বউনামা! পর্ব-১৩
![]() |
Add caption |
#বউনামা_১৩
(১)
সাধারণ একটা পুরুষ আর বাবা হয়ে যাওয়া পুরুষের মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আপনি যতটাই খেয়ালী পুরুষ হন না কেন, বাবা হওয়ার সাথে সাথেই আপনাকে হয়ে যেতে হবে ভীষন রকম দায়িত্বশীল, সেইসাথে ম্যাচিউরড! এই দুটি গুণ অর্জন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি আমিও। আমি মেয়ের জন্মের পরপরই হুড়হুড় করে বাজার থেকে জামা,জুতো আর ডায়পার কিনে নিয়ে এসেছি।
মা জিজ্ঞেস করলেন,
-জুতো আর ডায়পার কেন?
-বাবুর জন্য আরকি। আমার তো আর বয়স নেই।
-গাধা! এখনো ডায়পার লাগবে নাকি? পিচ্চি না? জুতো কেন? আর যে জুতো এনেছিস, মেয়ের মা কে পরানো যাবে।
মায়ের কথা শুনে আমি জুতো জোড়া লুকিয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছে মায়ের চোখের সামনে যতক্ষণ থাকবে তিনি ততক্ষণ ই এই জুতো জোড়া সম্পর্কেই বলবেন। আমি মায়ের সামনে থেকে কেটে পড়ে বাবুর কাছে গিয়ে বসলাম। সে সদ্য খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ করে ঘুমিয়েছে। বাচ্চা রা পা উপরে উঠিয়ে কি করে ঘুমায় এটা একটা গবেষণার বিষয়।
-নীরা, ও পা এমন উঠিয়ে রেখে ঘুমায় কিভাবে?
-তুমি এর আগে বাচ্চাদের দেখোনি?
-দেখেছি, এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। অন্য বাচ্চাদের চুমু খেয়ে চলে আসতাম। নিজের বাচ্চা বলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি।
নীরা হাসতে গিয়েও হাসি চেপে রাখল। আমি বুঝতে পারিনা হাসি চেপে রাখার কি অর্থ! যে ঝর্ণা বইবে তাকে বইতে দাও না, যেই মুক্তো ঝরবে তাকে ঝরতে দাও! হাসি চেপে রেখে নীরা আমার প্রশ্নের চমকপ্রদ উত্তর দিল।
-বাচ্চাদের পা অনেক ফ্লেক্সিবল হয় বুঝছো? কারণ পা এখনো সুগঠিত না। অনেক সময় তো বাচ্চারা পা মুখে পর্যন্ত ঢুকিয়ে ফেলে দেখো না?
নীরার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হলাম। উত্তর বেশ সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু নীরার দিকে বেশি মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিনা, বারবার ছোট্ট মুখটার দিকে মনোযোগ চলে যাচ্ছে। বাচ্চাহীন যুগল আর বাচ্চাসহ যুগলের মধ্যে তফাত এটুকুই। বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে সব ভাগ হয়ে যাবে। ভালবাসা, যত্ন এমনকি মনোযোগ ও ভাগ হয়ে যায়। আমি বেশ কিছুক্ষণ ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হল এই নিষ্পাপ মুখটার দিকে যতক্ষণ তাকিয়ে আছি ততক্ষণ আমি পূণ্য জমা করছি। ছোট্ট হাতের মুঠোয় আমার আঙুল টা ধরিয়ে দিয়ে পাশে মাথা রাখলাম। একটু পর আঙুল টা জোরে চেপে ধরল ছোট্ট হাত টা। আমি মনে মনে বললাম, “এভাবেই ধরে রাখিস মা!”
(২)
মেয়ের নাম রাখা নিয়ে সবার চিন্তার অন্ত নেই। চাচাতো ভাইবোনেরা সব গোল হয়ে বসেছে। কেউ নামের বই নিয়ে এসেছে কোথা থেকে যেন, কেউ গুগলে সার্চ করছে। এদিকে বাবা এসে মাঝেমাঝে হাঁকডাক দিয়ে যাচ্ছেন, “কয়টা হল?”
আমি চুপ করে বসে আছি। সবাই অদ্ভুত অদ্ভুত নাম নির্বাচন করছে। নামের অর্থ যাই হোক, নামটা এমন হতে হবে যেটা কেউ আগে কখনো শোনেনি। বাবার কাছে কারো পছন্দ করা নামই জুতসই মনে হচ্ছেনা। একজন বলল, “সামিয়া”
-ঐটা আমার চাচা শশুরের মেয়ের নাম।
বাবার উত্তর।
-আফরা!
-ঐটা তো আনিকার ননদের মেয়ের নাম। হবেনা।
-নুবাইদা।
-এটা কঠিন কঠিন লাগছে। বুড়ো হয়ে গেল ডাকতে সমস্যা হবে।
-সামিয়া।
-এটা আমার স্কুলের ম্যাডামের নাম।
সবাই আশাহত হয়ে গেল। কোন নামই বাবার পছন্দ হচ্ছে না। আমার এক চাচাতো ভাইকে দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ বই আর ইন্টারনেটে ঘাঁটছে, এখনো সে একবারো নাম সাজেস্ট করেনি। বেশ কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পর সে মুখ খুলল। “আদিবা কেমন হয়?”
সবাই চমৎকার চমৎকার করতে লাগল। এবার আমি মুখ খুললাম।
-এটা আমার বসের বউয়ের নাম।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সবার উৎসাহ প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছে গেছে। কেউ আর নাম খুঁজতে আগ্রহ বোধ করছেনা। বাবা এসে আমার পাশে বসলেন।
-তুই ঠিক করেছিস কিছু?
-কি?
-নাম?
-জ্বি।
-কি?
-ফাতিমা।
বাবা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। যেন তিনি শুনেছেন আমি ‘এঞ্জেলিনা জোলি’ বলেছি।
-ফাতিমা?
-হ্যাঁ।
-আগে পরে কি হবে?
-ফাতিমা বিনতে মাহমুদ।
এবার বাবা ভ্রু কুঁচকালেন। এই ভ্রু কুঁচকানো কি অর্থবহন করছে তা দেখে বলা দায়। এরপর আর কিছু না বলেই উঠে গেলেন। বাবা খুশি হয়েছেন কি বেজার হয়েছেন বুঝতে পারলাম না। একটু পর নীরা এসে আমার কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখে বলল, “মনের মত হয়েছে নাম টা!” আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম। নাম রাখা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা কোনকালেই ছিল না। সন্তান জন্মের প্রথমদিকে বেশ কিছু কাজ আছে। এগুলো হচ্ছে আদর্শ বাবা হওয়ার প্রথম ধাপ। বিশেষ করে আকীকা দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বাবার সাথে আকীকা বিষয়ে কথা বললাম। বাবা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কারণ আকীকা উপলক্ষেও বাবা একটা অনুষ্ঠানের গন্ধ পাচ্ছেন।
-আত্মীয় স্বজন কয়েকজন কে তো দাওয়াত করতে হবে। দাওয়াত দিয়ে ঐদিন ই নাম রেখে দিই।
-হ্যাঁ। ঐটা করা যাবে। তবে ব্যস্ত হইয়েন না। এত জমকালো কিছু না, সাধারণ একটা অনুষ্ঠান হইলেই চলে।
বাবা আমার পরামর্শ কে এখন আর তুচ্ছ করছেন না আগের মত। কারণ আমি এখন সন্তানের বাবা হয়েছি। বাবা আমার কথায় কিছুটা শান্ত হয়ে ছোটাছুটি বন্ধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
-ছাগল কিনতে হবে না? আজ ই কিনে ফেলি, আজ তো বাজার বার।
অগত্যা দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম না করেই বাবার সাথে বাজারে যেতে হল ছাগল কিনতে।
(৩)
ছাগল কিনে ফিরলাম সন্ধ্যার পর। ছাগল কেনাও যে একেবারে ছেলের হাতের মোয়া না সেটা আজ বেশ বুঝে গেছি। একে তো বাজারে প্রচণ্ড ভীড়, তার উপর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। এর আগে পশুর হাটে কখনোই যাইনি, আগ্রহ বোধ করিনি কখনো। হাটে বিক্রেতার পাশে একজন লোক থাকে, যাকে মূলত দালাল বলা হয়। এই ‘দালাল’ কথাটা বহু শুনেছি, কিন্তু দালাল কি এবং তার কাজ কি সে সম্পর্কে কখনোই জানতাম না। এক ছাগল ব্যাপারীর সাথে কথা বলছিলাম, সেখানে অনেক লোক ছিল যার বেশিরভাগ ই ছাগল বিক্রির সাথে জড়িত না, কেউ ছাগল দেখছে - পছন্দ হলে কিনবে এমন, উৎসাহী জনতা আছে কিছু।
এই উৎসাহী মানুষগুলোকে আপনি যখন তখন আবিষ্কার করে ফেলবেন। কোথাও চুল্কানির মলম বিক্রি হচ্ছে, এরা সেখানে জটলা করবে। কোথাও তিনশো টাকার লাইট একশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে , এদের সেখানে পাবেন। এরা কোথাও কিন্তু কিছু কিনতে যায়না, এরা যায় দেখতে, কি হচ্ছে আসলে। কোথাও কোন চোরকে ধরা হয়েছে, এদেরকে সেখানেও পাবেন। এরা চোরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, কেউ কেউ মাঝে মাঝে উড়ে এসে দু চারটা লাথিও মারবে।
তো এত উৎসাহী মানুষের ভিড়ে আমি প্রকৃত দালাল কে চিনতে পারলাম না। আমি ভীড়ের মধ্যেই বাবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, এদের মধ্যে দালাল কোনটা?” বাবা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন, আমি চুপ হয়ে গেলাম।
পশুর হাটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দরাদরি। আমি সবসময় নিজেকে অতিচালাক ভাবা মানুষ, তাই বাবাকে এগিয়ে না দিয়ে আমি নিজেই দরাদরি তে এগিয়ে গেলাম। আর লক্ষ্য করলাম, ভীড়ের মধ্যে একটা মানুষ ক্রমাগত আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ সমর্থন পেলে খুশি হয়, এটা জগতের নিয়ম। তাই আমারো লোকটার প্রতি একটা সফট কর্ণার তৈরি হল। আর সেই লোকটা আমাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্টে মধ্যস্ততা করে দিল। আমি খুশিতে গদগদ, আজকাল এত ভাল মানুষ ও আছে! আমি লোকটাকে চা খাওয়াতে চাইলাম। গালভরা হাসি সহ বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবা ‘গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব’ লুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মূহুর্তেই আমার হাসি মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম কোন গণ্ডগোল হয়েছে। ছাগল নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাবা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মধ্যস্থতা কারী ঐ লোকটিই ছিল দালাল। এবং আমরা যত দামে নিতে পারতাম তার কমপক্ষে পাঁচশত থেকে এক হাজার টাকা বেশি দামেই ছাগল টা কিনেছি। নিজের অতিচালাক স্বভাবের জন্য নিজের উপর রাগ হল। বাবার দিকে তাকিয়ে একটা ডায়লগ মনে হল, “হার বাপ কা এক বাপ হোতা হ্যায়!”
(৪)
এদিকে মেয়েটা আমার জনম দুঃখী। জন্মের পর থেকে শুধু কাঁদেই। সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত কোন বেলায়ই বাদ নেই। কান্না শুরু হলে থামে না। রাতভর তাকে কোলে নিয়ে হাঁটা লাগে। আর এদিকে নীরা বেচারীর ও কষ্টের সীমা নেই। গভীর রাতে বারবার উঠে চেক করতে হয় বাবু পেশাব করেছে কিনা, করলে কাঁথা চেঞ্জ করে দিতে হয়, নাহয় ঠান্ডা লেগে যায়। সারাদিনে পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার করা, কাঁথা ধোয়া এসব করতে করতেই বেচারির দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। তার উপর হঠাৎ হঠাৎ কোলের মধ্যেই পেশাব করে দিলে কাজের মধ্যে আরো কাজ বেড়ে যায়। এত কিছুর পরও নীরা এক বিন্দুও বিরক্ত হয়না। সব কাজ শেষ করেও মেয়েকে আদর করে, গল্প করে তার সাথে, সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখে, এক মিনিট ও একা ছাড়ে না।
আসলে মায়ের মমতা অনন্য একটা পর্যায়ের। বাবা যতটুকুই করুক, মায়ের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। আর আমি তো বাবার কোন একটা ক্যাটাগরিতেই পড়িনা। কোলে নিই সতর্কতার সহিত, কখন ইয়ে করে দেয়। মেয়েও সতর্ক হয়ে গেছে, কোল চিনে গেছে বোধহয়, বাবার কোলে ভুলেও কখনো করবেনা। আর রাতে যখন কান্না উঠে যায়, নীরা কান্না থামানোর চেষ্টা করে, আর আমি বালিশ মাথার উপর দিয়ে ঘুমাই। আমি বাবার দায়িত্ব পালন তো করিই না, উলটো মায়ের দায়িত্ব বাড়াই। এইতো সেদিন নীরা কেবল ঘুম পাড়িয়ে গেল, আমি গিয়ে আদর করে করে জাগিয়েই দিলাম মেয়েটাকে। পরে এসে নীরাকে আবার ঘুম পাড়াতে হয়েছে, আমি ততক্ষণে পালিয়ে গেছি।
আজকে দিনটা খুব স্মরণীয় একটি দিন। আজ আমার মেয়ের নাম রাখা হয়েছে। তার নাম রাখা হয়েছে ফাতিমা। রাসূল(স) এর কন্যার নামও ছিল ফাতিমা। সবাই খুশি হয়েছে এমন নামে। যদিও কতিপয় মডার্ণ মহিলা এসে মুভি ক্রিটিক্সের মত এই নামের সমালোচনা করেছেন। এই নাম টা খুবই ব্যাকডেটেড নাম, এখনকার যুগে এসব নাম চলে না, ফ্যামিলির সাথে যায়না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত্বনা দিই, কান শুধু এসব শোনার জন্য, কানের অন্যান্য উপকারিতা আছে, এই ভেবে আমি কান পরিষ্কার করতে করতে অন্যদিকে চলে যাই।
আবার এদিকে ফাতিমার চুল কামিয়ে সমপরিমাণ রুপা দেয়া হয়েছে, ছাগল কুরবানী ও হয়েছে। সবকাজ হওয়ার পর নিজেকে খুব নির্ভার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, হ্যাঁ এইতো, পেরেছি তো, করেছি তো! আমি হতে পারি অগোছালো, দায়িত্বজ্ঞানহীন, বোকা কোন বাবা! কিন্তু অনেক দায়িত্ববোধসম্পন্ন বাবাও তো তার সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য এটুকু করতে পারেনা। আমি বাবা হওয়ার পর থেকে বারবার বাবার দিকে তাকাই। যতবারই বাবা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয় ততবার তাকাই, যতবার কঠিন কোন পরিস্থিতিতে পড়ি ততবার তাকাই, যতবার আটকে যাই ততবার তাকাই। ভাবি, কি করে পেরেছেন বাবা, এত কিছু সামলাতে? তিনিও তো এমনি ছিলেন, বয়স কম ছিল, কত কিছুই তো জানতেন না, কত কিছুই তো নতুন ছিল! কেমন কষ্টই না হত! তাও তিনি করেছেন, সারাজীবন নিজেকে ভুলে সন্তানের জন্য করেছেন, এমনকি এখনো করছেন। এসব ভাবলে অন্যরকম এক ভাললাগা কাজ করে, শ্রদ্ধা কাজ করে মানুষটার প্রতি। পৃথিবীর প্রত্যেকটা সন্তান যদি এই নজরে তার বাবাকে দেখত, তবে এতগুলো বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠত না কখনোই।
(চলবে……)
বউনামা! পর্ব-১৩
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
6:03 PM
Rating:

No comments