ভুল ভালোবাসা! শেষ পর্ব।
মা বাবা ভাই বোন দের আদর ভালবাসার মুহূর্ত গুলো অধরা চোখ বন্ধ করে মনে করে কিছু ক্ষণ।
আর তারপর একটা চেয়ার নিয়ে ওর গায়ের উড়নাটা ফ্যানের সাথে বেধে নেয়।
২০ বছর পর।
-কোথায় তোরা স্নেহা?রাত হয়ে গেছে এখনো তোদের খবর নেই।
চিন্তা হয়না বুঝি আমার?
-এত চিন্তা করতে হবেনা লক্ষী মা আমার।
আমি আর বাবা ক্লিনিকে আছি।
-ক্লিনিকে?কি হয়েছে তোর?তোর বাবার কিছু হয়েছে?আমাকে জানাস নি কেন?কার কি হয়েছে?
-আরে মা থামো তো।আমাদের কারো কিছু হয়নি।
-তাহলে তোরা ক্লিনিকে কেন?
-আর বলোনা,আমি আর বাবা শপিং করে বাসায় ফিরছিলাম আর হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে কে যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে।
বাবা আর আমি রিক্সা থেকে নেমে কাছে যেতেই দেখি একটা মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
তাড়াতাড়ি করে আমরা ওকে ক্লিনিকে নিয়ে আসি।
ডাক্তার বললেন কে যেন ওকে ধর্ষণ করে ফেলে ফেলে রেখে গেছে।
প্রচন্ড রক্ত ক্ষরণ হয়েছে।রক্ত লাগবে।
অদ্ভুত ভাবে ওর রক্তের গ্রুপ আর আমার রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় আমি ওকে রক্ত দিলাম।
-এখন কেমন আছে মেয়েটা?
-এখন একটু ভালো আছে মা।
জানোনা কি সুন্দর মেয়েটা।কে যে এমন করলো।
অধরার বুক টা কেঁপে উঠলো।২০ বছর আগে ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো।
-ও মা।
-হ্যাঁ হ্যাঁ,শোন মেয়েটা স্বাভাবিক হলে ওর কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ওর বাসায় একটা ফোন দিস।
বাবা মা না জানি কত চিন্তা করছে।
না জানি কার বুকের সোনা মানিকের আজ এই অবস্থা।
-আচ্ছা মা।
আর তুমি চিন্তা করোনা।ওর বাসার লোক জন এলেই আমরা চলে আসবো।
ওকে তো আর একা ফেলে যেতে পারিনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে।এখন তোর বাবাকে দে।
-এই নাও বাবা,মা।
-হ্যালো!
-সব অসহায় মেয়ে গুলো আপনার সামনেই পড়ে।কেন পড়ে জানেন?
-উঁহু।জানিনাতো।
-কারণ আপনি খুব ভালো মানুষ।আপনি ওদের সাহায্য করবেন বলে।
যেমন টা আমাকে করেছিলেন।
-আহ্ আবার সেই কথা?আমি তোমাকে সাহায্য করিনি।আমি তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি।বুঝলে?
-হ্যাঁ বুঝলাম।তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।
-আচ্ছা।রাখছি।
-জ্বী,আল্লাহ্ হাফেজ।
ডাক্তার বলেন মেয়েটা এখন একটু ভালো আছে।তবে শারীরিক আর মানষিক আঘাতের কারণে কথা কোব কথা বলতে পারছেনা।
তাই ওদের বাসায় জানানো যায়নি।
স্নেহা আর ওর বাবা,
মানে অধরার মেয়ে এবং স্বামী দুজনই রাতে ক্লিনিকে থেকে যায়।
সকাল হতেই অধরা ক্লিনিকে পৌছে।
মেয়েটার জন্য আর স্নেহা আর স্নেহার বাবার জন্য নাস্তা নিয়ে।
রিসিভশনে জিজ্ঞেস করে কেবিনের সামনে যেতেই অধরার হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটা পড়ে যায়।
-মা এসে গেছো।
অধরার চোখ পড়ে আবিরের উপর।
-মা,ইনি হচ্ছেন মেয়েটার বাবা,আর ইনি হচ্ছেন মেয়েটার মা।
আর ইনি হচ্ছেন আমার মা।
বললাম না,আমার মা ই বলেছেন সব সময় বিপদগ্রস্ত মানুষ কে সাহায্য করবে।
ঠিক তোমার বাবা যেমন করেন।
আমিও তাই আমার মায়ের কথা শুনে বাবাকে ফলো করি।
আপনি কোন চিন্তা করবেন না আংকেল।
আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে।
আর ওই জানোয়ারের বিচার হবে।
-কি হলো অধরা?খারাপ লাগছে?(অধরার স্বামী)
-না ঠিক আছি আমি।
আসছি আমি একটু।
থাকো তোমরা।
অধরা কেবিনের বাইরে চলে যায়।
-আমাকে সেদিন অভিশাপ দিয়েছিলে তাইনা?
অধরা পেছনে ঘুরে দেখে আবির।
-অভিশাপ?আমি?আমি কাউকে অভিশাপ দেইনি।
-২০ বছর আগে যেই সর্বনাশ আমি তোমার করেছি।২০ বছর পর আজ আমার মেয়ে সেই সর্বনাশের স্বীকার।
আমাকে মাফ করে দিও অধরা।আমি সেদিন ভুল করেছিলাম।যেই ভুলের শাস্তি আজ আমার মেয়েকে পেতে হলো।
-আসলে কি জানো আবির?সময় কাউকে ছাড় দেয়না।
সুদেআসলে উশুল করে নেয়।
সেদিন যদি আমার মা,ভাই বোন আমাকে সাপোর্ট না দিতো।আজ তাহলে হয়তো আমি কবরে থাকতাম।
আমি ফাসি দিতে গিয়েছিলাম জানো?
কিন্তু জানালা দিয়ে আমার মা আর বোন দেখে ফেলেছিলো।
আর ওদের চিৎকার,হাহাকারে আমি পারিনি নিজেকে শেষ করে দিতে।
আশা করি তুমি আর তোমার স্ত্রীও তোমার মেয়ের পাশে থাকবে।
-আর তোমার স্বামী?
-ও উনি?উনি একজন ডাক্তার।
মা আমার কাছে সব কথা শুনে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কারণ আমার অবস্থাও তোমার মেয়ের মত অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো।
ক্লিনিকে সেদিন কোন ভালো মহিলা ডাক্তার না থাকায়,সদ্য ডাক্তারি পাশ করা ডাক্তারকেই আমার মা সব খুলে বললেন।
আর সেই ডাক্তার টি ই হলেন আমার স্বামী।আমার মেয়ের বাবা।
সে আমাকে কিছু মেডিসিন দিলেন।
মানসিক ভাবে আমাকে সাপোর্ট দিলেন।
ধীরেধীরে আমি সুস্থ হতে থাকলাম।
তোমার আর কোন খবর পেলাম না।
শুনলাম তুমি নাকি দেশ ছেড়েছো।
একটা বার আমাকে বলেও যাওনি।
বলবেই বা কেন।আমার প্রয়োজন তো তোমার কাছে সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
তারপর আমি সব ভুলে আবার পড়াশোনা শুরু করলাম।কিছু দিন পর
একদিন আমার বাসায় এক বিয়ের প্রপোজাল এলো,ঘটকের মাধ্যমে।আমি মাকে বললাম না করে দাও।আমি কাউকে ঠকাতে চাইনা।
কিন্তু মা আমাকে অনেক বুঝালেন।
মনে মনে ভাবলাম,ছেলে দেখতে এলে সব কিছু খুলে বলবো।
বলবো যে আমি একজনকে ভালবেসে অতীতে ধর্ষিত হয়েছি।
ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে এলো।
ছেলেকে দেখে তো আমার মা আর আমি।অবাক।
এ তো দেখছি সেই ডাক্তার টা।
মনে মনে ভাবলাম বিয়ে তো ক্যান্সিল সিউর।আমার আর কষ্ট করে কিছু বলতে হবেনা।
ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে বাসায় চলে গেলেন।বললেন বাসায় গিয়ে জানাবেন।
আমি আর মা তো বুঝেই গেছি এ বিয়ে হবেনা।
কিন্তু রাতেই ফোন এলো ছেলে পক্ষ থেকে।
-মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।
আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে আপনারা আমাদের বাড়ী ঘর দেখতে আসতে পারেন।আর পাকা কথা না হয় এখানেই হয়ে যাবে।
আমি আর মা তো পুরাই অবাক।
মাকে বললাম,ডাক্তার সাহেবের সাথে আমি কথা বলতে চাই।
মা কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলেন।
-জেনে শুনে একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করবেন?
-চুপ করো।কেউ নিজে ইচ্ছে করে ধর্ষিতা হয়না।কিছু মানুষ রুপি জানোয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এমন কাজ করে।
তাই নিজেকে একদম দোষ দিবেনা।
-দোষ তো আমার ছিলো।কেন দোষ দেবোনা?অপরাধী আমিই।
আমি তাকে ভালবেসেছিলাম,বিশ্বাস করেছিলাম।
-তুমি ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলে।ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছিলে।
সেটা ছিলো তোমার ভুল ভালবাসা।
এবার না হয় এই মানুষটাকে ভালবেসে দেখো।
বিশ্বাস করে দেখো।
আশা করি ঠকবেনা।
-করুণা করছেন?
-না,ভালবেসে বলছি।
হয়ে গেলো ভালো মানুষ টার সাথে বিয়ে।আর হয়ে গেলাম ভালো মানুষ টার সন্তানের গর্ভধারিণী মা।
ভালো আছি,খুব ভালো আছি।কিন্তু মাঝে মাঝে ভয়াবহ অতীতটা মনে কাঁটা দেয়।
-আমাকে তুমি মাফ করে দাও অধরা।
আমি অন্যায় করেছি তোমার সাথে।
যার শাস্তি আল্লাহ্ আমাকে এখন দিলেন।
আমি দেশ ছাড়িনি তখন।
নিজের শহর ছেড়েছিলাম।
অন্য শহরে গিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেছিলাম।জব করছিলাম একটা।
সেই জবের ওখানেই এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় আমার।মেয়েটাকে আর ধোকা দিতে পারিনি।
একদিন অনৈতিক সম্পর্ক করার সময় লোক জনের চোখে ধরা পড়ে যাই।
আর আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়।
এরপর থেকে আমরা সংসার করে যাচ্ছি।
মেয়ে হলো।সংসার হলো।
মেয়েটা গত পরশু বলেছিলো একটা ছেলেকে ভালবাসে।
ছেলেটা ভালো না বলে বলেছি ও পথ থেকে ফিরে আসতে।
মেয়ে একটা চিঠি লিখে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলো।
”বাবা-মা আমি আমার ভালবাসার হাত ধরে পালিয়ে গেলাম“
আমার মেয়েটাও ভুল মানুষকে ভালবেসে
প্রতারিত হলো।
আমার পাপের শাস্তি আমার মেয়েটা পেলো।
হঠাৎ করে অধরার স্বামী এসে বলে উঠলেন।
-সময় কাউকে ছাড় দেয়না।
যান মেয়ের কাছে যান।
-মাফ করে দিবেন আমাকে ভাই।হাত জোর করে বলছি ভাই।মাফ করবেন আমাকে।
-না না সমস্যা নেই।বরং আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই, আমার অধরাকে আপনি বিয়ে করেন নি বলে।নইলে আমি এত ভালো একটা মানুষকে আমার জীবন থেকে হারাতাম।
আবির ওর মেয়ের কাছে চলে যায়।
আর অধরা ওর ডাক্তার বরের বুকে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস নেয়।
(সমাপ্ত)
ভুল ভালোবাসা! শেষ পর্ব।
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:23 PM
Rating:

No comments