তবুও গল্প পর্ব-০১
................................'ভাইজান, বাদাম লাগবো?' রিনরিনে গলায় বাদামওয়ালা ছেলেটা সাব্বিরের কাছে
জিজ্ঞেস করল। ছেলেটার নাম সবুজ। মফস্বলের এই কলেজে সে-ই একমাত্র
বাদামওয়ালা। সাব্বিরের প্রেমের শুরুটা হয়েছিল এই ছেলের কাছ থেকে বাদাম
নিয়ে। আজ প্রেমের সমাপ্তিটাও হবে সবুজের বাদাম দিয়ে। আম গাছের নিচে
নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন। সাব্বির এবং জেরিন দুজনেই নীরব। সবুজ
কিছুটা বুঝতে পেরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তিন বছর বাদাম বেচা ক্যারিয়ারে
সে অনেক প্রেম হতে এবং অনেক প্রেম ভাঙতে দেখেছে। কিন্তু সাব্বিরকে সে কেন
জানি একটু বেশি পছন্দ করে।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুটো মানুষ। সাব্বির জেরিনের দিকে তাকিয়ে নেই। কলেজে বাউন্ডারির দেয়ালের উপর বসে থাকা অসহায় কাকের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাব্বির। জেরিন দ্বিধাগ্রস্ত। সে আগে কথা শুরু করবে নাকি সাব্বির? সেইদিনটাই তো জেরিনই কথা শুরু করেছিল। কিন্তু আজ? সাব্বির দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দুইবছর আগের সেইদিনটায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ক্লাসে ঢুকতে লেট করল সাব্বির। সাইকেলটা রাখতে গিয়ে অন্যের সাইকেল ফেলে দিয়েছিল। পরে আবার সেই সাইকেল উঠিয়ে রাখতে রাখতে ফিজিক্স স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। হাপাতে হাপাতে সাব্বির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আসতে পারি?
স্যার তখন রোল কল করছিলেন। রোল কল শেষ হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল সাব্বির। দ্বিতীয় বেঞ্চে বসা কয়েকটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসার কারণ অবশ্য সাব্বিরের বোকাবোকা ভাব। এটা সাব্বির নিজেও জানে যে তার চেহারার মধ্যে একটা বোকা ভাব আছে।
স্যার রোল কল শেষ করে সাব্বিরের দিকে এগিয়ে এলেন। স্যারের উচ্চতা সাড়ে চার ফুট কিন্তু গলার স্বরের উচ্চতা আকাশছোঁয়া।
-ইউ আর লেট।
-ইয়েস স্যার।
-কেন?
-স্যার, সাইকেল রাখতে গিয়ে...
কথাটা শেষ করার আগে সেই মেয়েগুলো সশব্দে হেসে উঠল। সাব্বিরকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিয়ে স্যার বলা শুরু করলেন। সাব্বির লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে পাশের ছেলেটাকে একটু সরতে বলে বসে পড়ল।
-শোন, আমার ক্লাসের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। অনুপস্থিত হওয়া যাবে না, প্রতিদিনের টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে আর প্রতি সপ্তাহে টিউটোরিয়াল এক্সাম দিতে হবে। আর ক্লাসে হাসাহাসি, কথাবার্তা বলা যাবে না। এই ছেলে, তোমার নাম কী?
সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে স্যারের প্রশ্ন। সাব্বির উঠে বলল, সাব্বির আহমেদ।
-আমি যা বলেছি বুঝতে পেরেছ?
-জ্বি স্যার।
-তুমি প্রথম দিনেই লেট। একটা কথা আছে, ফার্স্ট এক্সপ্রেশন ইজ দ্য বেস্ট এক্সপ্রেশন। জানো তো?
-জ্বি স্যার, জানি।
-তোমার এসএসসি রেজাল্ট কী?
-এ প্লাস।
-গোল্ডেন?
-না স্যার।
-নো প্রবলেম।
এরপর স্যার প্রত্যেকটা ছাত্রছাত্রীর নাম, এবং এসএসসি রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলেন। সবাই একেএকে বলছে। সাব্বিরের পাশের ছেলেটা বাপ্পি। তার রেজাল্ট সবচেয়ে দুর্বল ছিল। কিন্তু তার পাশে বসে সাব্বিরের মনে হল বন্ধু ভাবা যায় একে। সহপাঠী সবাই হয়, বন্ধু সবাই হয় না। দ্বিতীয় বেঞ্চে সুন্দর চেহারার মেয়েটা যে খুব জোরে হাসছিল তার নাম জেরিন। রেজাল্ট বলে বসে পড়েই এবার নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
সবাই একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে কারণ বিভিন্ন স্কুল থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রী এই কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাপ্পি কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। ঠিক সেইমুহূর্তে তাদের পাশ কাটিয়ে সাব্বির বেরিয়ে গেল। সাব্বিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল জেরিন। কিন্তু তার এমন ভাব নিয়ে চলে যাওয়াটা মেয়েটার ভাল লাগে নি।
কেমিস্ট্রি প্রফেসর দেখতে বাঘের মত, আর কণ্ঠস্বরও বাগের গর্জনের মত। কিন্তু তাঁর মনটা খুব ভাল। প্রথমদিনের ক্লাসে সব শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের সাথে পরিচিত হচ্ছে। সাব্বির তার পরিচয় দেওয়ার পর কেমিস্ট্রি স্যার সাব্বিরকে বললেন, তুমি প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা কর।
-স্যার, এখনি যাব?
-হ্যাঁ, এখনি।
সাব্বির জেরিনের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল ক্লাস থেকে। ক্লাসে মনোনিবেশ করল সবাই শুধু জেরিন ছাড়া। তার রাগমেশানো দৃষ্টি জানালার বাইরে।
কলেজের পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে সাব্বির। কিন্তু সে পেরে উঠছে না। সে এই পরিবেশের উপযুক্ত না। নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা খুবই কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। সাব্বির সেই চেষ্টা করছে। অফ-পিরিয়ডে দোতলার ফাঁকা ক্লাসে বসে অংকগুলো তুলছে সাব্বির। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তার মনযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। সাব্বিরের চারপাশে একদল মেয়ে এসে তাকে ঘিরে বসল। তার হার্টবিট বাড়ছে। এরা এমন করছে কেন?
ওদের দলের একটা মেয়ের নাম তনু। সে সাব্বিরের সামনে থেকে খাতা টান দিয়ে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কী ব্যাপার সাব্বির সাহেব, কী করছেন?
-অংকগুলো খাতায় তুলছি।
-অংকগুলো খাতায় তোলার কী দরকার? আপনি তো অনেক ভাল স্টুডেন্ট, সব মুখস্থ করে মাথায় তুলে রাখেন।
তনুর কথা শুনে মলি, রুমকি, জেরিন, সুমি সবাই হো হো করে হাসছে।
রুমকি এসে সাব্বিরের কোঁকড়া চুলের মধ্যে হাত দিয়ে জোরে টান মেরে বলল, আপনার মাথায় কাউয়ার বাসা ক্যান সাব্বির?
আবার হাসি। তনু বলল, সাব্বির না, সাব্বির সাহেব বল। দেখছিস না, কেমন সাহেবি ভাব।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে মেয়েগুলো র্যাগিং করতে লাগল সাব্বিরকে। সাব্বির মুখে হাত দিয়ে প্রত্যেকের দিকে কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে। ওদের র্যাগিংয়ে কিছুটা ভাঁটা পড়লে সাব্বির বলল, আমি কিছু বলি?
জেরিন বলল, অবশ্যই বলবেন মি. সাব্বির সাহেব।
তনু হো হো করে বলল, হাহাহা, মিস্টার আবার সাহেব।
সবাই একসাথে হাসছে।
সাব্বির মুচকি হেসে বল, মেয়েদের এভাবে একসাথে হাসাকে 'শাঁকচুন্নির হাসি' বলে। তোমরা নিশ্চয় শাঁকচুন্নি বা পেত্নী নও। আর হ্যাঁ, তোমরা যে মাঠের খেলোয়াড় আমি সে মাঠের খেলোয়াড় না। আর আমি যে মাঠের খেলোয়াড় তোমরা সে মাঠের দর্শকও না। তাই এসব ফাজলামো বাদ দিয়ে অন্যকিছু কর।
সবাই হাহা হাসি বাদ দিয়ে শুধু হা করে তাকিয়ে আছে। জেরিন বলল, এইযে মি. আপনি নিজেকে কী মনে করেন? হিরো নাকি মাস্তান?
সাব্বির তার উত্তরে নির্বাক হাসি দিয়ে উঠে পড়ল। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় তনুকে বলল, আর হ্যাঁ, তোমার টিশার্টটা খুব সুন্দর।
প্রশংসা শুনে ভদ্রতাসূচক 'ধন্যবাদ' দেওয়া উচিৎ। কিন্তু তনু এবং তার বান্ধবীরা অবাক হয়ে তনুর কাছে বলল, ওই স্টুপিড কী বলল? বুঝলাম না তো।
মলি বলল, কী খেলোয়াড়, মাঠ, ছাতামাতা ………
জেরিন বলল, আরে ওটা না। টিশার্টের কথা কী বলল?
তনু বলল, আমি আজ বোরকার নিচে জামা পরিনি। ঘুম থেকে উঠে টিশার্টের উপর বোরখা পরেই চলে এসেছি।
সবাই হা করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। জেরিন তনুর বোরখা ধরে টানাটানি শুরু করতেই সবাই জেরিনের সাথে যোগ দিল তনুর টিশার্ট দেখার জন্য। দোতলার ক্লাসরুমটা পাঁচটা মেয়ের অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ার উপক্রম।
সাব্বির কলেজ থেকে যাওয়ার সময় বাপ্পির সাথেই যায়। কারণ সাব্বিরের যাওয়ার পথেই বাপ্পির বাড়ি। দুইদিনেই সাব্বির বুঝে ফেলেছে, বাপ্পি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চাপাবাজ। তবুও তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
কেমিস্ট্রি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। স্যার পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন দিতেই সবাই লেখা শুরু করল শুধুমাত্র সাব্বির ছাড়া। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার সাব্বির? তুমি লিখছ না কেন?
-স্যার, আমি অংকগুলো করতে পারিনি।
-কেন?
-আমার খাতাটা হারিয়ে গেছে।
স্যার কী বলবে ভেবে পাচ্ছেন না কিন্তু তার কথা শুনে মেয়েদের মধ্যে চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। শুধু সেই হাসির সাথে যোগ দিল না জেরিন।
স্যার কী মনে করে বললেন, তুমি সারা পিরিয়ড দাঁড়িয়ে থাকবে।
সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে। আর সবাই লেখায় ব্যস্ত। সাব্বিরের এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে গান মনে করতে লাগল সাব্বির।
প্রথমেই দেশাত্মবোধক গান, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পরে দাঁড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে
খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে নাকি ফিরবে না?
এরপর তাহসানের গান,
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে
সাগরের জলে পাক দিয়ে
কাছে যেতে পারি না...
গান শেষ হওয়ার আগে স্যারের ধমক শুনে চমকে উঠল সাব্বির।
-তুমি ঘুমাচ্ছ নাকি?
-না স্যার, মনে করছি।
-কী মনে করছ?
-গান। দাঁড়িয়ে আছি তো। দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে গান মনে করার চেষ্টা করছি।
স্যারের অগ্নিশর্মা দৃষ্টি দেখে পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও।
সাব্বির কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ক্লাস থেকে বের হয়ে ছাদে উঠে গেল। এখান থেকে মাঠসহ পুকুর পর্যন্ত দেখা যায়।
চলবে.....
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুটো মানুষ। সাব্বির জেরিনের দিকে তাকিয়ে নেই। কলেজে বাউন্ডারির দেয়ালের উপর বসে থাকা অসহায় কাকের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাব্বির। জেরিন দ্বিধাগ্রস্ত। সে আগে কথা শুরু করবে নাকি সাব্বির? সেইদিনটাই তো জেরিনই কথা শুরু করেছিল। কিন্তু আজ? সাব্বির দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দুইবছর আগের সেইদিনটায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ক্লাসে ঢুকতে লেট করল সাব্বির। সাইকেলটা রাখতে গিয়ে অন্যের সাইকেল ফেলে দিয়েছিল। পরে আবার সেই সাইকেল উঠিয়ে রাখতে রাখতে ফিজিক্স স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। হাপাতে হাপাতে সাব্বির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আসতে পারি?
স্যার তখন রোল কল করছিলেন। রোল কল শেষ হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল সাব্বির। দ্বিতীয় বেঞ্চে বসা কয়েকটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসার কারণ অবশ্য সাব্বিরের বোকাবোকা ভাব। এটা সাব্বির নিজেও জানে যে তার চেহারার মধ্যে একটা বোকা ভাব আছে।
স্যার রোল কল শেষ করে সাব্বিরের দিকে এগিয়ে এলেন। স্যারের উচ্চতা সাড়ে চার ফুট কিন্তু গলার স্বরের উচ্চতা আকাশছোঁয়া।
-ইউ আর লেট।
-ইয়েস স্যার।
-কেন?
-স্যার, সাইকেল রাখতে গিয়ে...
কথাটা শেষ করার আগে সেই মেয়েগুলো সশব্দে হেসে উঠল। সাব্বিরকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিয়ে স্যার বলা শুরু করলেন। সাব্বির লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে পাশের ছেলেটাকে একটু সরতে বলে বসে পড়ল।
-শোন, আমার ক্লাসের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। অনুপস্থিত হওয়া যাবে না, প্রতিদিনের টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে আর প্রতি সপ্তাহে টিউটোরিয়াল এক্সাম দিতে হবে। আর ক্লাসে হাসাহাসি, কথাবার্তা বলা যাবে না। এই ছেলে, তোমার নাম কী?
সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে স্যারের প্রশ্ন। সাব্বির উঠে বলল, সাব্বির আহমেদ।
-আমি যা বলেছি বুঝতে পেরেছ?
-জ্বি স্যার।
-তুমি প্রথম দিনেই লেট। একটা কথা আছে, ফার্স্ট এক্সপ্রেশন ইজ দ্য বেস্ট এক্সপ্রেশন। জানো তো?
-জ্বি স্যার, জানি।
-তোমার এসএসসি রেজাল্ট কী?
-এ প্লাস।
-গোল্ডেন?
-না স্যার।
-নো প্রবলেম।
এরপর স্যার প্রত্যেকটা ছাত্রছাত্রীর নাম, এবং এসএসসি রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলেন। সবাই একেএকে বলছে। সাব্বিরের পাশের ছেলেটা বাপ্পি। তার রেজাল্ট সবচেয়ে দুর্বল ছিল। কিন্তু তার পাশে বসে সাব্বিরের মনে হল বন্ধু ভাবা যায় একে। সহপাঠী সবাই হয়, বন্ধু সবাই হয় না। দ্বিতীয় বেঞ্চে সুন্দর চেহারার মেয়েটা যে খুব জোরে হাসছিল তার নাম জেরিন। রেজাল্ট বলে বসে পড়েই এবার নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
সবাই একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে কারণ বিভিন্ন স্কুল থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রী এই কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাপ্পি কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। ঠিক সেইমুহূর্তে তাদের পাশ কাটিয়ে সাব্বির বেরিয়ে গেল। সাব্বিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল জেরিন। কিন্তু তার এমন ভাব নিয়ে চলে যাওয়াটা মেয়েটার ভাল লাগে নি।
কেমিস্ট্রি প্রফেসর দেখতে বাঘের মত, আর কণ্ঠস্বরও বাগের গর্জনের মত। কিন্তু তাঁর মনটা খুব ভাল। প্রথমদিনের ক্লাসে সব শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের সাথে পরিচিত হচ্ছে। সাব্বির তার পরিচয় দেওয়ার পর কেমিস্ট্রি স্যার সাব্বিরকে বললেন, তুমি প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা কর।
-স্যার, এখনি যাব?
-হ্যাঁ, এখনি।
সাব্বির জেরিনের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল ক্লাস থেকে। ক্লাসে মনোনিবেশ করল সবাই শুধু জেরিন ছাড়া। তার রাগমেশানো দৃষ্টি জানালার বাইরে।
কলেজের পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে সাব্বির। কিন্তু সে পেরে উঠছে না। সে এই পরিবেশের উপযুক্ত না। নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা খুবই কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। সাব্বির সেই চেষ্টা করছে। অফ-পিরিয়ডে দোতলার ফাঁকা ক্লাসে বসে অংকগুলো তুলছে সাব্বির। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তার মনযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। সাব্বিরের চারপাশে একদল মেয়ে এসে তাকে ঘিরে বসল। তার হার্টবিট বাড়ছে। এরা এমন করছে কেন?
ওদের দলের একটা মেয়ের নাম তনু। সে সাব্বিরের সামনে থেকে খাতা টান দিয়ে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কী ব্যাপার সাব্বির সাহেব, কী করছেন?
-অংকগুলো খাতায় তুলছি।
-অংকগুলো খাতায় তোলার কী দরকার? আপনি তো অনেক ভাল স্টুডেন্ট, সব মুখস্থ করে মাথায় তুলে রাখেন।
তনুর কথা শুনে মলি, রুমকি, জেরিন, সুমি সবাই হো হো করে হাসছে।
রুমকি এসে সাব্বিরের কোঁকড়া চুলের মধ্যে হাত দিয়ে জোরে টান মেরে বলল, আপনার মাথায় কাউয়ার বাসা ক্যান সাব্বির?
আবার হাসি। তনু বলল, সাব্বির না, সাব্বির সাহেব বল। দেখছিস না, কেমন সাহেবি ভাব।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে মেয়েগুলো র্যাগিং করতে লাগল সাব্বিরকে। সাব্বির মুখে হাত দিয়ে প্রত্যেকের দিকে কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে। ওদের র্যাগিংয়ে কিছুটা ভাঁটা পড়লে সাব্বির বলল, আমি কিছু বলি?
জেরিন বলল, অবশ্যই বলবেন মি. সাব্বির সাহেব।
তনু হো হো করে বলল, হাহাহা, মিস্টার আবার সাহেব।
সবাই একসাথে হাসছে।
সাব্বির মুচকি হেসে বল, মেয়েদের এভাবে একসাথে হাসাকে 'শাঁকচুন্নির হাসি' বলে। তোমরা নিশ্চয় শাঁকচুন্নি বা পেত্নী নও। আর হ্যাঁ, তোমরা যে মাঠের খেলোয়াড় আমি সে মাঠের খেলোয়াড় না। আর আমি যে মাঠের খেলোয়াড় তোমরা সে মাঠের দর্শকও না। তাই এসব ফাজলামো বাদ দিয়ে অন্যকিছু কর।
সবাই হাহা হাসি বাদ দিয়ে শুধু হা করে তাকিয়ে আছে। জেরিন বলল, এইযে মি. আপনি নিজেকে কী মনে করেন? হিরো নাকি মাস্তান?
সাব্বির তার উত্তরে নির্বাক হাসি দিয়ে উঠে পড়ল। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় তনুকে বলল, আর হ্যাঁ, তোমার টিশার্টটা খুব সুন্দর।
প্রশংসা শুনে ভদ্রতাসূচক 'ধন্যবাদ' দেওয়া উচিৎ। কিন্তু তনু এবং তার বান্ধবীরা অবাক হয়ে তনুর কাছে বলল, ওই স্টুপিড কী বলল? বুঝলাম না তো।
মলি বলল, কী খেলোয়াড়, মাঠ, ছাতামাতা ………
জেরিন বলল, আরে ওটা না। টিশার্টের কথা কী বলল?
তনু বলল, আমি আজ বোরকার নিচে জামা পরিনি। ঘুম থেকে উঠে টিশার্টের উপর বোরখা পরেই চলে এসেছি।
সবাই হা করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। জেরিন তনুর বোরখা ধরে টানাটানি শুরু করতেই সবাই জেরিনের সাথে যোগ দিল তনুর টিশার্ট দেখার জন্য। দোতলার ক্লাসরুমটা পাঁচটা মেয়ের অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ার উপক্রম।
সাব্বির কলেজ থেকে যাওয়ার সময় বাপ্পির সাথেই যায়। কারণ সাব্বিরের যাওয়ার পথেই বাপ্পির বাড়ি। দুইদিনেই সাব্বির বুঝে ফেলেছে, বাপ্পি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চাপাবাজ। তবুও তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
কেমিস্ট্রি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। স্যার পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন দিতেই সবাই লেখা শুরু করল শুধুমাত্র সাব্বির ছাড়া। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার সাব্বির? তুমি লিখছ না কেন?
-স্যার, আমি অংকগুলো করতে পারিনি।
-কেন?
-আমার খাতাটা হারিয়ে গেছে।
স্যার কী বলবে ভেবে পাচ্ছেন না কিন্তু তার কথা শুনে মেয়েদের মধ্যে চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। শুধু সেই হাসির সাথে যোগ দিল না জেরিন।
স্যার কী মনে করে বললেন, তুমি সারা পিরিয়ড দাঁড়িয়ে থাকবে।
সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে। আর সবাই লেখায় ব্যস্ত। সাব্বিরের এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে গান মনে করতে লাগল সাব্বির।
প্রথমেই দেশাত্মবোধক গান, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পরে দাঁড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে
খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে নাকি ফিরবে না?
এরপর তাহসানের গান,
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে
সাগরের জলে পাক দিয়ে
কাছে যেতে পারি না...
গান শেষ হওয়ার আগে স্যারের ধমক শুনে চমকে উঠল সাব্বির।
-তুমি ঘুমাচ্ছ নাকি?
-না স্যার, মনে করছি।
-কী মনে করছ?
-গান। দাঁড়িয়ে আছি তো। দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে গান মনে করার চেষ্টা করছি।
স্যারের অগ্নিশর্মা দৃষ্টি দেখে পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও।
সাব্বির কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ক্লাস থেকে বের হয়ে ছাদে উঠে গেল। এখান থেকে মাঠসহ পুকুর পর্যন্ত দেখা যায়।
চলবে.....
তবুও গল্প পর্ব-০১
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:26 PM
Rating:

No comments