আমি কেঁচে দিয়েছি।
-তুমি? আজ বিয়ের প্রথম দিন? প্রথম দিনেই বিছানা কেঁচেছো? তাও বমি করা বিছানা।
বলতে আমার নিজেরই কেমন বমি বমি ভাব হল।
-খবরদার! একদম মনে করাবে না, অনেক কষ্টে কেঁচেছি।
হঠাৎ বউয়ের উপর কেমন মায়া হল। ভাবাবেগে চুমু দিয়ে বসলাম কপালে। সাথে সাথে হাত থেকে কিছু পড়ার শব্দে তাকিয়ে দেখি ফুপি দৌড়ে অন্যরুমের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। বউ আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল, এরপর চুপি চুপি রুমে ঢুকে গেল। আর এদিকে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে থেকে আমার ডাক পড়ল। আবারো বোধহয় কাউকে এক চামচ মাংস ঢেলে দিয়ে আসতে হবে।
(৩)
বৌভাতে কনে পক্ষের স্পেশাল মানুষজনের জন্য স্পেশাল টেবিল থাকে। সেই স্পেশাল টেবিলের দায়িত্বে আমি রইলাম। যদিও তাঁরা আমাকে জোরাজুড়ি করে বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসতে পারলাম না। অবশেষে ঐ টেবিলের মেহমানদারীর দায়িত্ব নিলাম। কিন্তু মেহমানদারীর আগামাথা কিছুই না জানা আমি টেবিল বয়দের মত আচরণে লেগে গেলাম। সবাই ভাত নিয়ে বসে আছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু লাগবে?” বাবা বোধহয় আবারো মাথা ঘুরে পড়ে যেতেন, কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মাথা ঘুরে পড়লে পরিস্থিতি যে আরো ঘোলাটে হবে তা ভেবেই বোধহয় পড়লেন না। যাহোক, মেহমানদারীতে ব্যর্থ হয়ে আমি ওদিক থেকে সরে পড়লাম, বাকিটা বাবা আর চাচারাই সামলালো।
আর এদিকে আমি ভেবে কূল পাচ্ছিনা ফুপি যেটা দেখেছে সেটা তিনগ্রাম অবধি পৌঁছেছে কিনা। সবার খাওয়া শেষ হলে আমাদের ঘরে বসলেন সবাই। বিশেষ নাস্তা দেয়া হল, নানান রকমের পিঠা, চা-বিস্কিট, ফল আরো কি কি জানি। আমি একটা জিনিস ভেবে পাইনা। সদ্য ভাত খাওয়া মানুষগুলো কি করে এই নাস্তা গুলো খাবে? কিন্তু একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার নাকি এটা, মায়ের মতামত। আমি চুপচাপ সোফায় বসে রইলাম। সবাই বিভিন্ন ধরণের কথা বলছে। এর মধ্যে নীরাকে ডাকা হল। নীরা এসে সবাইকে সালাম করল, আর এসে বসল তার বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুরের পাশে। তিনি বোধহয় চাইছিলেন আমার পাশে এসে বসুক। আমাদের কে কেমন মানিয়েছে সেটা বোধহয় মিলিয়ে দেখতে চাইছিলেন। কারণ আমার স্বাস্থ্য নিয়ে যে কারো একটু আধটু সন্দেহ থাকেই, সেদিন শেরওয়ানী তে পুষ্ট দেখানোয় তুলনা টা ভাল জমে নি। নীরা কে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কথা চলছিল, আমি মনে মনে বলছিলাম, নিয়ে যান না, আজ রাতটা ফ্যানের নিচে ঘুমাই।
ভেবেছিলাম আমাদের পক্ষ থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা হবে, না আজ না কাল যাবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি হল খুবই হাল্কা ধরণের বাবার পক্ষ থেকে, আর নীরার ও প্রচণ্ড ইচ্ছা দেখে সিদ্ধান্ত হল ও বাড়িতে যাওয়ার। হঠাৎ মাকে আমার ব্যাগ গুছাতে দেখে মনে পড়ল, “এইরে! আমাকেও তো যেতে হবে ও বাড়ি!” তাড়াহুড়ো করে রুমে গেলাম, নীরাকে দেখলাম ওর জামাকাপড় গুছাচ্ছে।
-নীরা!
-কাল আরেকটা বিছানা ধুতে পারবে?
-কেন?
-তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি, সেটাও তো ফুল দিয়ে সাজাবে বোধহয়।
নীরা আমার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শেষে আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার আমার মা থেকে প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করে একটা অমিডন ট্যাবলেট খেয়ে শ্বশুর বাড়ি ভ্রমনে চললাম।
(চলবে….)
মুল লিখক আসিফ মাহমুদ ভাই
বউনামা! পর্ব-০১
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
4:55 PM
Rating:

No comments