প্রাপ্তি- শেষ পর্ব
আমি যাচ্ছি আমার মধুকে আনতে,আমি একাই যাচ্ছি।
এই বলে অভয় মধুকে ফিরিয়ে আনতে বাসা থেকে রওনা দিলো...
কলিং বেল বাজছে।
কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দিলাম।
খুলেই ভূত দেখার মত চমকে গেলাম।
-আপনি?
-হ্যাঁ আমি।
-আসুন ভেতরে আসুন।বসুন।
-কেমন আছো মধু?
-এইতো চলছে।
-আপনি?
-তোমার উপর যে অন্যায় আমি করেছি সেই অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছি।
-এভাবে বলতে নেই,আমি আপনাকে কোন অভিশাপ দেইনি,বরং সব সময় আপনার জন্য দোয়াই করেছি।
-আমি জানি, কিন্তু আল্লাহ্ তোমাকে কষ্ট দেয়ার ফল স্বরুপ আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।আমিও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।আমি তোমাকে নিতে এসেছি মধু।
-সরি!আমি আপনার সাথে যেতে পারবোনা।
-প্লিজ মধু না করোনা,আজ মালিহাও চলে গেছে আমাকে ফেলে চিরদিনের জন্য।
-ওহ্ এই কথা?এই জন্য তাহলে আপনি আমাকে নিতে এসেছেন?আবার যখন মালিহা চলে আসবে তখন আবার আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন তাইনা?
-না মধু,মালিহা আর আসবেনা।ও একেবারেই চলে গেছে।
-কেন গেছে?এত ভালবাসা আপনাদের,যার জন্য আমাকে আপনারা আমার সংসার ছাড়াও করলেন।তবে আজ কেন আপনার সেই ভালবাসার মানুষ টা আপনাকে ছেড়ে গেলো?
-কেন গেলো?কারণ আমি কখনো ওকে মা হবার সুখ দিতে পারবোনা।আমি কোন দিন বাবা হতে পারবোনা।আমি বাবা হবার ক্ষমতা হারিয়েছি।
-বাহ্ এই বুঝি আপনাদের ভালবাসা?বাবা হতে পারবেন না বলে আপনাকে ছেড়ে চলে গেলো।
-প্লিজ মধু আমাকে আর কষ্ট দিওনা।
-আমি কষ্ট দিচ্ছি আপনাকে?ভালোই বললেন।
-চলো মধু আমার সাথে,মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-সরি মি.অভয় আমি যাবোনা।আপনি ফিরে যান।
-তুমি না গেলেও আমি আমার সন্তানকে তো নিয়ে যেতে পারি।আর আমার সন্তান যেহেতু তোমার গর্ভে,সেহেতু তোমাকেও আমার সাথে যেতে হবে।
-বাহ্! আপনার সন্তান,আজ আপনার সন্তান হয়ে গেলো।অথচ কখনোই আপনি চান নি আমার গর্ভে আপনার সন্তান আসুক।আপনি তো আমাকে ভালই বাসেন নি কখনো।এই সন্তান আমার।আপনার কোন অধিকার নেই আমার সন্তানের উপর।চলে যান আপনি।
-আমি তোমাকে আর আমার সন্তান কে না নিয়ে এক পা ও নড়বোনা।
-আপনিও শুনে রাখুন,এই মধু আপনার সাথে আপনার বাড়ীতে যাবেনা।কারণ একটু হলেও এই মধুর সম্মানবোধ আছে।
-কিরে কে এসেছে মধু!এত চিল্লাচ্ছিস কেন?
-আসসালামু আলাইকুম মা।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছো অভয়?তোমার শরীর এখন কেমন?
-এইতো মা আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।আপনি কেমন আছেন?
-এইতো আছি বাবা।দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো।
-মা আমি মধুকে নিতে এসেছি।
-কিন্তু তোমার মালিহা?
-মালিহা বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে,ও আর আসবেনা।
-মধু!তুই কি বলিস?অভয় তোকে নিতে এসেছে।
-মা আমি কি তোমাদের কাছে বেশি হয়ে গেছি?
-এসব কি বলছিস তুই?
-তাহলে তাকে ফিরে যেতে বলো,আমি যাবোনা তার সাথে।
এই কথা বলে আমি আমার রুমে চলে আসলাম।
দুপুরে খাবার টেবিলে গেছি দেখি অভয়ও বসে আছে।আম্মু হয়তো দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছে।থাক এখন আর কিছু বলবোনা,অনেক কিছু বলা হয়েছে ওকে।যদিও বলতে চাইনি,তবুও ওর একটু নিজের বোঝা উচিৎ।
-মধু অভয়ের প্লেটে খাবার বেড়ে দে।
-তুমি দাও আম্মু।
-আচ্ছা ঠিকাছে দিচ্ছি।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ।আমি হল রুমে বসে আছি।ওমা!অভয় দেখি আমার রুমে যাচ্ছে।ও না বাসায় চলে যাবে?
-অভয় আমার রুমে যাচ্ছে কেন আম্মু?
-শরীর টা খারাপ লাগছে নাকি,তাই বিশ্রাম নিবে।
-অন্য কোন রুম নেই?আমার রুমেই বিশ্রাম নিতে হবে?
-চুপ কর না,অভয় শুনলে কষ্ট পাবে।
-সন্ধ্যা হয়ে গেছে,অভয়ের তো এখন বাসায় ফিরে যাবার কথা,যাচ্ছে না কেন ও?আম্মু ওকে গিয়ে বলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে,বাসায় ফিরে যেতে।
-তুই ই গিয়ে বল।
-এই যে অভয় সাহেব শুনছেন?সন্ধ্যা হয়ে গেছে,বাসায় যাবেন না?একটু পরে রাত হয়ে যাবে।উঠুন তাড়াতাড়ি আমার বিছানা থেকে।
-উম্ম,যাও তো এখান থেকে,নয়তো আসো বসো,আমার চুল গুলো টেনে দাও।
-মানে?আপনি উঠুন,উঠুন তাড়াতাড়ি।
-উঠবো কেন?
-উঠবো কেন মানে?সন্ধ্যা হয়ে গেছে,বাসায় যেতে হবেনা আপনার?
-উঁহু,আমি তো আমার বউ না নিয়ে বাসায় যাবোনা।
-আমি বলেছিনা আমি যাবোনা।
-তাহলে আমিও যাবোনা,
-আমিও যাবোনা মানে কি?
-আমিও যাবোনা মানে আমি থাকবো।আমার বাচ্চার সাথে থাকবো।
-ওই,সাহস তো কম না,এই মুহূর্তে আপনি যাবেন।
-উঁহু সোনা বউ,আমি তো যাবোনা।যত দিন না তুমি আমার সাথে যাও,তত দিন আমি এখানেই থাকবো,আমার বউ এর সাথে,আমার বাচ্চার সাথে।
-আম্মুউউউ,আম্মুউউউ,
-কি হয়েছে?
-দেখোনা অভয় কি বলছে।
-কি বলছে?
-ও নাকি বাসায় যাবেনা,এ বাসায় নাকি থাকবে।
-তো কি হয়েছে?থাকুক।বেড়াক।
-আম্মু তুমিও?ধুর...
আমি অভিমান করে আমার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেছি,দেখি সে আমার বিছানার এক পাশে কোল বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে।
-আপনি এখানে শুয়ে আছেন যে?
-বা রে,আমি আমার বাচ্চার সাথে শুবো না?
-উফফফ!
-উফফফফফ!
-চুপ!
-আচ্ছা চুপ।
-অসহ্য।
-ওই ওই তুমি ওপাশ হয়ে শুচ্ছো কেন?আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলবো।
-মেয়ে?মেয়ে আপনাকে কে বল্লো?
-আমি জানি,আমার মেয়েই হবে।তোমার মত লক্ষী একটা মেয়ে হবে।
-হয়েছে হয়েছে,ঘুমান এখন।
-উঁহু,ঘুমাবোনা
-তাহলে?
-আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলবো।তোমার ইচ্ছে হলে তুমি ঘুমাও।
-উফফ অসহ্য।
-আম্মু ও আম্মু তুমি শুনতে পাচ্ছো?তোমার আম্মু কত জেলাস ফীল করে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই বলে।
তোমার আম্মু একটা পঁচা।তুমি বাবার মেয়ে,ঠিকাছে?
-আপনি কি আমাকে ঘুমাতে দিবেন?এই ভাবে কথা বললে আমি ঘুমাবো কি করে?আর আমার পেট থেকে হাত সরান।
-আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলছি,তাতে তোমার কি?
-আল্লাহ্ কি মসিবতে ফেল্লা তুমি আমায়।
সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি অভয় আমার পেটে হাত রেখেই ঘুমিয়ে আছে।
সারারাত সে তার মেয়ের সাথে কথা বলেছে।তার ধারণা তার মেয়েই হবে।
আজো কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওকে।যেমন টা বিয়ের পরের দিন সকালে দেখাচ্ছিলো।হঠাৎ ও জাগতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।আর ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলো।
আর হাত ধরে বলতে লাগলো,কি নিষ্পাপ তুমি।কত সুন্দর একটা লক্ষী মেয়ে।আর তোমাকে আমি কতই না কষ্ট দিয়েছি।
ক্ষমা করে দিও আমায়।
হঠাৎ ওর চোখের জল আমার হাতে পড়লো,আমি ঘম থেকে জেগে যাওয়ার ভান করলাম।ও চোখ মুছে বল্লো,ফ্রেশ হয়ে চলো নাস্তা করবো।
ফ্রেশ হয়ে দুজনই নাস্তার টেবিলে গেলাম।আমি নাস্তায় হাত দিয়েছি আর অভয় বল্লো,আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে খাওয়াবো,যেহেতু আমার মেয়ে তোমার গর্ভে সেহেতু তুমি খেলেই আমার মেয়ে খাবে।সো হা করো হাঅা।
-আর কত জ্বালাবেন আমায় আপনি?
-সারাজীবন। সমস্যা কোন?
অভয় আমাকে নিজ হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলো।আম্মু ওর জন্য শপিং করে কাপড় চোপড় নিয়ে আসলো।
দুপুরের রান্না আজ অভয়ই করলো,সে নাকি তার মেয়েকে রান্না করে খাওয়াবে।
দুপুরেও অভয় আমাকে খাইয়ে দিলো।
আমার আম্মু আব্বু আর শাশুড়ি মা এসব খুব ইঞ্জয় করছেন।
মা আমাকে দেখতে আসেন।শশুড় বাবাও দুবাই থেকে ভিডিও কলে আমাকে দেখেন।কথা বলেন।
অভয় আমার অনেক খেয়াল রাখে,আমার সেবা করে।আমার খারাপ লাগলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।পা ব্যথা করলে পা ম্যাসাজ করে দেয়।
একজন স্বামী হিসেবে একজন অনাগত সন্তানের বাবা হিসেবে যথেষ্ট খেয়াল রাখে আমার।এখন সে একজন পারফেক্ট বর,পারফেক্ট বাবা।
মালিহা অভয়কে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।শুনেছি এক ধনী বিজনেসম্যানকে বিয়েও করে নিয়েছে।
ধীরেধীরে আমার সন্তান আমার পেটে বড় হতে থাকে।
নয় মাস শেষ হয়ে যায়,অল্প ক'দিনের মধ্যেই আমার সন্তানের মুখ দেখতে পাবো,ওকে কোলে পাবো,ভাবতেই বুক টা আনন্দে ভরে যায়।
হঠাৎ একদিন রাতের বেলা আমার প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়।
অভয় ভয় পেয়ে যায়,আম্মুকে ডেকে তুলে।আম্মু বলে ইমিডিয়েটলি আমাকে হসপিটালে নিতে হবে।
অভয় আমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়ীতে তোলে।
আমরা হসপিটালে পৌছাই,সারা রাস্তা অভয় আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
আমি সেদিন দেখেছি,ওর চোখে আমার জন্য জল।আমার ব্যথায় যেন ও কষ্ট পাচ্ছে।
হসপিটালের ডাক্তার আমাকে অটিতে নিয়ে যেতে বলেন,আর বলেন এটা ডেলিভারি পেইন।
অভয় আমার হাত ধরে রেখেছে,আম্মু বল্লো ওর হাত টা ছাড়ো বাবা,ওকে এখন নিয়ে যাবে।
অভয় আমার হাত ছাড়তে চাইছেনা,ওর চোখ থেকে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছে,
আম্মু আব্বু এবং ডাক্তারের কথায় তারপর আমার হাত ছাড়ে অভয়।কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,কিচ্ছু হবেনা তোমার।
ভয় পেওনা,তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে সুস্থ ভাবেই রুম থেকে বের হবে।
আর একটা কথা, ভালবাসি।
এই বলে অভয় আমার হাত ছাড়লো।
অভয়,আম্মু আব্বু বাইরে অপেক্ষা করছে।
এদিকে আমার শাশুড়ি মাও এসে হাজির।
কিছু ক্ষণ পর ডাক্তার অভয়কে বাইরে গিয়ে বল্লো,
আপনার মেয়ে হয়েছে।
-আর আমার মধু?
-আপনার স্ত্রী এবং বাচ্চা দুজনই সুস্থ আছেন।একটু পরেই অন্য রুমে দেয়া হবে তাদের।
-আচ্ছা ডাক্তার।ধন্যবাদ আপনাকে,অসংখ্য ধন্যবাদ।
একটা নার্স আমাদের সন্তানকে নিয়ে অভয়ের কোলে তুলে দেয়।
সবাই মিলে আমাদের মেয়েকে আদর করে কোলে নেয়।
কিছু ক্ষণ পর অভয় মেয়েকে নিয়ে রুমে আসে।
এসেই আমার কপালে চুমু খায়।
-বলেছিলাম না আমাদের মেয়ে হবে?দেখো এই যে আমার প্রাপ্তি।
-প্রাপ্তি?
-হুম,আমার মেয়ে প্রাপ্তি।হাজারো দুঃখ, কষ্ট,ঝড়,তুফান,ত্যাগের পর আমরা আমাদের এই অমূল্য ধন পেয়েছি।
তাই আমি ওর নাম রাখলাম প্রাপ্তি।
অভয় আমার পাশে প্রাপ্তিকে শুইয়ে দিলো।আমি ওর ছোট ছোট হাতে চুমু খেলাম।
তারপর অভয়কে জিজ্ঞেস করলাম,
আমাকে অটিতে নেবার আগে কি যেন বলেছিলেন?
অভয় আমার হাত ধরে বল্লো,
ভালবাসি।
আমিও ওকে বললাম,
আমি আপনার থেকেও অনেক বেশি,
ভালবাসি।
তারপর আম্মু আব্বু আর সবাই রুমে ঢুকলো।সবাই খুশি প্রাপ্তিকে পেয়ে।
আমি একটু সুস্থ হবার পর আমাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিলো।
অভয় জিজ্ঞেস করলো,এখন কোথায় যাবো আমরা?
আমি বললাম,কোথায় আবার?
প্রাপ্তির বাবার বাড়ী।
অভয়ের মুখে আজ বিজয়ের হাসি।ওর খুশিতে আমিও খুশি।
আমি যদি সেদিনই ওর সাথে ওর বাসায় চলে যেতাম,তবে ও কখনোই বুঝতোনা ওর জীবনে আমার মূল্যটা কতটুকু।
তাই আমি সেদিন যাইনি।আমি চেয়েছিলাম ও ওর ভুল শুধরে নিজেকে পরিপূর্ণ রুপে আমার কাছে সপে দিক।
আমাকে ভালবাসুক,সত্যিকারের ভালবাসুক।
হ্যাঁ ও এখন আমাকে ভালবাসে,খুব বেশিই ভালবাসে।তাই আমিও আজ চলে আসলাম আমার স্বামীর বাড়ীতে,আমার প্রাপ্তির দাদুর বাড়ীতে।
চলছে জীবন,আনন্দে,ভালবাসায়।
অভয়ের ভালবাসা আর আমাদের মেয়ে প্রাপ্তিই হলো আমার জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি।
সবাই দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
(সমাপ্ত)
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ পুরো গল্পটা পড়ার জন্য,
আমার পাশে থাকার জন্য।জানিনা গল্প টা আপনাদের কেমন লেগেছে।কিন্তু আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি ভালো করতে।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
সব শেষে সবার সুস্থতা কামনা করছি।
আল্লাহ্ হাফেজ।



প্রাপ্তি- শেষ পর্ব
Reviewed by গল্প প্রেমিক
on
11:16 AM
Rating:

No comments