বউনামা! পর্ব-১৪ (শেষ পর্ব)
#বউনামা_১৪ (শেষ পর্ব)
(১)
ফাতিমার জন্মের পর থেকে আমি বউকে আর খুঁজেই পাইনা। মনে হয় সে টেকনাফ, আর আমি তেঁতুলিয়া, সে হিমালয়, আর আমি বঙ্গোপসাগর। এর চেয়েও ভাল উদাহরণ হতে পারে, সে মুদ্রার একপাশ আমি অপরপাশ। কিন্তু এ উদাহরণে ত্রুটি আছে, মুদ্রার দুইপাশের কখনোই দেখা হয়না, কিন্তু আমাদের মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। তখন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। অনেকদিন পর পুরনো কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলে হাত মিলাবো নাকি কোলাকুলি করব এই কনফিউশনে থাকতে থাকতে দুজন দুজনকে যেমন পাশ কাটিয়ে চলে যাই, সেরকমই কিছু হয় এখন আমার আর নীরার মধ্যে। আমরা মুখোমুখি হই, দুজন দুজনকে ‘হ্যালো/হাই’ দিব এমন একটা ভাব, কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আমি মাঝেমাঝে মেয়েটাকে শাসন করি, সে কিছু বুঝতে পারেনা, শুধু হাসে, কখনো বা আমার মুখের এক্সপ্রেশনে হয়ত অনুমান করে ফেলে, তাই কেঁদে ফেলে।
-কি? কি চিন্তাভাবনা আপনার হুঁ? এখন কি সুন্দর হাসছেন, কিন্তু মনে মনে ঠিকই প্ল্যান করছেন, আজকে রাতে বরাবর তিনটে বেজে তের মিনিটে ঘুম থেকে জেগে চিৎকার শুরু করে দিবেন, তাইনা?
আমার কথা শুনে মেয়ে হাসে। আজ সে বেশ ফূর্তিতে আছে বলে মনে হচ্ছেনা। আমি আবার শুরু করি।
-ডিভাইড এন্ড রুল খেলছো আব্বু-আম্মুর সাথে না? আব্বু আম্মুরে সারাদিন আলাদা রাখবা, যাতে দুজনের উপর রাজত্ব করা যায় হুঁ?
আমি এসব বলছি মেয়েকে আর ওদিকে নীরা দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছে সব।
-কি বলছো এগুলো মেয়েকে? এগুলো কোন কথা!
-এই দেখো, কেমন হাসছে। দাঁত ও নেই।
-বয়স এখনো দশ দিনও হয়নি, দাঁত থাকবে কিভাবে?
-দাঁত থাকা বাধ্যতামূলক না, দাঁতবিহীন হাসি ই সুন্দর। আবার সম্পূর্ণ দুপাটি দাঁতযুক্ত হাসি সুন্দর। কিন্তু কিছু দাঁতযুক্ত এবং কিছু দাঁতবিহীন, এ ধরণের হাসি বিধঘুটে।
-নিজের যখন দাঁত পড়ে যাবে তখন বুঝবেন। বুড়োরা তো ইচ্ছে করে দাঁত উপড়ে ফেলে আসে না।
আজকাল নীরা আমার প্রত্যেকটা কথায় সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখেই বোঝা যায় খুব স্ট্রেসে আছে। আহারে বেচারি, আফসোস হয় ওর জন্য। সারাদিন কত খাটাখাটনি সহ্য করবে। এমন অবস্থায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাই আমি চুপ করে থাকি, প্রত্যুত্তর করিনা।
(২)
বাবা আর আগের মত নেই, কেমন দিলদরদী মানুষ হয়ে গেছেন। দিনের বেশিরভাগ সময় নাতনীকে নিয়ে পড়ে থাকেন। কারো সাথে এখন কর্কশ ভাবে কথা বলেন না। সারাক্ষণ হাসিমুখে কথা বলেন। বাবার এ পরিবর্তনে আমি বেশ অবাক হয়েছি। পরিবর্তনের ছোঁয়া মায়ের মধ্যেও লেগেছে। মায়ের পরিবর্তন গুলো অবশ্য উল্লেখযোগ্য না। একটা ছোট্ট মুখ এসে সবাইকে বদলে দিয়েছে।
বাবা মাঝে মাঝে এসে নাতনীকে আদর করে যান। আমার অবাক লাগে এটা ভাবতে যে বাবা এখন দাদা হয়েছেন। অথচ বাবার বয়স কত কম! এ বয়সী কোন লোককে দাদা হিসেবে মানায় না। কেমন একটা বেমানান লাগে। দাদা হবে এমন কেউ, যার চামড়া ঝুলে গেছে, চুল দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। আমি অনুমান করতে পারি, ফাতিমা মোটামুটি বড় হলে আমার মতই ভাববে। সে হয়ত তার দাদার দাদা হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, এমনকি উচ্চ আদালতে রিট ও করতে পারে।
ঢাকায় ফেরার পর অফিস আর কাজ এসব নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে মেয়ের সাথে সময় কাটানোই হয়ে ওঠে না। আমি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা পেরিয়ে যায়। বেশিরভাগ দিনই মেয়েটা তখন ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিনে কত দায়িত্ব তার, সবার আদর নিতে হয়, আঙুল চোষা তো সারাদিনের চাকরি, এরপর একটু পরপর কান্না করা, তারপর হিসু করে দেয়া, এতসব দায়িত্ব পালন করার পর তার ক্লান্তি তো এসেই যায়। তাই ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ার আরো একটি উদ্দেশ্য আছে, মাঝরাতে জেগে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়া লাগবে না তার? সেটা তো তার নাইট ডিউটি।
আজ বাসায় ফিরেই দেখি ফাতিমা ঘুমাচ্ছে। নীরা আমাকে ফ্রেশ হতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। খাবার রেডি করার পর আমাকে ডাকা হল। খেতে বসলে এখন কেমন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে আমাদের মধ্যে। নীরা তো কিছু বলেই না, আমি বলতে গেলেও আটকে যাই, নীরবতা ভাঙা কেমন যেন আইনের লঙ্ঘন বলে মনে হয়। অফিসে জব করতে করতে এমন নিয়মবদ্ধ হয়ে গেছি আজকাল। আর নীরা বাচ্চা সামলাতে সামলাতে অন্যরকম হয়ে গেছে। ও খেতে বসেছে, কিন্তু খাওয়ায় মন নেই। এদিক ওদিক করছে শুধু, কখন মেয়ে জেগে যায়।
-শান্ত হও না। খাবার টা ঠিকমত খাও। ও জাগবে না।
এই কথাটা বোধহয় না বললেও পারতাম। বিদ্যুৎগতিতে আমার কথার বিপরীত প্রভাব পড়ল। কান্নার আওয়াজ শোনা গেল, ফাতিমা জেগে গেছে। নীরা হাতটা ধুয়েই দৌড় দিল। আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ করে রুমে যাব এমন সময়ই অফিস থেকে ফোন এল।
-আসিফ সাহেব।
-জ্বি স্যার।
-আপনাকে একটু বিরক্ত করব। আগামী শনিবার আমাদের যেই প্রজেক্টের ইনোভেশন হওয়ার কথা ছিল সেটার কাজ দিয়েছিলাম আশফাক কে। সে এলোমেলো করে ফেলেছে। আপনি যদি একটু দেখতেন।
-জ্বি স্যার।
কারো অধীনে চাকরি করা মানে তার গোলামী করা। উঠতে বসতে তার হুকুম মানা। কিন্তু জীবনে চলতে হলে চাই টাকা আর সেটা গোলামী বাদে আসছে না। তাই অসহ্য আদেশ গুলোও চুপচাপ শুনে যেতে হয়। এই যে দায়িত্ব টা আমার উপর সঁপে দেয়া হল, এটা কি যৌক্তিক ছিল! অন্যের কাজ আমি করব কেন? আমার কি নিজস্ব কোন কাজ নেই! কিন্তু আমি যখনি কিছু বলতে যাব, তখনি আমি হয়ে যাবে ইনসিন্সিয়ার, ঘাড়ত্যাড়া, এরোগ্যান্ট আরো নাম জানা শতাধিক ইংরেজি শব্দ। তাই চুপচাপ মেনে নিয়ে ফোন রেখে দিই।
এদিকে নীরা খাবার অসম্পূর্ণ রেখেই মেয়েকে ঘুম পাড়াতে চলে গেছে। সারাদিনের এত ধকলের পর খাওয়া টাও ঠিকমত হচ্ছে না। আমি নীরার খাবার টা ঢেকে দিয়ে রুমের দিকে যেতেই দেখি নীরা ফাতিমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পা টা খাটের বাইরে অর্ধেক ঝুলছে। এই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি যত কাছে যাচ্ছিলাম তত স্পষ্ট হচ্ছিল একটা স্বর্গীয় দৃশ্য আর দুটো ভীষণ পবিত্র মুখ! ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষকে ভীষণ পবিত্র লাগে। আর বাচ্চারা তো এমনিই পবিত্র। মুহুর্তেই আমার সব কষ্ট কর্পূরের মত উড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখলে পাথর ও বোধহয় গলে যেত। হয়ত পাহাড় ধ্বসে যেত। আকাশ যদি দেখত, তবে তার অশ্রু হয়ত বৃষ্টি হয়ে নামত। সারা পৃথিবীর ফুলেরা মালা হয়ে অভিবাদন জানাত। এই একটু আগে যেই ঘটনাটির জন্য আমার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল, সে ঘটনাটি এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে ভীষণ তুচ্ছ। এখন মনে হচ্ছে বস যদি আমাকে বলতেন, অফিসের সব কর্মচারীদের প্রজেক্ট আমাকে করতে হবে, তবেও আমি হাসিমুখে মেনে নিতে পারতাম।
আমি খুব সাবধানে নীরার পা দুটো বিছানায় উঠিয়ে দিলাম। কাঁথা টেনে দিলাম গায়ে। নীরার মুখের উপর আসা চুল গুলো সরিয়ে দিলাম। নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। চুমু এঁকে দিলাম দুজনের কপালে। চুমু ও আজকাল ভাগ হয়ে গেছে। পিচ্চিটা সবকিছুতেই ভাগ বসিয়েছে, ভেবে মনে মনে হাসলাম। মশারি টানিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ থাকা খাবার গুলো গরম করে রান্নাঘরে তুলে রাখলাম। নীরার খাবার টা ঢেকে রাখলাম।
রুমে ফিরে মশারির ফাঁক দিয়ে আবারো তাকালাম দুটো মুখের দিকে। বিষয়টা অনেকটা বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখার মত। আমার ঘরে একটি নয়, একসাথে দু দুটো চাঁদ। এ চাঁদের কখনো অমাবস্যা হয়না, গ্রহণ হয়না, এ চাঁদ কখনো ডোবে না, কখনো বাড়ে-কমে না। এ চাঁদের স্নিগ্ধতা আমাকে সব হতাশা থেকে দূরে রাখে। আমি এই মুখ দুটো দেখে ভীষন তৃপ্তি পাই। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি প্রয়োজন হয় একটি অবলম্বনের। নয়ত অক্সিজেন তো সবাই পায়, তাও কেন মানুষ আত্মহত্যা করে! আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আমার দু দুটো অবলম্বন আছে। এদের জন্যই বাঁচতে হবে, অনেক বছর বাঁচতে হবে! আজ জীবনটাকে নতুন করে ভালবেসে ফেললাম!
(সমাপ্ত)
ধন্যবাদ- আসিফ মাহমুদ ভাইকে
(১)
ফাতিমার জন্মের পর থেকে আমি বউকে আর খুঁজেই পাইনা। মনে হয় সে টেকনাফ, আর আমি তেঁতুলিয়া, সে হিমালয়, আর আমি বঙ্গোপসাগর। এর চেয়েও ভাল উদাহরণ হতে পারে, সে মুদ্রার একপাশ আমি অপরপাশ। কিন্তু এ উদাহরণে ত্রুটি আছে, মুদ্রার দুইপাশের কখনোই দেখা হয়না, কিন্তু আমাদের মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। তখন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। অনেকদিন পর পুরনো কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলে হাত মিলাবো নাকি কোলাকুলি করব এই কনফিউশনে থাকতে থাকতে দুজন দুজনকে যেমন পাশ কাটিয়ে চলে যাই, সেরকমই কিছু হয় এখন আমার আর নীরার মধ্যে। আমরা মুখোমুখি হই, দুজন দুজনকে ‘হ্যালো/হাই’ দিব এমন একটা ভাব, কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আমি মাঝেমাঝে মেয়েটাকে শাসন করি, সে কিছু বুঝতে পারেনা, শুধু হাসে, কখনো বা আমার মুখের এক্সপ্রেশনে হয়ত অনুমান করে ফেলে, তাই কেঁদে ফেলে।
-কি? কি চিন্তাভাবনা আপনার হুঁ? এখন কি সুন্দর হাসছেন, কিন্তু মনে মনে ঠিকই প্ল্যান করছেন, আজকে রাতে বরাবর তিনটে বেজে তের মিনিটে ঘুম থেকে জেগে চিৎকার শুরু করে দিবেন, তাইনা?
আমার কথা শুনে মেয়ে হাসে। আজ সে বেশ ফূর্তিতে আছে বলে মনে হচ্ছেনা। আমি আবার শুরু করি।
-ডিভাইড এন্ড রুল খেলছো আব্বু-আম্মুর সাথে না? আব্বু আম্মুরে সারাদিন আলাদা রাখবা, যাতে দুজনের উপর রাজত্ব করা যায় হুঁ?
আমি এসব বলছি মেয়েকে আর ওদিকে নীরা দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছে সব।
-কি বলছো এগুলো মেয়েকে? এগুলো কোন কথা!
-এই দেখো, কেমন হাসছে। দাঁত ও নেই।
-বয়স এখনো দশ দিনও হয়নি, দাঁত থাকবে কিভাবে?
-দাঁত থাকা বাধ্যতামূলক না, দাঁতবিহীন হাসি ই সুন্দর। আবার সম্পূর্ণ দুপাটি দাঁতযুক্ত হাসি সুন্দর। কিন্তু কিছু দাঁতযুক্ত এবং কিছু দাঁতবিহীন, এ ধরণের হাসি বিধঘুটে।
-নিজের যখন দাঁত পড়ে যাবে তখন বুঝবেন। বুড়োরা তো ইচ্ছে করে দাঁত উপড়ে ফেলে আসে না।
আজকাল নীরা আমার প্রত্যেকটা কথায় সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখেই বোঝা যায় খুব স্ট্রেসে আছে। আহারে বেচারি, আফসোস হয় ওর জন্য। সারাদিন কত খাটাখাটনি সহ্য করবে। এমন অবস্থায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাই আমি চুপ করে থাকি, প্রত্যুত্তর করিনা।
(২)
বাবা আর আগের মত নেই, কেমন দিলদরদী মানুষ হয়ে গেছেন। দিনের বেশিরভাগ সময় নাতনীকে নিয়ে পড়ে থাকেন। কারো সাথে এখন কর্কশ ভাবে কথা বলেন না। সারাক্ষণ হাসিমুখে কথা বলেন। বাবার এ পরিবর্তনে আমি বেশ অবাক হয়েছি। পরিবর্তনের ছোঁয়া মায়ের মধ্যেও লেগেছে। মায়ের পরিবর্তন গুলো অবশ্য উল্লেখযোগ্য না। একটা ছোট্ট মুখ এসে সবাইকে বদলে দিয়েছে।
বাবা মাঝে মাঝে এসে নাতনীকে আদর করে যান। আমার অবাক লাগে এটা ভাবতে যে বাবা এখন দাদা হয়েছেন। অথচ বাবার বয়স কত কম! এ বয়সী কোন লোককে দাদা হিসেবে মানায় না। কেমন একটা বেমানান লাগে। দাদা হবে এমন কেউ, যার চামড়া ঝুলে গেছে, চুল দাঁড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। আমি অনুমান করতে পারি, ফাতিমা মোটামুটি বড় হলে আমার মতই ভাববে। সে হয়ত তার দাদার দাদা হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, এমনকি উচ্চ আদালতে রিট ও করতে পারে।
ঢাকায় ফেরার পর অফিস আর কাজ এসব নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে মেয়ের সাথে সময় কাটানোই হয়ে ওঠে না। আমি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা পেরিয়ে যায়। বেশিরভাগ দিনই মেয়েটা তখন ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিনে কত দায়িত্ব তার, সবার আদর নিতে হয়, আঙুল চোষা তো সারাদিনের চাকরি, এরপর একটু পরপর কান্না করা, তারপর হিসু করে দেয়া, এতসব দায়িত্ব পালন করার পর তার ক্লান্তি তো এসেই যায়। তাই ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ার আরো একটি উদ্দেশ্য আছে, মাঝরাতে জেগে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়া লাগবে না তার? সেটা তো তার নাইট ডিউটি।
আজ বাসায় ফিরেই দেখি ফাতিমা ঘুমাচ্ছে। নীরা আমাকে ফ্রেশ হতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। খাবার রেডি করার পর আমাকে ডাকা হল। খেতে বসলে এখন কেমন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে আমাদের মধ্যে। নীরা তো কিছু বলেই না, আমি বলতে গেলেও আটকে যাই, নীরবতা ভাঙা কেমন যেন আইনের লঙ্ঘন বলে মনে হয়। অফিসে জব করতে করতে এমন নিয়মবদ্ধ হয়ে গেছি আজকাল। আর নীরা বাচ্চা সামলাতে সামলাতে অন্যরকম হয়ে গেছে। ও খেতে বসেছে, কিন্তু খাওয়ায় মন নেই। এদিক ওদিক করছে শুধু, কখন মেয়ে জেগে যায়।
-শান্ত হও না। খাবার টা ঠিকমত খাও। ও জাগবে না।
এই কথাটা বোধহয় না বললেও পারতাম। বিদ্যুৎগতিতে আমার কথার বিপরীত প্রভাব পড়ল। কান্নার আওয়াজ শোনা গেল, ফাতিমা জেগে গেছে। নীরা হাতটা ধুয়েই দৌড় দিল। আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ করে রুমে যাব এমন সময়ই অফিস থেকে ফোন এল।
-আসিফ সাহেব।
-জ্বি স্যার।
-আপনাকে একটু বিরক্ত করব। আগামী শনিবার আমাদের যেই প্রজেক্টের ইনোভেশন হওয়ার কথা ছিল সেটার কাজ দিয়েছিলাম আশফাক কে। সে এলোমেলো করে ফেলেছে। আপনি যদি একটু দেখতেন।
-জ্বি স্যার।
কারো অধীনে চাকরি করা মানে তার গোলামী করা। উঠতে বসতে তার হুকুম মানা। কিন্তু জীবনে চলতে হলে চাই টাকা আর সেটা গোলামী বাদে আসছে না। তাই অসহ্য আদেশ গুলোও চুপচাপ শুনে যেতে হয়। এই যে দায়িত্ব টা আমার উপর সঁপে দেয়া হল, এটা কি যৌক্তিক ছিল! অন্যের কাজ আমি করব কেন? আমার কি নিজস্ব কোন কাজ নেই! কিন্তু আমি যখনি কিছু বলতে যাব, তখনি আমি হয়ে যাবে ইনসিন্সিয়ার, ঘাড়ত্যাড়া, এরোগ্যান্ট আরো নাম জানা শতাধিক ইংরেজি শব্দ। তাই চুপচাপ মেনে নিয়ে ফোন রেখে দিই।
এদিকে নীরা খাবার অসম্পূর্ণ রেখেই মেয়েকে ঘুম পাড়াতে চলে গেছে। সারাদিনের এত ধকলের পর খাওয়া টাও ঠিকমত হচ্ছে না। আমি নীরার খাবার টা ঢেকে দিয়ে রুমের দিকে যেতেই দেখি নীরা ফাতিমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পা টা খাটের বাইরে অর্ধেক ঝুলছে। এই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি যত কাছে যাচ্ছিলাম তত স্পষ্ট হচ্ছিল একটা স্বর্গীয় দৃশ্য আর দুটো ভীষণ পবিত্র মুখ! ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষকে ভীষণ পবিত্র লাগে। আর বাচ্চারা তো এমনিই পবিত্র। মুহুর্তেই আমার সব কষ্ট কর্পূরের মত উড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখলে পাথর ও বোধহয় গলে যেত। হয়ত পাহাড় ধ্বসে যেত। আকাশ যদি দেখত, তবে তার অশ্রু হয়ত বৃষ্টি হয়ে নামত। সারা পৃথিবীর ফুলেরা মালা হয়ে অভিবাদন জানাত। এই একটু আগে যেই ঘটনাটির জন্য আমার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল, সে ঘটনাটি এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে ভীষণ তুচ্ছ। এখন মনে হচ্ছে বস যদি আমাকে বলতেন, অফিসের সব কর্মচারীদের প্রজেক্ট আমাকে করতে হবে, তবেও আমি হাসিমুখে মেনে নিতে পারতাম।
আমি খুব সাবধানে নীরার পা দুটো বিছানায় উঠিয়ে দিলাম। কাঁথা টেনে দিলাম গায়ে। নীরার মুখের উপর আসা চুল গুলো সরিয়ে দিলাম। নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। চুমু এঁকে দিলাম দুজনের কপালে। চুমু ও আজকাল ভাগ হয়ে গেছে। পিচ্চিটা সবকিছুতেই ভাগ বসিয়েছে, ভেবে মনে মনে হাসলাম। মশারি টানিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ থাকা খাবার গুলো গরম করে রান্নাঘরে তুলে রাখলাম। নীরার খাবার টা ঢেকে রাখলাম।
রুমে ফিরে মশারির ফাঁক দিয়ে আবারো তাকালাম দুটো মুখের দিকে। বিষয়টা অনেকটা বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখার মত। আমার ঘরে একটি নয়, একসাথে দু দুটো চাঁদ। এ চাঁদের কখনো অমাবস্যা হয়না, গ্রহণ হয়না, এ চাঁদ কখনো ডোবে না, কখনো বাড়ে-কমে না। এ চাঁদের স্নিগ্ধতা আমাকে সব হতাশা থেকে দূরে রাখে। আমি এই মুখ দুটো দেখে ভীষন তৃপ্তি পাই। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি প্রয়োজন হয় একটি অবলম্বনের। নয়ত অক্সিজেন তো সবাই পায়, তাও কেন মানুষ আত্মহত্যা করে! আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আমার দু দুটো অবলম্বন আছে। এদের জন্যই বাঁচতে হবে, অনেক বছর বাঁচতে হবে! আজ জীবনটাকে নতুন করে ভালবেসে ফেললাম!
(সমাপ্ত)
ধন্যবাদ- আসিফ মাহমুদ ভাইকে
বউনামা! পর্ব-১৪ (শেষ পর্ব)
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
6:08 PM
Rating:

No comments