তবুও পর্ব-০৩
গল্প- তবুও
গাছপালায় ঘেরা একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে শান্তিশান্তি ভাব আসে। কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে সাব্বির। জেরিনদের বাসায় ঢোকার আগেই হোচট খেয়ে সাব্বিরের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল।
জেরিন টিভি দেখছিল। সেই উঠে এসে দরজা খুলে প্রথমে অবাক হলেও কিছুটা অভিমান করে বলল, তাহলে আমাকে দেখতে আসার সময় হল?
-না, মানে আমি একটু সমস্যায় ছিলাম।
-বসো।
ওদেরকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জেরিন চলে গেল ঘরে। বাপ্পি ফিসফাস করে কোন ঠাট্টা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাব্বির তা বোঝার ও শোনার চেষ্টা করছে না। তার দৃষ্টি সিঁড়ির কাছে পড়ে থাকা তার ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়ার দিকে।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে একটা ট্রেতে শরবত, আপেল কাটা, চানাচুর, বিস্কিট নিয়ে জেরিন এলো। সে এর মধ্যে একটু সাজগোজও করেছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, চোখে কাজল দিয়েছে। জেরিনের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কনেদেখার উদ্দেশ্যে সাব্বির ওদের বাসায় এসেছে। বাপ্পি মাঝেমাঝে ঠোঁট টিপে হাসছে। জেরিনকে বলল, তোরা কথা বল। আমি আন্টির সাথে কথা বলে আসি।
সাব্বিরকে রেখে উঠে গেল বাপ্পি। জেরিন শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও।
ঢকঢক করে এক নিমিষে শেষ করে দেখে জেরিন তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পেরে সাব্বির বলল, খুব পিপাসা লেগেছিল তো, তাই শরবতটা এক ঢোকে খেয়ে ফেললাম। আর অনেক মিষ্টি হয়েছে।
-আর দিব?
-না। থাক।
-ওগুলো খাও।
সাব্বির চানাচুরের পিরিচটা হাতে নিয়ে একটা একটা বাদাম খুঁজে খেতে খেতে কথা বলছে। জেরিন জিজ্ঞেস করল, সবাই আমাকে দেখতে এসেছিল, তুমি আসো নাই কেন?
-আসলে আমি ঝামেলায় ছিলাম।
-কী ঝামেলা?
মিথ্যা বলে লুকাতে পারে না সাব্বির। আমতাআমতা করে বলল, ঝামেলা না। অসুস্থ ছিলাম। জন্ডিস হয়েছিল।
-ও। খুব আশা করেছিলাম তুমি দেখতে আসবে।
-আমার কারণেই তোমার এক্সিডেন্টটা হল।
-আরে নাহ। সেরকম কিছু না। সেরে গেছে তো। কাল থেকে কলেজে যাবো।
-এর আগেরদিন আমার কারণে তোমার হাত কাটল, সেদিন আঙ্গুল ভাঙ্গল।
-বাদ দাও। তুমি তো ইচ্ছা করে করনি। তোমার শরীর তো অনেক খারাপ হয়ে গেছে।
-জন্ডিস তেমন কিছু না। সেরে গেছে।
চানাচুরের পিরিচ রেখে আপেল খেতে লাগল সাব্বির। আপেলে কামড় দিতেই জেরিন বলল, তোমাকে বিশেষ কিছু কথা বলব সাব্বির।
-হ্যাঁ, বল।
-দেখ, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি, হাবাগোবা টাইপ একটা আনস্মার্ট ছেলে ভেবেছিলাম। তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি। কিন্তু যেদিন তুমি আমাকে ডেকে কলম ছুঁড়ে মেরেছিলে, সেদিন...
-আমি তোমাকে বাঁচাতে ওটা করেছিলাম। ছাদ খসে পড়ছিল ঠিক তোমার উপর।
-জানি। এই কারণে সেদিন তোমার উপর আমার ধারণাটা পাল্টে যায়। আমার মনে হয়, তোমার উপর ভরসা করা যায়। তুমি এমন একজন যে আমার উপর খেয়াল রাখতে পারবে।
-কী বলতে চাচ্ছ, সরাসরি বল।
-একচুয়ালি, আমি তোমাকে লাইক... মানে... আমি তোমাকে 'আই লাভ ইউ'
লজ্জায় লাল হয়ে গেছে জেরিনের মুখ। জিহ্বায় কামড় দিয়ে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। সাব্বির আধখাওয়া আপেলের টুকরাটা রেখে উঠে পড়ল। বাপ্পিকে না ডেকেই একা একা বের হয়ে গেল জেরিনের বাড়ি থেকে। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল জেরিন। খালি পায়ে হনহন করে চলে যাচ্ছে সাব্বির।
বাপ্পি এসে দেখে সাব্বির নেই।
-ও কই গেল?
-ওর জরুরী কাজ আছে। তাই চলে গেল।
জেরিনের মুখটা ভার হয়ে আছে। কথা কেমনযেন জড়িয়ে যাচ্ছে। বাপ্পি কিছুটা বুঝতে পেরে বলল, আচ্ছা। আমি যাচ্ছি। তুই কাল কলেজে আসছিস তো?
জেরিন উত্তর দিল না।
সাব্বিরের ফেলে যাওয়া ছেঁড়া স্যান্ডেলজোড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে জেরিন। এই মেয়ের চোখে সম্ভবত শ্রাবণের মেঘ। অল্পতেই ঝরতে শুরু করে।
ভ্যান থেকে নেমেই গেট দিয়ে কলেজে ঢুকতেই মুখোমুখি দেখা হল জেরিনের সাথে সাব্বিরের। এক মুহূর্তের জন্য দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টির ভাষা বোঝার ক্ষমতা এই পৃথিবীর কারোর নেই। জেরিন কিছু বলার জন্য মুখটা খোলার আগেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল সাব্বির।
কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস চলছে। সবাই বিভিন্ন কেমিক্যাল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। যারা বুঝতে পারছে না, স্যার বুঝাচ্ছেন অথবা যে বোঝে, তাকে বলছেন বুঝিয়ে দিতে। জেরিন ক্লাসে থাকলেও সে ক্লাস করছে না। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু করছ না কেন, জেরিন?
-স্যার, আমার হাত কাটা। কেমিক্যাল হাতে লাগলে জ্বলতে পারে। এইজন্য... স্যার, আপনি একটু বুঝিয়ে দেন, পরের ক্লাসে প্র্যাক্টিক্যাল করে নিব।
স্যার সাব্বিরকে ডেকে বললেন, তুমি জেরিনকে ওই এক্সপেরিমেন্টটা বুঝিয়ে দাও।
স্যারের কথা অমান্য করা যায় না। আর স্যার এটা জানেন যে সাব্বির খুব ভাল বুঝাতে পারে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাব্বির জেরিনের কাছে এসে খাতা নিয়ে লিখতে লাগল 'সালফিউরিক এসিডের সাথে পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের বিক্রিয়ার ফলে.....'
আড়চোখে জেরিনের দিকে তাকিয়ে দেখে জেরিনের দৃষ্টি খাতার দিকে নেই, সাব্বিরের চোখের দিকে। অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সাব্বিরের। সে খাতা রেখে স্যারকে বলল, স্যার কেমিক্যাল এর গন্ধে আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
স্যার সত্যমিথ্যা যাচাই করলেন না। করলে হয়তো বুঝতেন, এই ছেলেটার মন কতটা শক্ত।
জেরিন বুঝেছিল। সে এটাও বুঝেছিল সাব্বির হয়তো তাকে পছন্দ করে। কিন্তু সেই বুঝটা সত্য হয়নি। তা না হলে সেদিন ওভাবে জেরিনদের বাড়ি থেকে চলে আসত না।
ক্লাস শেষ করার পর সাব্বির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল, তার সাইকেলের পিছনের চাকায় হাওয়া নেই। সামনের গ্যারেজ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সাইকেল নিয়ে হাঁটা ধরল সে। কলেজ গেটের বাইরে এসে দেখে জেরিন দাঁড়ানো। সাব্বিরকে দেখে তার পাশে এসে হাঁটতে লাগল। দুজন কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। তাদের ভাব দেখে মনে হয় কোন নির্বাক চলচ্চিত্র হচ্ছে।
বেশ কিছুদূর আসার পর একটা ফাঁকা জায়গায় গাছের নিচে দাঁড়ালো তারা। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বলবে?
সাব্বিরের রুক্ষ কণ্ঠস্বর শুনে জেরিন বলল, না, কিছু বলব না।
-আমি কিছু বলব।
-বল।
-তুমি আমার সাথে এমন করছ কেন? তুমি কি চাও যে আমি কলেজ ছাড়ি? আমার লেখাপড়া বন্ধ হোক? দেখ জেরিন, পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নাই। আমার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়। আমার এখান থেকে দুপুরের খাওয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আর তুমি? তোমার চিন্তাভাবনা থাকে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, ফুচকা-চটপটি খাওয়া, জন্মদিনে পার্টি করা। তুমি কোনদিন হয়তো না খেয়ে থাকার অনুভূতিটা বুঝবে। এবং দোয়া করি, তোমার যেন সেটা বুঝতে না হয়।
এতটুকু বলে লম্বা নিঃশ্বাস নিল সাব্বির। জেরিন তাকে জিজ্ঞেস করল, বলা শেষ?
-হ্যাঁ।
-তোমার সাইকেল সারাবে না?
-হুম।
-গ্যারেজ পর্যন্ত তোমার সাথে হাঁটতে পারি?
কিছুকিছু আবদারে সম্মতি না দিলে নিজেকে দোষী মনে হয়। জেরিনের এই আবদারটা ঠিক সেরকম। হ্যাঁ বা না কোনটাই বলল না সাব্বির। দুজনে আবার নির্বাক হেঁটে যাচ্ছে। সাইকেল ঠিক করানোর সময় রাস্তার পাশে একা দাঁড়িয়ে রইল জেরিন। গ্যারেজের পাশের চায়ের দোকানে বেশকিছু উৎসুক লোকজন তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাইকেল ঠিক করার পর সাব্বির বলল, এখন বাসায় যাও। তোমার মা-বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এই কথাটা বলার সময় সাব্বিরের গলা আটকে যাচ্ছিল। সাব্বির সাইকেলে উঠতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে জেরিন পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, একটা কথা শুনে যাও।
দাঁড়িয়ে পড়ল সাব্বির। কাছে এসে জেরিন বলল, আমি চাইনা তোমার কোন ক্ষতি হোক। শুধু একটা কথা বলার অনুমতি দাও।
-কী?
-আমি তোমাকে সত্যিই অনেক ভালবাসি সাব্বির।
সাব্বিরের এবার সত্যি সত্যি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই কথা না বাড়িয়ে সাব্বির সাইকেলে উঠে টান দিল, একবারও পিছন ফিরে তাকালো না।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। ছুটির আগেই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষা মোটামুটি হয়েছে সাব্বিরের। পরীক্ষার ভাবনার চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে পেটের চিন্তা করে। ছুটিটাও পেটের চিন্তায় উপভোগ করছে সে।
মফস্বলের বাজারে কিছু কেনাকাটা করত্র এসেছিল জেরিন, তনু আর রুমকি। কেনাকাটা শেষ করে তনু এবং রুমকি তাদের বাসায় চলে গেল। প্রখর রোদে বাসা পর্যন্ত হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে না জেরিনের। অল্প পথ, তবুও ভ্যানের জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর বর্তমানের ভ্যানচালকদের ভাবভঙ্গিতে জমিদারী ফুটে উঠেছে। একটা যাত্রী নিয়ে আসা ভ্যান আসতে দেখে হাতের ইশারায় থামিয়ে জেরিন বলল, থানার সামনে নামব।
পিছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে জেরিন। ছোটবেলা থেকে জেরিনের বদভ্যাস, ভ্যানের পিছনে বসে পা দোলানো। এই বয়সেও এই অভ্যাসটা ছাড়েনি বরং সুযোগ পেলে অভ্যাসটা সুন্দরভাবে চর্চা করে। পা দোলানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই থানার সামনে আসতেই ব্রেক কষল ভ্যানটা।
নেমে ব্যাগ থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে ভ্যানচালককে দিয়ে শপিংয়ের ব্যাগগুলো নামাতে নামাতে বলল, পাঁচ টাকা ফেরত দাও।
ভ্যানচালক পাঁচটাকার নোটটা হাতে নিয়ে ভ্যানের সিটের উপর বসে আছে। জেরিন টাকাটা নিতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো। ভ্যানচালক আর কেউ নয়, সাব্বির। হাত থেকে ব্যাগপত্র পড়ে গেল জেরিনের। সিট থেকে নেমে টাকাটা জেরিনের হাতে ধরিয়ে জোরে ভ্যান টেনে চলে গেল সাব্বির। এখান থেকে বাসায় পৌঁছতে ত্রিশ সেকেন্ড হাঁটা লাগে। কিন্তু জেরিনের সেই শক্তিটুকু নেই যে হেঁটে বাসায় যাবে। রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাস্তার অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে জেরিনের দিকে। সেদিকে জেরিনের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখের সামনে একটা ঘর্মাক্ত মুখ ভাসছে, মাথায় গামছাবাঁধা।
তনুদের বাসায় বসে আছে জেরিন। তনু সিঙ্গাপুরে তার খালার সাথে ফোনে কথা বলছে। পাঁচ মিনিটের কথা বলে প্রায় পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল, তনুর ফোন রাখার নাম নেই। তনুদের বাসায় তার মা, বোন সবাই আছে। জেরিন একা তনুর ঘরে।
-সরি রে, খালা ফোন রাখতেই চাচ্ছিল না।
-খালার দোষ দিচ্ছিস কেন? তোকেই দেখলাম হাঁসের ডিম দেওয়ার গল্পটা দশ মিনিট ধরে বলছিস।
-চা খাবি?
-এই গরমে চা খাবো না। পারলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়া।
-আচ্ছা। এক মিনিট।
-এবার কি এক ঘণ্টায় তোর এক মিনিট হবে?
উত্তর না দিয়ে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে নিয়ে এলো তনু।
এক ঢোকে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে জেরিন বলল, দরজাটা চাপিয়ে দে।
-ক্যান? বিশেষ কিছু দেখাবি নাকি?
-ধুর। মনমেজাজ ভাল নেই। ফাজলামো করিস না তো। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বোস।
কম্পিউটারে তনু গান ছেড়ে পরিবেশটাকে আরও রোমাঞ্চকর করার চেষ্টা করছে। তনুর খুবই প্রিয় একটা গান বাজছে। চিত্রা সিংয়ের গান।
মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনী ঘোরে
নয়নো দুটি ঘুমে জড়াতে
নিশি রাতে কে গান শোনাতো...
গান পুরোটা শেষ হলেই জেরিন বলা শুরু করল, তনু, আমি ভাল নেইরে।
-ক্যান? কী হয়েছে?
-তুই বুঝতে পেরেছিস কি না জানি না, তোর সাথে সেদিন রাগ করার কারণটা ছিল সাব্বির।
-হ্যাঁ, তো?
-আমি সাব্বিরকে ভালবাসি।
-ওএমজি। কবে থেকে?
-জানি না। তবে আমি ওর প্রতি আসলেই খুবই দুর্বল।
-এখন কী অবস্থা? ওকে বলেছিস?
-হ্যাঁ।
-তলেতলে এত কিছু! আর আমরা কিছু জানি না।
-দ্যাখ, এখন ফাজলামো করার টাইম না।
-ও কী বলেছে?
-ও না করে দিয়েছে।
-কী?
তনু চিৎকার করে উঠল। পাশের ঘর থেকে ওর ছোটবোন দৌড়ে এসে বলল, আপু কী হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছ কেন?
-যা তুই! পাকামি করতে আসছে।
তনুর পিচ্চি বোনটা চলে যেতেই গলার স্বরটা নামিয়ে তনু বলল, ও তোকে না করেছে?
-হ্যাঁ।
-ও এত ভাব নেয় ক্যান? ওর কিসের এতো অহংকার? দুইটাকার দাম নেই...
-প্লিজ, তনু। এভাবে বলিস না।
-আমার খুব রাগ হচ্ছে।
-তুই রাগ হচ্ছিস কেন?
-আরে, তোর মত মেয়েকে না করার মত কোন কারণ আছে?
-তুই পুরো ব্যাপারটা না শুনে শুধুশুধু মেজাজ গরম করছিস। আগে সবকিছু শোন।
-আচ্ছা, বল।
-ওর কেউ নেই। ওকেই ওর জীবিকার জন্য কাজ করতে হয়। ও কী কাজ করর জানিস?
-কী?
-ভ্যান চালায়।
এবার তনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
অভিভাবকদের মত ভাব নিয়ে বলল, জেরিন, অনেক হয়েছে। এই ব্যাপারে আর আগানোই ভাল হবে। তুই ফ্যান্টাসির মধ্যে আছিস। একটু বাস্তবে ফিরে আয়। এটা কখনো সম্ভব না। তোর লাইফটা...
কথাটা শেষ করার আগেই তনুকে জড়িয়ে ধরে জেরিন হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।
-তনু, আমি ওকে ছাড়া বাঁচব নারে। আমি অনেক ভেবেছি। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। বাস্তবতা অনেক কঠিন কিন্তু আমি আর ফিরতে পারব না।
জেরিনের অশ্রুতে তনুর কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। জেরিনের হেঁচকি উঠছে। ওকে ছাড়িয়ে আরেক গ্লাস পানি এনে দিয়ে জোরে গান ছাড়ল যাতে ওপাশের ঘর থেকে কেউ না শোনে তাহলে ব্যাপারটা অনেক দূর চলে যাবে।
অনেকক্ষণ ভেবে তনু বলল, আচ্ছা। আমি ভেবে দেখি, কী করা যায়?
চলবে......
গাছপালায় ঘেরা একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে শান্তিশান্তি ভাব আসে। কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে সাব্বির। জেরিনদের বাসায় ঢোকার আগেই হোচট খেয়ে সাব্বিরের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল।
জেরিন টিভি দেখছিল। সেই উঠে এসে দরজা খুলে প্রথমে অবাক হলেও কিছুটা অভিমান করে বলল, তাহলে আমাকে দেখতে আসার সময় হল?
-না, মানে আমি একটু সমস্যায় ছিলাম।
-বসো।
ওদেরকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জেরিন চলে গেল ঘরে। বাপ্পি ফিসফাস করে কোন ঠাট্টা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাব্বির তা বোঝার ও শোনার চেষ্টা করছে না। তার দৃষ্টি সিঁড়ির কাছে পড়ে থাকা তার ছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়ার দিকে।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে একটা ট্রেতে শরবত, আপেল কাটা, চানাচুর, বিস্কিট নিয়ে জেরিন এলো। সে এর মধ্যে একটু সাজগোজও করেছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, চোখে কাজল দিয়েছে। জেরিনের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কনেদেখার উদ্দেশ্যে সাব্বির ওদের বাসায় এসেছে। বাপ্পি মাঝেমাঝে ঠোঁট টিপে হাসছে। জেরিনকে বলল, তোরা কথা বল। আমি আন্টির সাথে কথা বলে আসি।
সাব্বিরকে রেখে উঠে গেল বাপ্পি। জেরিন শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও।
ঢকঢক করে এক নিমিষে শেষ করে দেখে জেরিন তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পেরে সাব্বির বলল, খুব পিপাসা লেগেছিল তো, তাই শরবতটা এক ঢোকে খেয়ে ফেললাম। আর অনেক মিষ্টি হয়েছে।
-আর দিব?
-না। থাক।
-ওগুলো খাও।
সাব্বির চানাচুরের পিরিচটা হাতে নিয়ে একটা একটা বাদাম খুঁজে খেতে খেতে কথা বলছে। জেরিন জিজ্ঞেস করল, সবাই আমাকে দেখতে এসেছিল, তুমি আসো নাই কেন?
-আসলে আমি ঝামেলায় ছিলাম।
-কী ঝামেলা?
মিথ্যা বলে লুকাতে পারে না সাব্বির। আমতাআমতা করে বলল, ঝামেলা না। অসুস্থ ছিলাম। জন্ডিস হয়েছিল।
-ও। খুব আশা করেছিলাম তুমি দেখতে আসবে।
-আমার কারণেই তোমার এক্সিডেন্টটা হল।
-আরে নাহ। সেরকম কিছু না। সেরে গেছে তো। কাল থেকে কলেজে যাবো।
-এর আগেরদিন আমার কারণে তোমার হাত কাটল, সেদিন আঙ্গুল ভাঙ্গল।
-বাদ দাও। তুমি তো ইচ্ছা করে করনি। তোমার শরীর তো অনেক খারাপ হয়ে গেছে।
-জন্ডিস তেমন কিছু না। সেরে গেছে।
চানাচুরের পিরিচ রেখে আপেল খেতে লাগল সাব্বির। আপেলে কামড় দিতেই জেরিন বলল, তোমাকে বিশেষ কিছু কথা বলব সাব্বির।
-হ্যাঁ, বল।
-দেখ, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি, হাবাগোবা টাইপ একটা আনস্মার্ট ছেলে ভেবেছিলাম। তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি। কিন্তু যেদিন তুমি আমাকে ডেকে কলম ছুঁড়ে মেরেছিলে, সেদিন...
-আমি তোমাকে বাঁচাতে ওটা করেছিলাম। ছাদ খসে পড়ছিল ঠিক তোমার উপর।
-জানি। এই কারণে সেদিন তোমার উপর আমার ধারণাটা পাল্টে যায়। আমার মনে হয়, তোমার উপর ভরসা করা যায়। তুমি এমন একজন যে আমার উপর খেয়াল রাখতে পারবে।
-কী বলতে চাচ্ছ, সরাসরি বল।
-একচুয়ালি, আমি তোমাকে লাইক... মানে... আমি তোমাকে 'আই লাভ ইউ'
লজ্জায় লাল হয়ে গেছে জেরিনের মুখ। জিহ্বায় কামড় দিয়ে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। সাব্বির আধখাওয়া আপেলের টুকরাটা রেখে উঠে পড়ল। বাপ্পিকে না ডেকেই একা একা বের হয়ে গেল জেরিনের বাড়ি থেকে। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল জেরিন। খালি পায়ে হনহন করে চলে যাচ্ছে সাব্বির।
বাপ্পি এসে দেখে সাব্বির নেই।
-ও কই গেল?
-ওর জরুরী কাজ আছে। তাই চলে গেল।
জেরিনের মুখটা ভার হয়ে আছে। কথা কেমনযেন জড়িয়ে যাচ্ছে। বাপ্পি কিছুটা বুঝতে পেরে বলল, আচ্ছা। আমি যাচ্ছি। তুই কাল কলেজে আসছিস তো?
জেরিন উত্তর দিল না।
সাব্বিরের ফেলে যাওয়া ছেঁড়া স্যান্ডেলজোড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে জেরিন। এই মেয়ের চোখে সম্ভবত শ্রাবণের মেঘ। অল্পতেই ঝরতে শুরু করে।
ভ্যান থেকে নেমেই গেট দিয়ে কলেজে ঢুকতেই মুখোমুখি দেখা হল জেরিনের সাথে সাব্বিরের। এক মুহূর্তের জন্য দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টির ভাষা বোঝার ক্ষমতা এই পৃথিবীর কারোর নেই। জেরিন কিছু বলার জন্য মুখটা খোলার আগেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল সাব্বির।
কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস চলছে। সবাই বিভিন্ন কেমিক্যাল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। যারা বুঝতে পারছে না, স্যার বুঝাচ্ছেন অথবা যে বোঝে, তাকে বলছেন বুঝিয়ে দিতে। জেরিন ক্লাসে থাকলেও সে ক্লাস করছে না। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু করছ না কেন, জেরিন?
-স্যার, আমার হাত কাটা। কেমিক্যাল হাতে লাগলে জ্বলতে পারে। এইজন্য... স্যার, আপনি একটু বুঝিয়ে দেন, পরের ক্লাসে প্র্যাক্টিক্যাল করে নিব।
স্যার সাব্বিরকে ডেকে বললেন, তুমি জেরিনকে ওই এক্সপেরিমেন্টটা বুঝিয়ে দাও।
স্যারের কথা অমান্য করা যায় না। আর স্যার এটা জানেন যে সাব্বির খুব ভাল বুঝাতে পারে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাব্বির জেরিনের কাছে এসে খাতা নিয়ে লিখতে লাগল 'সালফিউরিক এসিডের সাথে পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের বিক্রিয়ার ফলে.....'
আড়চোখে জেরিনের দিকে তাকিয়ে দেখে জেরিনের দৃষ্টি খাতার দিকে নেই, সাব্বিরের চোখের দিকে। অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সাব্বিরের। সে খাতা রেখে স্যারকে বলল, স্যার কেমিক্যাল এর গন্ধে আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
স্যার সত্যমিথ্যা যাচাই করলেন না। করলে হয়তো বুঝতেন, এই ছেলেটার মন কতটা শক্ত।
জেরিন বুঝেছিল। সে এটাও বুঝেছিল সাব্বির হয়তো তাকে পছন্দ করে। কিন্তু সেই বুঝটা সত্য হয়নি। তা না হলে সেদিন ওভাবে জেরিনদের বাড়ি থেকে চলে আসত না।
ক্লাস শেষ করার পর সাব্বির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল, তার সাইকেলের পিছনের চাকায় হাওয়া নেই। সামনের গ্যারেজ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সাইকেল নিয়ে হাঁটা ধরল সে। কলেজ গেটের বাইরে এসে দেখে জেরিন দাঁড়ানো। সাব্বিরকে দেখে তার পাশে এসে হাঁটতে লাগল। দুজন কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। তাদের ভাব দেখে মনে হয় কোন নির্বাক চলচ্চিত্র হচ্ছে।
বেশ কিছুদূর আসার পর একটা ফাঁকা জায়গায় গাছের নিচে দাঁড়ালো তারা। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বলবে?
সাব্বিরের রুক্ষ কণ্ঠস্বর শুনে জেরিন বলল, না, কিছু বলব না।
-আমি কিছু বলব।
-বল।
-তুমি আমার সাথে এমন করছ কেন? তুমি কি চাও যে আমি কলেজ ছাড়ি? আমার লেখাপড়া বন্ধ হোক? দেখ জেরিন, পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নাই। আমার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়। আমার এখান থেকে দুপুরের খাওয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আর তুমি? তোমার চিন্তাভাবনা থাকে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, ফুচকা-চটপটি খাওয়া, জন্মদিনে পার্টি করা। তুমি কোনদিন হয়তো না খেয়ে থাকার অনুভূতিটা বুঝবে। এবং দোয়া করি, তোমার যেন সেটা বুঝতে না হয়।
এতটুকু বলে লম্বা নিঃশ্বাস নিল সাব্বির। জেরিন তাকে জিজ্ঞেস করল, বলা শেষ?
-হ্যাঁ।
-তোমার সাইকেল সারাবে না?
-হুম।
-গ্যারেজ পর্যন্ত তোমার সাথে হাঁটতে পারি?
কিছুকিছু আবদারে সম্মতি না দিলে নিজেকে দোষী মনে হয়। জেরিনের এই আবদারটা ঠিক সেরকম। হ্যাঁ বা না কোনটাই বলল না সাব্বির। দুজনে আবার নির্বাক হেঁটে যাচ্ছে। সাইকেল ঠিক করানোর সময় রাস্তার পাশে একা দাঁড়িয়ে রইল জেরিন। গ্যারেজের পাশের চায়ের দোকানে বেশকিছু উৎসুক লোকজন তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাইকেল ঠিক করার পর সাব্বির বলল, এখন বাসায় যাও। তোমার মা-বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এই কথাটা বলার সময় সাব্বিরের গলা আটকে যাচ্ছিল। সাব্বির সাইকেলে উঠতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে জেরিন পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, একটা কথা শুনে যাও।
দাঁড়িয়ে পড়ল সাব্বির। কাছে এসে জেরিন বলল, আমি চাইনা তোমার কোন ক্ষতি হোক। শুধু একটা কথা বলার অনুমতি দাও।
-কী?
-আমি তোমাকে সত্যিই অনেক ভালবাসি সাব্বির।
সাব্বিরের এবার সত্যি সত্যি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই কথা না বাড়িয়ে সাব্বির সাইকেলে উঠে টান দিল, একবারও পিছন ফিরে তাকালো না।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। ছুটির আগেই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষা মোটামুটি হয়েছে সাব্বিরের। পরীক্ষার ভাবনার চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে পেটের চিন্তা করে। ছুটিটাও পেটের চিন্তায় উপভোগ করছে সে।
মফস্বলের বাজারে কিছু কেনাকাটা করত্র এসেছিল জেরিন, তনু আর রুমকি। কেনাকাটা শেষ করে তনু এবং রুমকি তাদের বাসায় চলে গেল। প্রখর রোদে বাসা পর্যন্ত হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে না জেরিনের। অল্প পথ, তবুও ভ্যানের জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর বর্তমানের ভ্যানচালকদের ভাবভঙ্গিতে জমিদারী ফুটে উঠেছে। একটা যাত্রী নিয়ে আসা ভ্যান আসতে দেখে হাতের ইশারায় থামিয়ে জেরিন বলল, থানার সামনে নামব।
পিছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে জেরিন। ছোটবেলা থেকে জেরিনের বদভ্যাস, ভ্যানের পিছনে বসে পা দোলানো। এই বয়সেও এই অভ্যাসটা ছাড়েনি বরং সুযোগ পেলে অভ্যাসটা সুন্দরভাবে চর্চা করে। পা দোলানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই থানার সামনে আসতেই ব্রেক কষল ভ্যানটা।
নেমে ব্যাগ থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে ভ্যানচালককে দিয়ে শপিংয়ের ব্যাগগুলো নামাতে নামাতে বলল, পাঁচ টাকা ফেরত দাও।
ভ্যানচালক পাঁচটাকার নোটটা হাতে নিয়ে ভ্যানের সিটের উপর বসে আছে। জেরিন টাকাটা নিতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো। ভ্যানচালক আর কেউ নয়, সাব্বির। হাত থেকে ব্যাগপত্র পড়ে গেল জেরিনের। সিট থেকে নেমে টাকাটা জেরিনের হাতে ধরিয়ে জোরে ভ্যান টেনে চলে গেল সাব্বির। এখান থেকে বাসায় পৌঁছতে ত্রিশ সেকেন্ড হাঁটা লাগে। কিন্তু জেরিনের সেই শক্তিটুকু নেই যে হেঁটে বাসায় যাবে। রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাস্তার অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে জেরিনের দিকে। সেদিকে জেরিনের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখের সামনে একটা ঘর্মাক্ত মুখ ভাসছে, মাথায় গামছাবাঁধা।
তনুদের বাসায় বসে আছে জেরিন। তনু সিঙ্গাপুরে তার খালার সাথে ফোনে কথা বলছে। পাঁচ মিনিটের কথা বলে প্রায় পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল, তনুর ফোন রাখার নাম নেই। তনুদের বাসায় তার মা, বোন সবাই আছে। জেরিন একা তনুর ঘরে।
-সরি রে, খালা ফোন রাখতেই চাচ্ছিল না।
-খালার দোষ দিচ্ছিস কেন? তোকেই দেখলাম হাঁসের ডিম দেওয়ার গল্পটা দশ মিনিট ধরে বলছিস।
-চা খাবি?
-এই গরমে চা খাবো না। পারলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়া।
-আচ্ছা। এক মিনিট।
-এবার কি এক ঘণ্টায় তোর এক মিনিট হবে?
উত্তর না দিয়ে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে নিয়ে এলো তনু।
এক ঢোকে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে জেরিন বলল, দরজাটা চাপিয়ে দে।
-ক্যান? বিশেষ কিছু দেখাবি নাকি?
-ধুর। মনমেজাজ ভাল নেই। ফাজলামো করিস না তো। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বোস।
কম্পিউটারে তনু গান ছেড়ে পরিবেশটাকে আরও রোমাঞ্চকর করার চেষ্টা করছে। তনুর খুবই প্রিয় একটা গান বাজছে। চিত্রা সিংয়ের গান।
মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনী ঘোরে
নয়নো দুটি ঘুমে জড়াতে
নিশি রাতে কে গান শোনাতো...
গান পুরোটা শেষ হলেই জেরিন বলা শুরু করল, তনু, আমি ভাল নেইরে।
-ক্যান? কী হয়েছে?
-তুই বুঝতে পেরেছিস কি না জানি না, তোর সাথে সেদিন রাগ করার কারণটা ছিল সাব্বির।
-হ্যাঁ, তো?
-আমি সাব্বিরকে ভালবাসি।
-ওএমজি। কবে থেকে?
-জানি না। তবে আমি ওর প্রতি আসলেই খুবই দুর্বল।
-এখন কী অবস্থা? ওকে বলেছিস?
-হ্যাঁ।
-তলেতলে এত কিছু! আর আমরা কিছু জানি না।
-দ্যাখ, এখন ফাজলামো করার টাইম না।
-ও কী বলেছে?
-ও না করে দিয়েছে।
-কী?
তনু চিৎকার করে উঠল। পাশের ঘর থেকে ওর ছোটবোন দৌড়ে এসে বলল, আপু কী হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছ কেন?
-যা তুই! পাকামি করতে আসছে।
তনুর পিচ্চি বোনটা চলে যেতেই গলার স্বরটা নামিয়ে তনু বলল, ও তোকে না করেছে?
-হ্যাঁ।
-ও এত ভাব নেয় ক্যান? ওর কিসের এতো অহংকার? দুইটাকার দাম নেই...
-প্লিজ, তনু। এভাবে বলিস না।
-আমার খুব রাগ হচ্ছে।
-তুই রাগ হচ্ছিস কেন?
-আরে, তোর মত মেয়েকে না করার মত কোন কারণ আছে?
-তুই পুরো ব্যাপারটা না শুনে শুধুশুধু মেজাজ গরম করছিস। আগে সবকিছু শোন।
-আচ্ছা, বল।
-ওর কেউ নেই। ওকেই ওর জীবিকার জন্য কাজ করতে হয়। ও কী কাজ করর জানিস?
-কী?
-ভ্যান চালায়।
এবার তনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
অভিভাবকদের মত ভাব নিয়ে বলল, জেরিন, অনেক হয়েছে। এই ব্যাপারে আর আগানোই ভাল হবে। তুই ফ্যান্টাসির মধ্যে আছিস। একটু বাস্তবে ফিরে আয়। এটা কখনো সম্ভব না। তোর লাইফটা...
কথাটা শেষ করার আগেই তনুকে জড়িয়ে ধরে জেরিন হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।
-তনু, আমি ওকে ছাড়া বাঁচব নারে। আমি অনেক ভেবেছি। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। বাস্তবতা অনেক কঠিন কিন্তু আমি আর ফিরতে পারব না।
জেরিনের অশ্রুতে তনুর কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। জেরিনের হেঁচকি উঠছে। ওকে ছাড়িয়ে আরেক গ্লাস পানি এনে দিয়ে জোরে গান ছাড়ল যাতে ওপাশের ঘর থেকে কেউ না শোনে তাহলে ব্যাপারটা অনেক দূর চলে যাবে।
অনেকক্ষণ ভেবে তনু বলল, আচ্ছা। আমি ভেবে দেখি, কী করা যায়?
চলবে......
তবুও পর্ব-০৩
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
3:38 PM
Rating:

No comments