তবুও পর্ব-০২
###__তবুও__###
( পর্ব - ২য় )
অফ পিরিয়ড। ক্লাসে মেয়েরা গল্প করছে। ছেলেরা বেরিয়ে গেছে বাইরে। তনু জেরিনকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, তোর কী হয়েছে রে? স্বামী মারা গেছে নাকি?
-ধুর। কিছু হয়নি।
-তাহলে সদ্য বিধবা নারীদের মত এমন গোমড়া মুখে বসে আছিস ক্যান?
-সাব্বিরকে দেখেছিস?
-না তো। ক্যান? কী হইছে?
-আমরা যে কাজটা করেছি তা কি ঠিক হয়েছে?
-কী করলাম?
-ভুলে গেলি? ওর খাতাটা তো আমরাই চুরি করেছি।
-শোন, ওটা চুরি না। আমরা ফাজলামি করেছি।
-কিন্তু বেচারা কতটা অপমান হল!
-তোর কি ওর জন্য মায়া হচ্ছে?
-না, নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ কাজ করছে।
-তাইলে যা, ওর পা ধরে মাফ চা। যতক্ষণ মাফ না করবে, ওর পা ধরে ঝুলে থাকবি।
হনহন করে তনু বেরিয়ে গেল। জেরিনের পাশে বসে রইল মলি। সুমি, রুমকি গেল তনুর সাথে। তনু রাগে গজগজ করছে, ওই স্টুপিড আমার সাথে মিসবিহ্যাভ করেছে আর তার জন্য মহারাণীর দরদ উথলে পড়ছে। চল তো, ভাল্লাগছে না।
আমগাছের নিচে সাব্বির বসে আছে। চুমকি বসানো ওড়না মাথায় দেওয়া কেউ আসছে তার দিকে। চুমকির উপর রোদ পড়ায় চিকচিক করছে মাথাটা তার জন্য মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সাব্বির বোঝার চেষ্টাও করছে না। একটু দূরে দাঁড়ানো সবুজকে ডেকে বলল, এক টাকার বাদাম দে।
-এক টাকার হইব না।
-আমার কাছে টাকা নাই। বাকিতে দে। দুই টাকার দিবি।
সবুজ সত্যিই বাদাম দিয়ে টাকা না নিয়ে চলে গেল। পাশে এসে দাঁড়ালো জেরিন।
জেরিনকে দেখে সাব্বির উঠে হাঁটা শুরু করল। সাব্বিরের এমন আচরণে বরাবরের মত আবারও আহত হলো জেরিন। আমগাছের নিচে পড়ে রইল দুই টাকার বাদাম।
হঠাৎ বেশ কিছুদিন ধরে সাব্বিরের অনুপস্থিতি। কলেজে আসছে না সে। সাব্বির কারও সাথে খুব একটা মেশে না। মাঝেমাঝে বাপ্পির সাথে তার ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতো। তনু জেরিনের উপর রাগ হয়েছিল। যদিও এসব রাগ স্বল্পমেয়াদী হয়, তবুও জেরিনের সাথে তার দূরত্ব এখনো বেশ আছে। তনু কিছুটা এগিয়ে এসে জেরিনকে বলল, আর কয়দিন কথা না বলে থাকবি?
-আমি তো ওর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও তো কথাই বলে না।
-ওই, আমি আমার সাথে কথা বলার কথা বলছি। তুই কার কথা বলছিস?
তনুর ধমকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে।
অবশেষে তনু জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বল তো, তুই কি সাব্বিরকে পছন্দ করিস?
-ধুর, ওকে পছন্দ করার কী আছে? আনস্মার্ট, ক্ষ্যাত কেমন সাইকো টাইপের একটা...
-না হলেই ভালো।
-চল, ঝালমুড়ি খেয়ে আসি।
তনু সুমি, মলি, রুমকিকে ডেকে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। তক্ষুনি জেরিন বলল, তোরা যেতে লাগ, আমি আসছি।
জেরিন বাপ্পির কাছে এসে বলল, বাপ্পি, তোমার খবর কী?
সহপাঠী হয়েছে, কিন্তু বন্ধু হয়ে ওঠেনি। এইজন্য এখনো 'তুমি' থেকে 'তুই'তে আসা হয়নি।
-হুম, ভালো।
-তোমাকে গতকাল চৌরঙ্গী দেখলাম।
-কখন?
-সন্ধ্যার আগেআগে।
-নাহ, আমি ওই সময় আসিনি।
-তাহলে তোমার মত কাউকে দেখেছি হয়তো। তোমার বন্ধুকে দেখছি না যে কয়েকদিন!
-ওর খবর জানি না।
-তোমার বন্ধু, একটু খোঁজখবর নিবে না?
-কিভাবে নিবো? ওর ফোন নাই। এমনকি ওর বাড়িতেও ফোন নাই।
-ও আচ্ছা।
মুখটা শুকিয়ে গেলো জেরিনের। শুকনা মুখে এগিয়ে গেল কলেজের গোলচত্বরের দিকে ঝালমুড়ির ভ্রাম্যমাণ দোকানে।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরের কথা। ফিজিক্স স্যারের ক্লাস চলছে। ক্লাসের বাইরে থেকে স্যারের কিন্নর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, দুটি বস্তুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভারী বস্তু আগে....
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্যান্টশার্ট টাকড ইন করা, পায়ে কালো জুতা, চোখে রিমলেস চশমা, মাথায় জবজবে তেল, সাদা দাঁত বের করে হাসি হেসে বলল, স্যার আসতে পারি?
স্যার না তাকিয়েই বললেন, আসো।
ছেলেটার হাঁটার ভঙ্গিতে কেমন যেন চঞ্চলতা আছে যা সবার চোখে পড়ার মতো। পিছনের বেঞ্চে বসার সাথেসাথে সব ছেলেমেয়ে হা করে ছেলেটাকে দেখছে। মোটা গ্লাসের চশমা চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ব্লাকবোর্ডের দিকে। স্যার লেখা শেষ করেই খেয়াল করলেন সব ছাত্রছাত্রী তাকিয়ে আছে পিছনের ছেলেটার দিকে। স্যারের উচ্চতা কম হওয়ায় সামনে থেকে তিনি ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। এগিয়ে এসে ছেলেটার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই কলেজের স্টুডেন্ট?
-জ্বি স্যার।
-আগে তো দেখিনি কখনো। নাম কী তোমার?
-স্যার, সাব্বির আহমেদ।
নাম শোনার সাথেসাথে সব ছেলেমেয়ের মুখের হা আরও বড় হয়ে গেল। সাব্বিরকে চেনাই যাচ্ছে না। সেই উসকোখুসকো চুল, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, শার্টের বোতাম খোলা চোখে বিষণ্ণতা- এসবের কোন কিছুই এখন সাব্বিরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
ক্লাস শেষ হতেই সব ছেলেমেয়ে সাব্বিরকে ঘিরে ধরলো। তাকে এমনভাবে দেখছে যেন ভিনগ্রহ থেকে কোন এলিয়েন নেমে এসেছে। বাপ্পি বলল, তোর চেহারা তো পুরাই চেঞ্জড। একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের মতো।
-সরি বন্ধু, চার্লি চ্যাপলিন এর মতো গোফ নেই আমার।
মেয়েদের মধ্য থেকে কেউ একজন জোরে জোরে বলছে, একটা দেশে ছিল একটা স্টুপিড। হঠাৎ সে উধাও হয়ে সতেরো দিন পর উদয় হলো একেবারে শান্তশিষ্ট, লেজবিশিষ্ট ভদ্রছেলে হয়ে। তার এই আমূল পরিবর্তনের কারণ জানতে চায় জাতি।
মেয়েদের মধ্যে উচ্চস্বরে হাসির শব্দে বদ্ধ ক্লাস কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাব্বিরের এমন করার কারণে সব ছেলেদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সবাই অন্তত বুঝলো যে সাব্বিরকে দেখে যতটা রসকষহীন মনে হয়, আসলে সে সেরকম না। সাব্বিরের এতদিন অনুপস্থিত থাকার কারণটা সাব্বিরের কাছ থেকে সবাই জানলো। তা হলো, তার জ্বর হয়েছিল। জ্বর থেকে উঠে তার মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা এলো যে সবাইকে একটু ভড়কে দিতে হবে। এইজন্য এই ছদ্মবেশ ধারণ করা।
বায়োলজি ক্লাসে স্যার আসেননি। ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলের দোতলার ক্লাসরুম গমগম করছে। তার উপর পুরনো বিল্ডিংয়ে ছাদের উপর রাজমিস্ত্রি কাজ করছে। পিছনের বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে সাব্বির আছে চুপচাপ। হইহুল্লোড়ের জন্য তার মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। বসেবসে হাতের মধ্যে কলম ঘুরাচ্ছে সে। হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে জেরিনকে ডাক দিল সাব্বির। ক্লাসের সবাই একমুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে তাকালো সাব্বিরের দিকে। হাতের কলমটা সজোরে ছুড়ে মারলো জেরিনের দিকে। ভয় পেয়ে জেরিন দুই সরে গেল। সাব্বিরের এমন উদ্ভট আচরণে সবাই হতবাক। ঠিক সেইমুহূর্তে ছাদ থেকে বড় একটুকরো প্লাস্টার খসে পড়ল যেখানে জেরিন দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সবাই নির্বাক হয়ে আছে। কোলাহলপূর্ণ ক্লাসরুমটা এখন নিঃশব্দতায় ভুগছে।
সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে সাব্বির। আজ ক্লাস শেষ। সাইকেল শেড থেকে বের হওয়ার সাথেই জেরিন সাব্বিরকে ডেকে বলল, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?
হ্যাঁ বা না কোনটাই না বলে দাঁড়িয়ে রইল সাব্বির। আড়চোখে শুধু একবার তাকালো জেরিনের দিকে। তপ্ত দুপুরের প্রখর রোদের মধ্য দিয়ে যেন কোন আগুনসুন্দরী এগিয়ে আসছে তার দিকে। এই সৌন্দর্য না দেখে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটা বড় ভুল। সাব্বির সেই বড় ভুলটা করল। তাকিয়ে আছে ফুলহীন কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে।
-থ্যাংক ইউ সাব্বির।
-ওকে।
এটুকু বলেই সাব্বির হাঁটা শুরু করল। জেরিন পিছন দিক থেকে সাইকেলের কেরিয়ার ধরে টান দিতেই নিজের হাতে ব্যথা পেয়ে 'আহ' করে শব্দ করে উঠল। বেশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো সাব্বির। ব্যথাপাওয়া হাতে ফুল দিচ্ছে জেরিন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সাব্বির জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
-পাঁচ মিনিট ওয়েট করলে সমস্যা হবে?
-আমার টিউশনি আছে। যাওয়ার পথে পড়াতে হবে।
-পাঁচ মিনিট দেরী হলে সমস্যা হবে না। তুমি গোলচত্বরে বসো। আমি আসছি।
সাব্বিরের একবার মনে হল বসে থাকার কোন মানে হয় না। তবুও এই ফাঁকা কলেজে তাকে রেখে এভাবে চলে যাওয়াটাও তার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর জেরিন ফিরে এলো। তার হাত ভেজা।
-তোমার কাছে টিস্যু আছে?
-না, ঘামে ভেজা একটা রুমাল আছে।
-দাও তো।
-ওটা ময়লা।
-দিতে বলছি দাও।
রুমাল বের করে দিতেই জেরিন ওটা তার হাতের তালুতে পেঁচালো। সাব্বির খেয়াল করল, ফর্সা হাতের তালু লাল হয়ে আছে। সাব্বির চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে তার সাইকেলের ক্যারিয়ারের দিকে।
সাব্বিরের পাশে বসতেই সে বলল, তোমার হাত কেটে যাওয়ার জন্য সরি।
-তুমি সরি হচ্ছ কেন? তোমার জন্য তো আর কাটেনি। আমি হাত দিলাম তাই কেটে গেল। আর সরি তো আমার হওয়ার কথা। তোমার খাতাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে ক্লাস থেকে তোমাকে বের করে দিল। I am extremely sorry.
-ঠিক আছে।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-একদম শেষপ্রান্তে। নাম বললে চিনবে না।
-তোমার পরিবারে কে কে আছে?
-এটা জানা কি জরুরী?
হুট করে রেগে গেল জেরিন। রাগতস্বরে বলল, তুমি কি ভালভাবে কথা বলতে পারো না?
-নাহ, পারি না।
দুজনে চুপচাপ। বাদামওয়ালা সবুজকে দেখে সাব্বির ডাকল। সেদিনের দুইটাকা বাকি ছিল, তা ফেরত দেওয়া হয়নি। সবুজকে ডেকে বলল, এই পাঁচটাকা নে। আর তিন টাকার বাদাম দে।
বাদাম দিয়ে চলে গেল সবুজ। সাব্বির একা একা বাদাম খাচ্ছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে জেরিনের। গালদুটো লাল হয়ে আছে তার। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে।
-সাব্বির, তোমার সাথে আমরা মজা করেছি, র্যাগিং করেছি ওগুলোর তুমি যদি রাগ করে বসে থাকো তাহলে কি আমার খারাপ লাগে না? তোমার কাছে সরি বললাম, তারপরেও...
বাদাম চিবনো শেষ করে সাব্বির বলল, দেখ জেরিন, আমি ওর জন্য তোমার উপর রাগ করে নেই। আমি কারও উপর রাগ করতে পারি না। তুমি হয়তো কোন বড়লোক বাবার মেয়ে। এইজন্য একটা রাস্তার ছেলের ব্যাপারটা তুমি বুঝবে না।
-রাস্তার ছেলে? মানে কী?
-আমার বাবামা কেউ নেই। একচালা একটা টিনের ঘরে একা থাকি। টিউশনি করাই। আর....
নির্বাক বসে রইল জেরিন। বাদামগুলো জেরিনের হাতের উপর দিয়ে উঠে পড়ল সাব্বির। পিছন ফিরে তাকালো না সে। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় দশমিনিট দেরী হয়েছে। টিউশনিটা নিয়মিত না করতে পারলে সমস্যা হয়ে যাবে।
ফাঁকা কলেজে গোলচত্বরে বসে রইল জেরিন। তার হাতে বাদামগুলো। সাব্বির কিছু বাদাম খেয়েছে আর বাকিগুলো খোসা ছাড়িয়ে রেখে দিয়েছে। বাদামওয়ালা ছেলেটা বিটলবণ দেয়নি। কিন্তু এই বাদামগুলোতে লবণের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। ফর্সা গাল বেয়ে পড়া দুফোঁটা অশ্রুওই যথেষ্ট বাদামগুলোকে লবণাক্ত করতে।
কেমিস্ট্রি স্যারের অফিসরুমে ডাকা হয়েছে সাব্বিরকে। স্যারের সামনে যেতে সাব্বিরের একটু ভয় লাগে যদিও স্যার তাকে খুব ভালবাসে।
-স্যার, আসব?
-হ্যাঁ, আসো। তুমি প্রাইভেটে আসো না কেন?
-স্যার, আমার বাড়ি থেকে কলেজে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। আর আসার আগে আমি একটা টিউশনি করাই।
-প্রাইভেটে নিয়মিত না হলে তোমারই ক্ষতি। প্রাইভেটে তোমার কাছ থেকে কোন শিক্ষকই টাকা নিবে না। তবুও কেন আসছ না? তুমি এক কাজ কর, এখানে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাসায় লজিং থাকো।
-ক্ষমা করবেন স্যার। আমি লজিং থাকতে চাচ্ছি না।
-দেখ সাব্বির, তোমার রেজাল্ট ভাল। তোমাকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু তুমি যদি………
স্যারের কথায় বেশ যুক্তি আছে। কিন্তু সাব্বির তার কথায় অনড়। স্যার কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, তোমার আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি, তাই না?
-স্যার, আমার কিছু নেই। রাস্তার ছেলেদের কিছু থাকে না। গরীবের থাকার মধ্যে শুধু আত্মসম্মানটাই থাকে। সেটাও যদি শেষ হয়ে যায়………
-আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যা ভাল বোঝ। তবে কখনো যদি তোমার মন বদলায়, আমাকে বল।
-ঠিক আছে স্যার।
-এখন যাও।
সাব্বির বের হয়ে এলো। আজ বিজ্ঞান বিভাগের সাথে বানিজ্য বিভাগের ফুটবল খেলা। সাব্বিরকেও দলে রাখা হয়েছে। খেলা শুরু হবে এগারোটায় কিন্তু সবাই দশটার সময় মাঠে নেমে গেলো। কলেজের শিক্ষকরাও খেলা দেখবে বলে একাডেমিক ভবনের সামনে চেয়ার এনে স্যারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথাসময়ে খেলা শুরু হল। বেশিরভাগ প্লেয়ারের পায়ে বুট পরা। সাব্বিরের পায়ে বুটজুতো নেই। খালি পায়ে তার খেলতে অবশ্য সমস্যা হয় না। প্রথম দশমিনিটেই একটা পেনাল্টি শট পেলো বিজ্ঞান বিভাগ। দলের অধিনায়ক কাকে দিয়ে পেনাল্টিটা করাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। সাব্বির এগিয়ে এসে বলল, আমি করি?
-দেখ, এটা আমাদের জেতার চান্স। পারবি তুই?
-চেষ্টা করে দেখতে পারি।
বাশি বাজার সাথে সাথে দশ ফুট দূর থেকে দৌড়ে এসে বলে কিক করল সাব্বির। গোলপোস্টের ডান পাশের কোণা দিয়ে গুলির বেগে বল ঢুকে একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় যেখানে বসে ছাত্রীরা খেলা দেখছিল, সেখানে গ্রিলে গিয়ে বল লাগল। গোল করায় সাব্বিরকে কোল্র নিয়ে নাচতে লাগল তার দলের প্লেয়াররা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় হইচইটা অন্যরকম শুনে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটা ছাত্রী অসুস্থ হয়ে গেছে। গ্রিলে হাত ছিল তার, বল গিয়ে আঙ্গুলে লেগে আঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। খবরটা শোনার পর সাব্বিরের মন খারাপ হয়ে গেল। এরকম শট গিয়ে ওভাবে কাউকে আহত করে দিবে তা সে ভাবেনি। একটা ভ্যান ডেকে রোগীকে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রীটা কে এটা খোঁজ নিয়ে জানা গেল ও জেরিন ছিল। শোনার পর নিজের কাছেই অকারণে খুব খারাপ লাগছে সাব্বিরের। কিছুক্ষণ পর ইনজুরির কারণে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল সাব্বির। খেলায় ২-১ গোলে বিজ্ঞান বিভাগের জয় হল। খেলা শেষ হতেই সাব্বির গেল ক্লিনিকে। কিন্তু তার আগেই জেরিনকে বাসায় নিয়ে গেছে। মন খারাপ করে সেদিন বাড়ি চলে গেল সাব্বির। তারপর থেকে বেশকিছুদিন সে নিখোঁজ। আর সাব্বিরের নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোনভাবেই তার খোঁজ নেওয়া যায় না।
প্রায় দশদিন পর আবার কলেজে এসেছে সাব্বির। শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। গায়ের রংটাও আগের চেয়ে কালচে হয়ে গেছে। চোখ অক্ষিকোটরের অনেক ভিতরে। দেখে বোঝা যায়, অনেক বড় ধকল গেছে তার।
বন্ধুরা সবাই ঘিরে ধরেছে সাব্বিরকে।
-কিরে? তোর এই অবস্থা কেন? আমরা তো ভেবেছিলাম, আবারও নতুন লুকে তোকে দেখব। কী হয়েছিল তোর?
-জন্ডিস।
ছেলেদের সাথে কথা বলার সময় এদিকওদিক কিছু খুঁজছে সে।
বাপ্পি বলল, কী খুঁজিস?
-কিছু না।
-কিছু একটা তো বটেই।
-আরে নাহ।
বাপ্পি আর কথা বাড়ালো না। এক ফাঁকে শুধু বলল, তোর সাথে কিছু কথা আছে। পরে বলব।
বারোটার দিকে বায়োলজি ক্লাস থেকে বের হয়ে সাব্বিরকে একা পেয়ে বাপ্পি বলল, তোকে দেখা করতে বলেছে।
-কে?
-যাকে তখন খুঁজছিলি।
-আমি কাউকে খুঁজি নাই।
-তোর চোখেমুখে মিথ্যা ভেসে উঠছে। যাইহোক, এটা তোর।
-কী এটা?
-চিঠি।
-কে দিয়েছে?
-খুলে দেখ।
সাব্বির অনাগ্রহের সাথে চিঠিটা খুলল। তাতে গোটাগোটা হাতে লেখা, দেখতে এলে খুশি হব।-জেরিন।
নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে সাব্বিরের। বাপ্পিকে বলল, চল, সবাই মিলে ওকে দেখে আসি।
-চিঠিটা সবাইকে দেয়নি। তোকে দিয়েছে। আর সবাই ওকে দেখে এসেছে।
-অন্তত তুই আমার সাথে চল।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
-ওকে দেখতে গেলে কিছু নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নাই।
-আরে, কিছু নেওয়া লাগবে না।
-নাহ। অসুস্থ কাউকে দেখতে গেলে ফলমূল নেওয়া উচিৎ। আমাকে একশো টাকা ধার দে।
বাপ্পির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু আপেল কিনে বাপ্পিকে সাথে নিয়েই জেরিনকে দেখতে গেল সাব্বির।
চলবে.....
( পর্ব - ২য় )
অফ পিরিয়ড। ক্লাসে মেয়েরা গল্প করছে। ছেলেরা বেরিয়ে গেছে বাইরে। তনু জেরিনকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, তোর কী হয়েছে রে? স্বামী মারা গেছে নাকি?
-ধুর। কিছু হয়নি।
-তাহলে সদ্য বিধবা নারীদের মত এমন গোমড়া মুখে বসে আছিস ক্যান?
-সাব্বিরকে দেখেছিস?
-না তো। ক্যান? কী হইছে?
-আমরা যে কাজটা করেছি তা কি ঠিক হয়েছে?
-কী করলাম?
-ভুলে গেলি? ওর খাতাটা তো আমরাই চুরি করেছি।
-শোন, ওটা চুরি না। আমরা ফাজলামি করেছি।
-কিন্তু বেচারা কতটা অপমান হল!
-তোর কি ওর জন্য মায়া হচ্ছে?
-না, নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ কাজ করছে।
-তাইলে যা, ওর পা ধরে মাফ চা। যতক্ষণ মাফ না করবে, ওর পা ধরে ঝুলে থাকবি।
হনহন করে তনু বেরিয়ে গেল। জেরিনের পাশে বসে রইল মলি। সুমি, রুমকি গেল তনুর সাথে। তনু রাগে গজগজ করছে, ওই স্টুপিড আমার সাথে মিসবিহ্যাভ করেছে আর তার জন্য মহারাণীর দরদ উথলে পড়ছে। চল তো, ভাল্লাগছে না।
আমগাছের নিচে সাব্বির বসে আছে। চুমকি বসানো ওড়না মাথায় দেওয়া কেউ আসছে তার দিকে। চুমকির উপর রোদ পড়ায় চিকচিক করছে মাথাটা তার জন্য মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সাব্বির বোঝার চেষ্টাও করছে না। একটু দূরে দাঁড়ানো সবুজকে ডেকে বলল, এক টাকার বাদাম দে।
-এক টাকার হইব না।
-আমার কাছে টাকা নাই। বাকিতে দে। দুই টাকার দিবি।
সবুজ সত্যিই বাদাম দিয়ে টাকা না নিয়ে চলে গেল। পাশে এসে দাঁড়ালো জেরিন।
জেরিনকে দেখে সাব্বির উঠে হাঁটা শুরু করল। সাব্বিরের এমন আচরণে বরাবরের মত আবারও আহত হলো জেরিন। আমগাছের নিচে পড়ে রইল দুই টাকার বাদাম।
হঠাৎ বেশ কিছুদিন ধরে সাব্বিরের অনুপস্থিতি। কলেজে আসছে না সে। সাব্বির কারও সাথে খুব একটা মেশে না। মাঝেমাঝে বাপ্পির সাথে তার ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতো। তনু জেরিনের উপর রাগ হয়েছিল। যদিও এসব রাগ স্বল্পমেয়াদী হয়, তবুও জেরিনের সাথে তার দূরত্ব এখনো বেশ আছে। তনু কিছুটা এগিয়ে এসে জেরিনকে বলল, আর কয়দিন কথা না বলে থাকবি?
-আমি তো ওর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও তো কথাই বলে না।
-ওই, আমি আমার সাথে কথা বলার কথা বলছি। তুই কার কথা বলছিস?
তনুর ধমকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে।
অবশেষে তনু জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বল তো, তুই কি সাব্বিরকে পছন্দ করিস?
-ধুর, ওকে পছন্দ করার কী আছে? আনস্মার্ট, ক্ষ্যাত কেমন সাইকো টাইপের একটা...
-না হলেই ভালো।
-চল, ঝালমুড়ি খেয়ে আসি।
তনু সুমি, মলি, রুমকিকে ডেকে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। তক্ষুনি জেরিন বলল, তোরা যেতে লাগ, আমি আসছি।
জেরিন বাপ্পির কাছে এসে বলল, বাপ্পি, তোমার খবর কী?
সহপাঠী হয়েছে, কিন্তু বন্ধু হয়ে ওঠেনি। এইজন্য এখনো 'তুমি' থেকে 'তুই'তে আসা হয়নি।
-হুম, ভালো।
-তোমাকে গতকাল চৌরঙ্গী দেখলাম।
-কখন?
-সন্ধ্যার আগেআগে।
-নাহ, আমি ওই সময় আসিনি।
-তাহলে তোমার মত কাউকে দেখেছি হয়তো। তোমার বন্ধুকে দেখছি না যে কয়েকদিন!
-ওর খবর জানি না।
-তোমার বন্ধু, একটু খোঁজখবর নিবে না?
-কিভাবে নিবো? ওর ফোন নাই। এমনকি ওর বাড়িতেও ফোন নাই।
-ও আচ্ছা।
মুখটা শুকিয়ে গেলো জেরিনের। শুকনা মুখে এগিয়ে গেল কলেজের গোলচত্বরের দিকে ঝালমুড়ির ভ্রাম্যমাণ দোকানে।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরের কথা। ফিজিক্স স্যারের ক্লাস চলছে। ক্লাসের বাইরে থেকে স্যারের কিন্নর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, দুটি বস্তুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভারী বস্তু আগে....
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্যান্টশার্ট টাকড ইন করা, পায়ে কালো জুতা, চোখে রিমলেস চশমা, মাথায় জবজবে তেল, সাদা দাঁত বের করে হাসি হেসে বলল, স্যার আসতে পারি?
স্যার না তাকিয়েই বললেন, আসো।
ছেলেটার হাঁটার ভঙ্গিতে কেমন যেন চঞ্চলতা আছে যা সবার চোখে পড়ার মতো। পিছনের বেঞ্চে বসার সাথেসাথে সব ছেলেমেয়ে হা করে ছেলেটাকে দেখছে। মোটা গ্লাসের চশমা চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ব্লাকবোর্ডের দিকে। স্যার লেখা শেষ করেই খেয়াল করলেন সব ছাত্রছাত্রী তাকিয়ে আছে পিছনের ছেলেটার দিকে। স্যারের উচ্চতা কম হওয়ায় সামনে থেকে তিনি ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। এগিয়ে এসে ছেলেটার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই কলেজের স্টুডেন্ট?
-জ্বি স্যার।
-আগে তো দেখিনি কখনো। নাম কী তোমার?
-স্যার, সাব্বির আহমেদ।
নাম শোনার সাথেসাথে সব ছেলেমেয়ের মুখের হা আরও বড় হয়ে গেল। সাব্বিরকে চেনাই যাচ্ছে না। সেই উসকোখুসকো চুল, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, শার্টের বোতাম খোলা চোখে বিষণ্ণতা- এসবের কোন কিছুই এখন সাব্বিরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
ক্লাস শেষ হতেই সব ছেলেমেয়ে সাব্বিরকে ঘিরে ধরলো। তাকে এমনভাবে দেখছে যেন ভিনগ্রহ থেকে কোন এলিয়েন নেমে এসেছে। বাপ্পি বলল, তোর চেহারা তো পুরাই চেঞ্জড। একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের মতো।
-সরি বন্ধু, চার্লি চ্যাপলিন এর মতো গোফ নেই আমার।
মেয়েদের মধ্য থেকে কেউ একজন জোরে জোরে বলছে, একটা দেশে ছিল একটা স্টুপিড। হঠাৎ সে উধাও হয়ে সতেরো দিন পর উদয় হলো একেবারে শান্তশিষ্ট, লেজবিশিষ্ট ভদ্রছেলে হয়ে। তার এই আমূল পরিবর্তনের কারণ জানতে চায় জাতি।
মেয়েদের মধ্যে উচ্চস্বরে হাসির শব্দে বদ্ধ ক্লাস কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাব্বিরের এমন করার কারণে সব ছেলেদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সবাই অন্তত বুঝলো যে সাব্বিরকে দেখে যতটা রসকষহীন মনে হয়, আসলে সে সেরকম না। সাব্বিরের এতদিন অনুপস্থিত থাকার কারণটা সাব্বিরের কাছ থেকে সবাই জানলো। তা হলো, তার জ্বর হয়েছিল। জ্বর থেকে উঠে তার মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা এলো যে সবাইকে একটু ভড়কে দিতে হবে। এইজন্য এই ছদ্মবেশ ধারণ করা।
বায়োলজি ক্লাসে স্যার আসেননি। ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলের দোতলার ক্লাসরুম গমগম করছে। তার উপর পুরনো বিল্ডিংয়ে ছাদের উপর রাজমিস্ত্রি কাজ করছে। পিছনের বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে সাব্বির আছে চুপচাপ। হইহুল্লোড়ের জন্য তার মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। বসেবসে হাতের মধ্যে কলম ঘুরাচ্ছে সে। হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে জেরিনকে ডাক দিল সাব্বির। ক্লাসের সবাই একমুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে তাকালো সাব্বিরের দিকে। হাতের কলমটা সজোরে ছুড়ে মারলো জেরিনের দিকে। ভয় পেয়ে জেরিন দুই সরে গেল। সাব্বিরের এমন উদ্ভট আচরণে সবাই হতবাক। ঠিক সেইমুহূর্তে ছাদ থেকে বড় একটুকরো প্লাস্টার খসে পড়ল যেখানে জেরিন দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সবাই নির্বাক হয়ে আছে। কোলাহলপূর্ণ ক্লাসরুমটা এখন নিঃশব্দতায় ভুগছে।
সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে সাব্বির। আজ ক্লাস শেষ। সাইকেল শেড থেকে বের হওয়ার সাথেই জেরিন সাব্বিরকে ডেকে বলল, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?
হ্যাঁ বা না কোনটাই না বলে দাঁড়িয়ে রইল সাব্বির। আড়চোখে শুধু একবার তাকালো জেরিনের দিকে। তপ্ত দুপুরের প্রখর রোদের মধ্য দিয়ে যেন কোন আগুনসুন্দরী এগিয়ে আসছে তার দিকে। এই সৌন্দর্য না দেখে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটা বড় ভুল। সাব্বির সেই বড় ভুলটা করল। তাকিয়ে আছে ফুলহীন কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে।
-থ্যাংক ইউ সাব্বির।
-ওকে।
এটুকু বলেই সাব্বির হাঁটা শুরু করল। জেরিন পিছন দিক থেকে সাইকেলের কেরিয়ার ধরে টান দিতেই নিজের হাতে ব্যথা পেয়ে 'আহ' করে শব্দ করে উঠল। বেশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো সাব্বির। ব্যথাপাওয়া হাতে ফুল দিচ্ছে জেরিন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সাব্বির জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
-পাঁচ মিনিট ওয়েট করলে সমস্যা হবে?
-আমার টিউশনি আছে। যাওয়ার পথে পড়াতে হবে।
-পাঁচ মিনিট দেরী হলে সমস্যা হবে না। তুমি গোলচত্বরে বসো। আমি আসছি।
সাব্বিরের একবার মনে হল বসে থাকার কোন মানে হয় না। তবুও এই ফাঁকা কলেজে তাকে রেখে এভাবে চলে যাওয়াটাও তার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর জেরিন ফিরে এলো। তার হাত ভেজা।
-তোমার কাছে টিস্যু আছে?
-না, ঘামে ভেজা একটা রুমাল আছে।
-দাও তো।
-ওটা ময়লা।
-দিতে বলছি দাও।
রুমাল বের করে দিতেই জেরিন ওটা তার হাতের তালুতে পেঁচালো। সাব্বির খেয়াল করল, ফর্সা হাতের তালু লাল হয়ে আছে। সাব্বির চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে তার সাইকেলের ক্যারিয়ারের দিকে।
সাব্বিরের পাশে বসতেই সে বলল, তোমার হাত কেটে যাওয়ার জন্য সরি।
-তুমি সরি হচ্ছ কেন? তোমার জন্য তো আর কাটেনি। আমি হাত দিলাম তাই কেটে গেল। আর সরি তো আমার হওয়ার কথা। তোমার খাতাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে ক্লাস থেকে তোমাকে বের করে দিল। I am extremely sorry.
-ঠিক আছে।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-একদম শেষপ্রান্তে। নাম বললে চিনবে না।
-তোমার পরিবারে কে কে আছে?
-এটা জানা কি জরুরী?
হুট করে রেগে গেল জেরিন। রাগতস্বরে বলল, তুমি কি ভালভাবে কথা বলতে পারো না?
-নাহ, পারি না।
দুজনে চুপচাপ। বাদামওয়ালা সবুজকে দেখে সাব্বির ডাকল। সেদিনের দুইটাকা বাকি ছিল, তা ফেরত দেওয়া হয়নি। সবুজকে ডেকে বলল, এই পাঁচটাকা নে। আর তিন টাকার বাদাম দে।
বাদাম দিয়ে চলে গেল সবুজ। সাব্বির একা একা বাদাম খাচ্ছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে জেরিনের। গালদুটো লাল হয়ে আছে তার। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে।
-সাব্বির, তোমার সাথে আমরা মজা করেছি, র্যাগিং করেছি ওগুলোর তুমি যদি রাগ করে বসে থাকো তাহলে কি আমার খারাপ লাগে না? তোমার কাছে সরি বললাম, তারপরেও...
বাদাম চিবনো শেষ করে সাব্বির বলল, দেখ জেরিন, আমি ওর জন্য তোমার উপর রাগ করে নেই। আমি কারও উপর রাগ করতে পারি না। তুমি হয়তো কোন বড়লোক বাবার মেয়ে। এইজন্য একটা রাস্তার ছেলের ব্যাপারটা তুমি বুঝবে না।
-রাস্তার ছেলে? মানে কী?
-আমার বাবামা কেউ নেই। একচালা একটা টিনের ঘরে একা থাকি। টিউশনি করাই। আর....
নির্বাক বসে রইল জেরিন। বাদামগুলো জেরিনের হাতের উপর দিয়ে উঠে পড়ল সাব্বির। পিছন ফিরে তাকালো না সে। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় দশমিনিট দেরী হয়েছে। টিউশনিটা নিয়মিত না করতে পারলে সমস্যা হয়ে যাবে।
ফাঁকা কলেজে গোলচত্বরে বসে রইল জেরিন। তার হাতে বাদামগুলো। সাব্বির কিছু বাদাম খেয়েছে আর বাকিগুলো খোসা ছাড়িয়ে রেখে দিয়েছে। বাদামওয়ালা ছেলেটা বিটলবণ দেয়নি। কিন্তু এই বাদামগুলোতে লবণের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। ফর্সা গাল বেয়ে পড়া দুফোঁটা অশ্রুওই যথেষ্ট বাদামগুলোকে লবণাক্ত করতে।
কেমিস্ট্রি স্যারের অফিসরুমে ডাকা হয়েছে সাব্বিরকে। স্যারের সামনে যেতে সাব্বিরের একটু ভয় লাগে যদিও স্যার তাকে খুব ভালবাসে।
-স্যার, আসব?
-হ্যাঁ, আসো। তুমি প্রাইভেটে আসো না কেন?
-স্যার, আমার বাড়ি থেকে কলেজে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। আর আসার আগে আমি একটা টিউশনি করাই।
-প্রাইভেটে নিয়মিত না হলে তোমারই ক্ষতি। প্রাইভেটে তোমার কাছ থেকে কোন শিক্ষকই টাকা নিবে না। তবুও কেন আসছ না? তুমি এক কাজ কর, এখানে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাসায় লজিং থাকো।
-ক্ষমা করবেন স্যার। আমি লজিং থাকতে চাচ্ছি না।
-দেখ সাব্বির, তোমার রেজাল্ট ভাল। তোমাকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু তুমি যদি………
স্যারের কথায় বেশ যুক্তি আছে। কিন্তু সাব্বির তার কথায় অনড়। স্যার কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, তোমার আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি, তাই না?
-স্যার, আমার কিছু নেই। রাস্তার ছেলেদের কিছু থাকে না। গরীবের থাকার মধ্যে শুধু আত্মসম্মানটাই থাকে। সেটাও যদি শেষ হয়ে যায়………
-আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যা ভাল বোঝ। তবে কখনো যদি তোমার মন বদলায়, আমাকে বল।
-ঠিক আছে স্যার।
-এখন যাও।
সাব্বির বের হয়ে এলো। আজ বিজ্ঞান বিভাগের সাথে বানিজ্য বিভাগের ফুটবল খেলা। সাব্বিরকেও দলে রাখা হয়েছে। খেলা শুরু হবে এগারোটায় কিন্তু সবাই দশটার সময় মাঠে নেমে গেলো। কলেজের শিক্ষকরাও খেলা দেখবে বলে একাডেমিক ভবনের সামনে চেয়ার এনে স্যারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথাসময়ে খেলা শুরু হল। বেশিরভাগ প্লেয়ারের পায়ে বুট পরা। সাব্বিরের পায়ে বুটজুতো নেই। খালি পায়ে তার খেলতে অবশ্য সমস্যা হয় না। প্রথম দশমিনিটেই একটা পেনাল্টি শট পেলো বিজ্ঞান বিভাগ। দলের অধিনায়ক কাকে দিয়ে পেনাল্টিটা করাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। সাব্বির এগিয়ে এসে বলল, আমি করি?
-দেখ, এটা আমাদের জেতার চান্স। পারবি তুই?
-চেষ্টা করে দেখতে পারি।
বাশি বাজার সাথে সাথে দশ ফুট দূর থেকে দৌড়ে এসে বলে কিক করল সাব্বির। গোলপোস্টের ডান পাশের কোণা দিয়ে গুলির বেগে বল ঢুকে একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় যেখানে বসে ছাত্রীরা খেলা দেখছিল, সেখানে গ্রিলে গিয়ে বল লাগল। গোল করায় সাব্বিরকে কোল্র নিয়ে নাচতে লাগল তার দলের প্লেয়াররা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় হইচইটা অন্যরকম শুনে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটা ছাত্রী অসুস্থ হয়ে গেছে। গ্রিলে হাত ছিল তার, বল গিয়ে আঙ্গুলে লেগে আঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। খবরটা শোনার পর সাব্বিরের মন খারাপ হয়ে গেল। এরকম শট গিয়ে ওভাবে কাউকে আহত করে দিবে তা সে ভাবেনি। একটা ভ্যান ডেকে রোগীকে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রীটা কে এটা খোঁজ নিয়ে জানা গেল ও জেরিন ছিল। শোনার পর নিজের কাছেই অকারণে খুব খারাপ লাগছে সাব্বিরের। কিছুক্ষণ পর ইনজুরির কারণে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল সাব্বির। খেলায় ২-১ গোলে বিজ্ঞান বিভাগের জয় হল। খেলা শেষ হতেই সাব্বির গেল ক্লিনিকে। কিন্তু তার আগেই জেরিনকে বাসায় নিয়ে গেছে। মন খারাপ করে সেদিন বাড়ি চলে গেল সাব্বির। তারপর থেকে বেশকিছুদিন সে নিখোঁজ। আর সাব্বিরের নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোনভাবেই তার খোঁজ নেওয়া যায় না।
প্রায় দশদিন পর আবার কলেজে এসেছে সাব্বির। শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। গায়ের রংটাও আগের চেয়ে কালচে হয়ে গেছে। চোখ অক্ষিকোটরের অনেক ভিতরে। দেখে বোঝা যায়, অনেক বড় ধকল গেছে তার।
বন্ধুরা সবাই ঘিরে ধরেছে সাব্বিরকে।
-কিরে? তোর এই অবস্থা কেন? আমরা তো ভেবেছিলাম, আবারও নতুন লুকে তোকে দেখব। কী হয়েছিল তোর?
-জন্ডিস।
ছেলেদের সাথে কথা বলার সময় এদিকওদিক কিছু খুঁজছে সে।
বাপ্পি বলল, কী খুঁজিস?
-কিছু না।
-কিছু একটা তো বটেই।
-আরে নাহ।
বাপ্পি আর কথা বাড়ালো না। এক ফাঁকে শুধু বলল, তোর সাথে কিছু কথা আছে। পরে বলব।
বারোটার দিকে বায়োলজি ক্লাস থেকে বের হয়ে সাব্বিরকে একা পেয়ে বাপ্পি বলল, তোকে দেখা করতে বলেছে।
-কে?
-যাকে তখন খুঁজছিলি।
-আমি কাউকে খুঁজি নাই।
-তোর চোখেমুখে মিথ্যা ভেসে উঠছে। যাইহোক, এটা তোর।
-কী এটা?
-চিঠি।
-কে দিয়েছে?
-খুলে দেখ।
সাব্বির অনাগ্রহের সাথে চিঠিটা খুলল। তাতে গোটাগোটা হাতে লেখা, দেখতে এলে খুশি হব।-জেরিন।
নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে সাব্বিরের। বাপ্পিকে বলল, চল, সবাই মিলে ওকে দেখে আসি।
-চিঠিটা সবাইকে দেয়নি। তোকে দিয়েছে। আর সবাই ওকে দেখে এসেছে।
-অন্তত তুই আমার সাথে চল।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
-ওকে দেখতে গেলে কিছু নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নাই।
-আরে, কিছু নেওয়া লাগবে না।
-নাহ। অসুস্থ কাউকে দেখতে গেলে ফলমূল নেওয়া উচিৎ। আমাকে একশো টাকা ধার দে।
বাপ্পির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু আপেল কিনে বাপ্পিকে সাথে নিয়েই জেরিনকে দেখতে গেল সাব্বির।
চলবে.....
তবুও পর্ব-০২
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:37 PM
Rating:

No comments